ঢাকা ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৬ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নাট্যোপন্যাস (পর্ব ৬)

রাজাবলি

ড. মুকিদ চৌধুরী
রাজাবলি

সত্যবতী আস্তে আস্তে বললেন, মা, এমনটা তো হওয়ার কথা নয়! নারীজাতি আমরা, অন্যের ঘরে যেতেই হয়। তুষের আগুনে অহরহ শুধু বুক পোড়ে মা, দেবতারও সাধ্য নেই এই আগুন নেভানোর। আমাদের জীবন হচ্ছে অতৃপ্ত বাসনা, কামনা, বঞ্চনা আর লাঞ্ছনার ইতিহাস। অন্তরের এই কষ্টকে যদি সংহত করে তেজ সৃষ্টি করা যায়, তাহলে এই আগুন নিভিয়ে মনকে শান্ত করা সম্ভব।

সত্যবতীর কথায় দময়ন্তীর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকে। সত্যবতীর কথার মর্মার্থ কী তা শোনে। সে কীভাবে এখন তাকে চুপ করে থাকতে হবে, এখন নিজেকে নিশ্চুপ রাখাই উচিত! না, সে তা পারে না। নিজের জীবনকে বুঝে নিতে চায় না বলেই কি এমনটা করছে? নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল : তুমি কী বলছ, আমি তার কিছুই বুঝতে পারছি না! তোমার কথায় আমার ভীষণ শঙ্কা জাগছে।

দময়ন্তীর কথায় হৃদয়ের তলা থেকে যেন ধাক্কা খেয়ে উঠে আসছে কী একটা- এটি কি কেবলই অন্ধকার, নাকি আবছায়া! পায়ের পাতায় একটু চাপ দিয়ে একটু শূন্যে উঠে সত্যবতী বললেন : এতে শঙ্কিত হওয়ার কিছুই নেই মা। তোর চোখ এত জ্বলজ্বল করছে কেন? চোখে ও কীসের বহ্নি?

হঠাৎ ভেতর থেকে গরম জল উঠে আসে দময়ন্তীর দুই চোখে। সে হাঁটুর ওপর মুখ রেখে বয়ে যেতে দেয় নুনের নদী। পরক্ষণে, চমকে মুখ তুলে বলল : মা, আমার জীবনের সবকিছু ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে।

কথাটির গুরুত্ব ভীষণ। এর ওপরে আর কী কথা চলতে পারে! কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন সত্যবতী, তারপর আস্তে বললেন, তা-ই তো বটে। এখন আর কথা নয়, আহার সাজানোর কাজ শেষ কর।

সত্যবতী আর কোনো কথা না বলেই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। রাত্রের আহারের পর সত্যবতী যখন পান নিয়ে রঘুপতির ঘরে এলেন তখনও নিজের মনটাকে স্থির করতে পারেননি। রঘুপতির দিকে ভালোভাবে তাকাতেও পারছেন না। রঘুপতির প্রতি শুভ ও মঙ্গল কামনার পরিবর্তে অশুভ ও অনিষ্ট চিন্তাসমূহই তার মনে উদয় হতে থাকে। মনে পড়ছে রঘুপতির অনুদারতা, স্বভাবের উদাসীনতা, কাঠিন্য। ক্ষোভ, দুঃখ, বিতৃষ্ণা, অভিমানের যন্ত্রণা, বঞ্চনা- এসবই হৃদয়ের কোণে জেগে উঠেছে। এসবের প্রতিরোধের স্বপ্নেই তার মন বিদ্রোহ করতে চাইছে। কী হবে মন্দির করে, নিত্যপুজো করে, যদি একজন মাকে রঘুপতি অবহেলা করতে থাকেন!

