একজন সাধারণ মানুষ ও একজন লেখকের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। কালের বিবর্তনে বদলে গেছে সময়, বদলে গেছে মানুষের চিন্তাধারা, বদলে গেছে নতুন প্রজন্মের মনোজগৎ, বদলে গেছে প্রচার-প্রচারণার ধরন। প্রচার প্রসারের জন্য মানুষ অনেক মাধ্যম অবলম্বন করে থাকে। সমাজ ও প্রচারণার ধরন সময়ের সঙ্গে পরির্বতনশীল। একবিংশ শতাব্দীতে তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে সমাজ ও প্রচারের বিকাশ খুব দ্রুতই ঘটছে; কিন্তু সে তুলনায় বইয়ের প্রচার ও প্রসারের অগ্রগতি কতটুকু হয়েছে। এ সময়ে এসেও লেখকরা নিজেদের বইয়ের প্রচার করতে লজ্জাবোধ করেন। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে- একজন লেখক সোশ্যাল মিডিয়ায় কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেন বা প্রচার ও প্রসার করার সক্ষমতা রাখেন- সে সর্ম্পকে তিনি তেমন একটা ধারণা রাখেন না। অথচ একজন লেখক নিজেই একটি ব্রান্ড। দরকার প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাওয়া। যুগের চাহিদা অনুযায়ী জানতে হয় প্রচার-প্রচারণার নানা কলাকৌশল। যে কোনো জিনিসের জন্যে প্রচার ও প্রসার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় আর সেটি যদি হয় নিজের প্রচার-প্রচারণা তাহলে তো কথাই নেই। যুগ যুগ ধরে মানুষ নিজের প্রচার ও প্রসারের জন্য কতকিছুই করে আসছে, করছে এবং করতে থাকবে। পত্রিকা, ম্যাগাজিন, ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব-এ নজর দিলেই আমরা দেখতে পাই কীভাবে চলছে প্রচার-প্রচারণা। নিজেকে মেলে ধরার অত্যন্ত কার্যকরী ও গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া।
প্রচার সর্বাধিক জনপ্রিয় হওয়ার মাধ্যম; কিন্তু প্রচারের প্রতিলিপির (ক্যাপশন) ওপর নির্ভর করে প্রচারের সফলতা। এদিক দিয়ে আমাদের লেখক সমাজ অনেকটা পিছিয়ে। জগতে এমন মানুষ খোঁজে পাওয়া খুবই মুশকিল যে বা যারা নিজেদের প্রচার-প্রসার চায় না। একজন পাঠকের কাছে ইমেজ সৃষ্টির মাধ্যমে পরোক্ষভাবে প্রসার কার্যক্রম চালানো অবশ্যই ইতিবাচক। একজন লেখক লেখেন তার লেখাটি প্রকাশ হওয়ার জন্য, পাঠকের কাছে তার লেখা বা বইটি পৌঁছে দেওয়ার জন্য। লেখক মনের অজান্তেই তার লেখার প্রচার কার্যক্রম চালিয়ে যান। আমি অনেক বড় বড় লেখকদের দেখেছি, ফেসবুকের মেসেঞ্জারে তার টার্গেকৃত পাঠকদের কাছে বইয়ের প্রচার করতে। লেখকরা কিন্তু মেসেঞ্জার প্রচারণায় বেশ সফল। একজন লেখক যখন সোশ্যাল মিডিয়ায় এসে লেখা ও ছবি পোস্ট করেন, কবিতা পাঠ করেন কিংবা সাহিত্য আড্ডা দেন তখন লেখকের জাত যায় না। অনেক লেখক মনে করেন- জাত তখন যায়, যখন কোনো লেখক পেশাদারিত্বেও বাইরে গিয়ে তার লেখা বা বইয়ের প্রচার কর্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন। আসলে এ সমস্যাটি হচ্ছে আমাদের সম্পূর্ণ মানসিক। আদি চিন্তাভাবনা থেকে যদি লেখকরা বের হয়ে না আসতে পারেন তাহলে যথা সময়ে তাদের লেখা পাঠকের কাছে পৌঁছাবে না। পাঠক যে শুধু বইমেলা থেকে