শীতের সন্ধ্যাতেই লোকালয়ে জনসমাগম কমে আসে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরো কমতে থাকে। কিছুদিন হলো শীতের প্রকোপ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। মধ্যরাত, বয়স্ক নাজিম রিকশা নিয়ে বের হয়। শীত ঠেকাতে ছেঁড়া কোটা আরেকটু টেনে টুনে ঠিক করে। তারপর ধীরে প্যাডেল মেরে এগিয়ে চলে প্রায় জনশূন্য রাস্তায়। বয়সের ভারে ন্যুব্জ হলেও তার নিস্তার নেই। নাজিমের জন্য রাতে রিকশা চালানো সুবিধাজনক। রাস্তায় গাড়ি থাকে কম। রাতে জরুরি প্রয়োজনে বের হয় মানুষ। ডাক্তারের কাছে কিংবা হাসপাতালে যাওয়া আসা। অথবা গভীর রাতে ঘরমুখো কোন যাত্রীর প্রয়োজনে লাগে। ভাড়ার কথা জিজ্ঞাসা করলে ক্ষীণ কণ্ঠে বলেন, যা দেন। বেশিরভাগ যাত্রী ন্যায্য ভাড়ার চেয়ে বেশি দেয়। সে হাত তুলে সালাম দেয়। কিছু হিসেবী যাত্রী আছে যারা খুব হিসাব করে ভাড়া দেয়। মাঝেমধ্যে এমন বিপদগ্রস্ত যাত্রীও পাওয়া যায়, যাদের কাছে টাকা-পয়সা নাই। নাজিম সদয় হয়ে তাদের পৌঁছে দেয় গন্তব্যে। অনেক যাত্রী এই বয়সে রিকশা চালানোর কারণ জানতে চায়। নাজিম বলেন, এই কাম ছাড়া আর তো কিছু জানি না। কতদিন এই কাজে করছে সে, অনেকের জানার আরও আগ্রহ। সময়ের দৈর্ঘ্য ৫০ বছরের বেশি শুনে তারা বিস্মিত হয়। যখন শুনে তার বাবাও রিকশাচালক ছিল, তখন বিস্ময় পরিমাণ আরো বাড়ে। নাজিমের কাছেও সেটা আশ্চর্যের বিষয়। দেখতে দেখতে দীর্ঘ সময় কী করে কেটে গেল।
নাজিমদের বাড়ি ছিল সমুদ্রঘেঁষা দেশের সর্ব দক্ষিণ অঞ্চলে। সে অনেককাল আগের কথা। ১৯৭০-এর ১২ নভেম্বর। রেডিওতে শুনে শুনে আজও মনে আছে সেই দিনক্ষণ। প্রচণ্ড ঝড় জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল সেদিন। বানের পানিতে পাঁচ লাখ মানুষকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় সমুদ্রের অতল গহ্বরে, চিরতরে। খবরের কাগজের পাতায় দেখেছিল পশু আর মানুষের গাদাগাদি মৃতদেহ। সে এক বীভৎস দৃশ্য। এমন সর্বনাশা বিপর্যয়ে তাদের বাপ-বেটার বেঁচে থাকা ছিল আশ্চর্যজনক। বাবা একগাছা রশি দিয়ে তাকে বেঁধে ফেলেছিল নারকেল গাছের সঙ্গে। সেদিন দুনিয়ায় যেন কেয়ামত নেমে এসেছিল। মা এবং ছোট দুই বোন ভেসে যায় প্রচণ্ড বাতাস এবং ভয়ংকর স্রোতের টানে। অনেক খোঁজাখুঁজি করে তাদের আর পাওয়া যায়নি। ছিন্নমূল মানুষের স্রোতে শামিল হয় তারা। নাজিমকে নিয়ে তাঁর পিতা রওনা দেয় শহরে। রিকশাওয়ালা হিসেবে হয়ে যায় সহজ কর্মসংস্থান।
নাজিম কৈশোর থেকে যৌবনে পা রেখেছে তখন। দেশে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ। নাজিমের বাবা বললেন একটা কিছু কর নাজিম। নাজিমকে তার বাবা মহাজনের রিকশা গ্যারেজে নিয়ে যায়। তার জন্য বরাদ্দ হয় একটা রিকশা। সেদিন থেকে নাজিম হয়ে যায় রিকশাওয়ালা। এই বুঝি ছিল কপালের লিখন। নাজিমের এক ছেলে এক মেয়ে। অল্প বয়সে মেয়েটার বিয়ে হয়। স্বামী রিকশা চালক, ভালোই আছে মেয়েটা। নাজিমের ছেলে মনির খায় দায় ঘুরে বেড়ায়। পড়াশোনা করানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু হয়নি। নাজিম হাল ছেড়ে দেন। কিন্তু হাল একসময় ধরতে হয়, যখন মনির বিয়ে করে বউ নিয়ে হাজির হয়। নাজিম ছেলেকে নিয়ে যায় রিকশা গ্যারেজের মহাজনের কাছে। নাজিমের ছেলে মনির হয়ে ওঠে রিকশাওয়ালা।
রিকশা চালানো দারুণ পরিশ্রমের কাজ। পায়ের পেশিতে শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে প্যাডেলে চাপ দিতে হয়। দারুণ কষ্টকর কাজ। চৈত্রের তপ্ত রোদে ছেলের ঘরমাক্ত চেহারায় বিচলিত হয় পিতৃহৃদয়। ছেলের লাল হয়ে যাওয়া চেহারা দেখে নাজিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তিন প্রজন্মের লম্বা লাইন। মনে অনেক প্রশ্ন জাগে। জীবনের সূত্র মেলাতে চেষ্টা করে। তাঁর পিতা ছিল রিকশাচালক, সে রিকশাচালক, আর পুত্র সেও রিকশাচালক। তিন পুরুষের লম্বা লাইন। কপালে যেন সিলমোহর সাটা হয়ে গেছে। রিকশাচালক হওয়ার জন্যই কি তাদের জন্ম হয়। এক সময় দুঃখ থিতিয়ে আসে। মনের দুঃখ মনে চেপে জীবন পার করে দেয়া জনগোষ্ঠীর স্রোতে সামিল হয়।
নাজিম একদিন লক্ষ্য করে মোটরচালিত রিকশার দিকে। চালক বসে আছে রিকশা তরতরিয়ে এগিয়ে চলেছে। পরিচিতদের কাছে খোঁজখবর নিয়ে ওয়ার্কশপে যায় বিস্তারিত জানতে। ধার দেনা করে কিছু টাকা সংগ্রহ হলে রিকশা পরিবর্তন করে অটোরিকশা করতে পাঠায়। মনে মনে ভাবে, এখন দুঃসাহ কষ্টের কিছুটা লাঘব হবে। ছেলের জন্য এটুকু করতে পেরে তৃপ্তি বোধ করে নাজিম। ছেলেকে পাঠায় ওয়ার্কশপ থেকে রিকশা আনতে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ছেলে এবং রিকশা কিছুই আসে না। আসে এক নিষ্ঠুর দুঃসংবাদ। মনির ও তার রিকশা দ্রুতগামী এক ট্রাকের চাপায় পিষ্ট হয়ে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে। নাজিম পুত্র শোক বুকে নিয়ে রাতে রিকশা চালায়। ভাবে, তার বংশ রিকশাওয়ালা হবার ধারাবাহিকতা থেকে মুক্তি পেয়েছে।