অনেকক্ষণ সত্যবতীকে চুপ করে থাকতে দেখে দায়হীন, দয়াহীন রঘুপতি বললেন : তোমার বুকের আগুনে তুমি জ্বলছ। এই দৃশ্য আমি সহ্য করতে পারছি না। তোমার মন অশান্ত কেন? উত্তেজনায় প্রমত্ত, অস্থির, উদ্ভ্রান্ত। তুমি আজ প্রকৃতিস্থ নও। প্রগল্ভতা তোমাকে পেয়ে বসেছে।

রঘুপতির কথায় সত্যবতীর মধ্যে কোনও বিস্ফোরণ ঘটেনি। একটা হিমস্রোত বয়ে যাচ্ছে। সত্যবতী একবার কেমন জড়িত অদ্ভুত গলায় বলে উঠলেন, এসব তোমার ভ্রান্ত চিন্তা।

সত্যবতী খোলা জানালার দিকে সরে গেলেন। তারপর অন্ধকার গোমতীর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। অবিরাম জলভাঙার শব্দ তার কানে এসে পৌঁছতে লাগল। সত্যবতীর উদাস অন্যমনস্কতায় কোনওরকম বিঘ্ন না ঘটিয়েই রঘুপতি চমকানো বিস্ময়ে উচ্চারণ করলেন : সত্যবতী! এই শব্দটি উচ্চারণ করেই সত্যবতীর মাথায় তার একটি হাত রাখলেন। খুবই উত্তেজিত দেখাচ্ছে তাকে। দুই চোখে মায়া।

সত্যবতী স্থির স্বরে বললেন, কষ্ট কি সামান্য বস্তু? কিন্তু কষ্ট মানুষকে শক্তি জোগায়, তেজ দেয়, বীরত্ব অর্পণ করে। সে-ই সত্যিকারের মানুষ, যার অন্তরে জেদ সৃষ্টি হয়।

সত্যবতী তার বুকের বাঁ-দিকটায় একরকম অবোধ যন্ত্রণা অনুভব করছেন। এক অবসন্ন ক্লান্তি ও বিরামহীন শ্রান্তি বোধ করছেন। আর রঘুপতি বোবা বিস্ময়ে গোমতী নদীর দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকেন। পরিবেশটি বিষণ্ণতায় থমথমে হয়ে আছে। নিস্তব্ধতা গভীরতর। সত্যবতীর গভীর অভ্যন্তরের কথা এই অন্ধকারাচ্ছন্ন বাতাসের স্বরেই প্রকাশ পাচ্ছে। মরা মাছের মতো চোখ দুটি ন্যস্ত করে রঘুপতি বিড়বিড় করে বলে উঠলেন, জেদের কারণেই কি তুমি এখানে রয়েছ?

ভেতরে ভেতরে সত্যবতী ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন, একটা আকস্মিক আলোড়নের মতো। এখানে যে তিনি আছেন, এই আশ্রম, এই ঘর মনে হচ্ছে তার নয়। তিনি হঠাৎ একটু দিশেহারা বোধ করলেন। নিঃশব্দে একটি আর্তনাদ উঠে এল তার কণ্ঠে, অকস্মাৎ বললেন : না, না, তা নয়; কিন্তু এই আশ্রমটি আমার জীবনের এক অভিশাপ। কীসের আশায়, কীসের মায়ায় আশ্রমটি আগলে রেখেছি তা বলতে পারো?

যদিও সত্যবতীর ব্যক্তিত্ব, মনীষা ও বুদ্ধির এমন দীপ্তি আর কখনও রঘুপতির চোখে পড়েনি, তবুও একমুহূর্তের মধ্যে তার মুখে একটি বিষাদ ঘনিয়ে এল। অন্তরে ঈষৎ চাপল্য বিস্তারিত করে রঘুপতি বলেছেন : না। কেন?