বই কিনে এমনটি নয়। পাঠক প্রতিদিন কোনো না কোনো মাধ্যমে বই কিনে থাকে। তাই, লেখকদের বা বইয়ের প্রচার থাকা উচিত বছরব্যাপী। লেখা বা বইয়ের প্রচার লজ্জাকর নয়, এটি গর্বের ব্যাপার। একসময় লেখা পত্রিকা বা ম্যাগাজিন ছাড়া তেমন একটি প্রকাশ করার মাধ্যম ছিল না এখন কিন্তু তা নয়। ইচ্ছা করলেই লেখা প্রকাশ করা যায়। লেখকদের এ বিষয়টি মাথায় রেখে পাঠকদের কাছে তার লেখা পৌঁছে দেয়ার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। আমাদের দেশের প্রকাশনা শিল্প বেশ এগিয়েছে; কিন্তু নানা ধরনের সীমাবদ্ধতার কারণে যুগের চাহিদা অনুযায়ী অধিকাংশ প্রকাশনী যেভাবে একটি বইয়ের প্রচার বা প্রসার করা উচিত তা তারা পেরে ওঠছে না। যেহেতু প্রকাশনাগুলো যথাযথভাবে বই প্রচারণা করতে পারছে না। তাই, বই প্রচারণায় লেখদের এগিয়ে আসতেই হবে। নিঃসন্দেহে, এক একজন লেখক এক একটি মডেল। আমাদের দেশে অনেক লেখক আছেন যারা বই প্রকাশের মাধ্য দিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভোগেন। তারা কী কখনো ভেবে দেখেছেন- প্রায় ১৭ কোটি মানুষের দেশে তার প্রকাশিত বইটি ১৭ লাখ কপি বিক্রি হয়েছে কি না? নিজের বই নিজে কিনে বেস্ট সেলার বই বানানের স্বার্থকতা কোথায়? অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন আমার বই পাঠকরা খোঁজে খোঁজে বের করে পড়বে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে এমন চিন্তাভাবনা মনে পোষণ করা একেবারেই অবান্তর। কোটি কোটি মানুষের দেশে ২৫০ কপি কিংবা ২৫০০ কপি বই বিক্রি করে আত্মতুষ্টিতে ভোগা কতটুকু সমীচীন। সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকে মানুষ তার ব্র্যান্ডিং-এর জন্য অবলম্বন করেছে নানা কৌশল। একটি বিষয় মাথায় রেখে প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে আর তা হলো- অপরিপক্ক লেখা দিয়ে প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে হয়তো পাঠককে একবার একটি বই ধরিয়ে দেওয়া যায় বা যাবে; কিন্তু সে পাঠককে আপনি সারাজীবনের জন্য হারালেন। সুতরাং মানসম্মত লেখা বা পাঠযোগ্য লেখার কোনো বিকল্প নেই। মৌসুমী লেখক বা খৈ ভাজা লেখকদের লেখা হারিয়ে যাবে কালের গহ্বরে। ভালো লেখার জয় সবসময়। বাস্তব সত্য মেনে নিতেই হবে- একজন লেখক তার লেখা বা নিজেকে প্রচার-প্রসারের জন্য অনেক কিছুই করেন। যে বা যারা বিষয়টি অস্বীকার করেন- তারা অবশ্যই অসুস্থ। আমি প্রচার বিমুখ- বাক্যটি লিখে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা; কিন্তু প্রচার। সবচেয়ে আশার কথা হচ্ছে- ধীরে ধীরে লেখকদের লজ্জা ভাঙছে এমনকি কিছুকিছু লেখক তাদের নিয়োগকৃত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মাধ্যমে তাদের লেখা ও বইয়ের প্রচার-প্রচারণার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। বই বাণিজ্যিকীকরণের প্রথম ধাপ হচ্ছে- বইয়ের প্রিপেইড অর্ডার। তাই আসুন, নিজের লেখা বা বই প্রচার করি, প্রসার করি, ভালো লেখার শপথ করি, সময়ের সঙ্গে এগিয়ে চলি।