একটি অভিমান সিঁথিচিহ্নের মতো সত্যবতীর অন্তরকে বিদারিত করে চলেছে। এই আশ্রমের রূপ আর আগের মতো মনে হচ্ছে না। সব কেমন শাদা হয়ে যাচ্ছে। নিঝুম, খাঁ-খাঁ গ্রীষ্মের দুপুরের মতো ছাই-ছাই মনে হচ্ছে। সময় যত অতিবাহিত হচ্ছে, এই অভিমান অন্তরে শুকনো পাতার মতো ঝরতে থাকে। অন্তরে এই শুকনো ঝরা-পাতার শব্দ শুনতে শুনতেই সত্যবতী বললেন, তোমার জন্য। তোমার প্রতি এক অদ্ভুত ভালোবাসা ও মোহ নিয়ে আমি এতকাল এখানেই কাটিয়ে দিলাম।

রঘুপতি একটু মৃদু হাসলেন। তার মুখে ফুটে ওঠা যে-হাসি দেখলেন সত্যবতী, তা হাসি নয়। তার কাছে রঘুপতি এক অবিশ্বাসের অস্তিত্ব বলে মনে হচ্ছে। তার হাসি আর প্রথম দর্শনের মতো নেই, সেই-যে ফুরিয়ে গেল, আর ফিরল না। তিনি যখন মন্ত্রের বই বের করে, ঘরের কোণে বসে আসন বিছিয়ে, মানে-না-জানা মন্ত্র একটার-পর-একটা পড়ে যান, তখনই কেবল সত্যবতী কিছুক্ষণের জন্য রঘুপতির শান্ত, বিশ্বাসী, সমর্পিত রূপটি দেখতে পান।

রঘুপতির দৃষ্টি সত্যবতীর ওপর, সর্বাঙ্গ কঠিন, তার চেনা-চির পরিচিত- সত্যবতী হঠাৎ পাষাণ-মূর্তি ধারণ করেছেন। তিনি স্তব্ধ, বিবিক্ত, নিস্তরঙ্গ, মূক। তিনি যেখানে আছেন, সেখানে তিনি আসলে নেই, স্পষ্ট বুঝতে পারছেন রঘুপতি, প্রদীপের ম্রিয়মাণ শিখাও এটি ধরিয়ে দিচ্ছে। আস্তে আস্তে উচ্চারণ করলেন : বিধাতা তোমাকে দিয়ে তার কোন্ কাজ সেরে নিতে চাইছেন, তা কে জানে!

পলকে আরো ফ্যাকাশে, উঠোনের স্তূপাকার পাতাগুলোর মতো দেখাচ্ছে সত্যবতীর মুখ। কেমন অপরিচিত স্বরে বললেন : তাই বলে কি এত দুঃখ, এত গ্লানি আমাকে ভোগ করতে হবে?

রঘুপতি স্বীকারোক্তি করলেন সান্ত¡নার স্বরে, কথাগুলো আঙুলে প্রলেপ দিতে দিতে বললেন : আমি তো নিজের মায়ায় এই সংসারে জড়িয়ে আছি। বরং তুমিই আমার জন্য- কেন, কেন সত্যবতী, তোমাকে তো কিছু দিতে পারিনি। তুমি শুধু দিয়েই গেলে। একটি ফোঁটাও কখনও পাওনি। তাই বলে কি দুঃখ আর গ্লানি বলবে? তোমাকে নিয়ে তো আমি বেশ সুখে আছি। আমার এই সুখ দস্যুর মতো ছিনিয়ে নিয়ো না। উলটপালট করে দিয়ো না আমার জীবনটাকে। তুমি আমার জীবনে পূর্ণিমার চাঁদ। সে-যে কত শান্তি, তা বলে বোঝানো যাবে না।

একথা বলে রঘুপতি অনিমেষ তাকিয়ে রইলেন সত্যবতীর দিকে। সত্যবতীর ভঙ্গিতে একটা ঘূর্ণির ছন্দ না-থাকুক, তার দিব্যদ্যুতি এত কোমল, এত অপরূপ, এত সলজ্জ হতে পারে তা রঘুপতি জানতেন না। সলজ্জ সৌন্দর্য প্রবল মায়ায় তাকে কাছে টানছে, তৃষ্ণার্তের মতো সত্যবতীর সৌন্দর্যের ঘ্রাণ পান করে চললেন, শুষে নিতে চাইলেন তাকে, তার সত্তাকে। তবুও সত্যবতীর মধ্যে কোথায় নিহিত রয়েছে- একটা অলজ্জতা, যা রঘুপতিকে তেতো করে দিচ্ছে। কৃপণ-কৃচ্ছ্র, নীরব নিস্পৃহতা- এই বৈপরীত্য পছন্দ হচ্ছে না রঘুপতির। তার খোঁচা-খোঁচা ভাবটি কোনও কথা প্রকাশ করতে দিল না, বরং সবকিছু ধুয়েমুছে নিয়ে যাচ্ছে, একটু কমনীয়, একটু ক্লান্তিও। রঘুপতি নিরীক্ষণ করে চলেছেন সত্যবতীকে, তিনি পরীক্ষক, সাবধান, সচেতন।

গলায় আঁচল ফিরিয়ে খুব চিন্তিতভাবে সত্যবতী দুই হাত জড়ো করে, তার ওপর থুতনির ভর রেখে শূন্যচোখে তাকিয়ে রইলেন কুণ্ঠিত, বিসদৃশ চেহারার রঘুপতির দিকে। চোখ স্মৃতি-ভারাক্রান্ত। বহুকাল আগের একটি দৃশ্য এখনও তার চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে।

জবাফুলের ঝাড়ের সঙ্গে মিশে একের-পর-এক নিশ্বাস নিঃশব্দ হতে থাকে, কিন্তু সত্যবতী শয্যা গ্রহণ করলেও, চোখ দুটি বন্ধ থাকলেও, সেই দৃশ্যটি তার মন থেকে সরতে চায় না। তিনি খুব ক্লান্ত, তাই থেমে-থেমে বুক ভরে বাতাস নিতে থাকেন। কী-রকম করুণ একটা ছায়া তার মুখে ছড়িয়ে আছে। চারপাশের সবকিছু চুপচাপ, নিথর। মায়াবী মনোরম অন্ধকার। আগাগোড়া মুড়ি দিয়ে প্রকৃতি নিদ্রায় আপ্লুত। কিন্তু সত্যবতীর চোখে কোনও ঘুম নেই। সেই দৃশ্যটিই তার চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। মনে হচ্ছে : হায়, সব ভুলতে পারাই ভালো, সব ভুলতেই হয়! অনুধ্যায়ী কোনো সুহৃদ বলে দিচ্ছে যে, শ্রদ্ধায় যার সঙ্গে যুক্ত হতে পারো না, তার সঙ্গে ঘৃণায়ই বা যুক্ত থাকবে কেন- এইসব কথা, মনের ধাঁচধরন সব বদলে দিচ্ছে।

প্রত্যুষে হস্তপদ প্রক্ষালনের পর, সজ্ঞানে ‘মা’কে দু-একটি পুষ্প নিবেদন করার জন্য একদিন ভুবনেশ্বরী মন্দিরে এসে উপস্থিত হন সত্যবতী। আত্মোন্মোচন- না, উন্মোচন নয়, শুধু নিজেকে মোচন- তাপে-সন্তাপে যুবতি বয়সের হিমঋতুতে নিজের আত্মাকে সেঁকে নেওয়া। তিনি অনুভব করেন, মায়ের প্রতি অদৃশ্য অমোঘ এক ভক্তি। গুনগুন করে সুর ভাঁজতে ভাঁজতে নির্জন বাতাসে শাড়ির আঁচল ও চুল উড়িয়ে যুবতি সত্যবতী ভুবনেশ্বরী মন্দিরের উদ্যানে এসে দাঁড়ান। তিনি অসাধারণ, অসামান্য, অপার্থিব রূপসী। তার দুর্লভ রূপ- তাতে কোনও দ্বিমত নেই। হাতের একরাশ চাঁপা-কাঞ্চন-অশোক-নবমল্লিকার মালা বাতাসকে করে তোলে সুগন্ধ। তখনই রঘুপতির লুব্ধ দুই চোখ যুবতি সত্যবতীর ভরা যৌবনের রূপ দেখে চমকে ওঠে, মন্দিরের আর্যদ্বার থেকে। শুধু আয়ত নীল পদ্মপলাশের মতো চোখ দুটিতেই নয়- সুকুমার চারু ললাটের ভঙ্গিতেও স্থির তীক্ষè বুদ্ধির প্রকাশ- একইসঙ্গে কর্তৃত্ব করার, মানুষকে পরিচালন করার সহজাত শক্তি প্রকাশ পায়। এই যুবতি শুধু মানবী নয়, দেবীও নয়- এ আরও অনেক কিছু, অন্য কিছু। কোনও পরিচিত বিশেষণে একে বিশেষিত করা যায় না, কোনও বিশেষ বর্ণনায় একে ব্যঞ্জিত করা যায় না। যুবতি সত্যবতীর নিটোল সুঠাম দেহকান্তি, উন্নত বক্ষের দিকে রঘুপতির দৃষ্টি আঠাকাঠির মতো লেপটে থাকে। তিনি কিছুতেই তার দৃষ্টি ফেরাতে পারেননি। উদ্যানে মুক্তবিচরণের সময় সত্যবতীর শরীর- পেশি, বক্ষ, জঙ্ঘা, নিতম্ব- নানা ছন্দে হিল্লোলিত হতে থাকে। গোমতীর হিল্লোলিত তরঙ্গের মতো তার স্তন, কটি, জঙ্ঘা, পদদ্বয় নৃত্য ছন্দে আন্দোলিত ও আবর্তিত হতে থাকে। রঘুপতির মনের কোনও-এক প্রত্যন্ত প্রদেশে একমুহূর্তের জন্য একটা হতাশা-ঈর্ষা মিশ্রিত ঈপ্সা জেগে ওঠে। ভাবতে থাকেন : এই যুবতিকে যদি একান্ত করে পাওয়া যায়, উপযুক্ত জীবনসঙ্গিনী করা যায়- সিংহের সিংহিনী রূপে! এই যুবতি কেবল বিলাসসহচরীসঙ্গিনীই হবে না, তাকে পাশে পেলে উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য অন্য নারীকে আর খুঁজতেও হবে না।

যুবতি সত্যবতীর ভুবনেশ্বরী মন্দিরের উদ্যানে বিচরণের দৃশ্যটি রঘুপতির বুকের মধ্যে এক অবোধ রহস্যময় অনুভূতি সৃষ্টি করে। সমীরণ যেমন গোমতী নদীকে প্রতিমুহূর্ত আলিঙ্গন করে তেমনই এক মিলনের আর্তি জেগে ওঠে রঘুপতির দেহে। সমগ্র শরীরে উ”ছ¡সিত রক্ত অসহ্য তাপে অস্থির হয়ে বইতে থাকে শিরায়, উপশিরায়। কালবৈশাখীর ঝড় সৃষ্টি হয় তার বক্ষে। ভয়ানক উত্তেজনা। তাকে পৌঁছে দেয় এই যাবৎকালে তার দেহের অচেনা এক গভীর উপলব্ধিতে। নিজের যে একটি রক্তমাংসের দেহ আছে একথা চোন্তাই জানতেন না, যা জানতেন তা ছিল শুধু নিদিধ্যাসন। তিনি এই ক্ষুব্ধ উত্তেজিত শরীরটি নিয়ে কী করবেন, ভেবে পাননি। শুধু অনুভব করেন- তার দেহটা সব শাসনসংযমের বাধা ভেঙে গোমতীর স্রোতের মতো বর্বর হয়ে উঠছে। বেশিক্ষণ তিনি আর স্থির থাকতে পারেননি। পলককালের মধ্যেই মনের গতি বৃদ্ধি পেতে থাকে। চিত্তকে সংযত করে আর প্রকৃতিস্থ হতে পারেননি তিনি। অকস্মাৎ ছুটে যান যুবতি সত্যবতীর কাছে।

সত্যবতীকে ভাবার অবসর না দিয়ে নিবিড় বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে নেন রঘুপতি। বিম্বাধরের মতো ওষ্ঠদ্বয়ের ওপর এঁকে দেন এক চুম্বন। অনন্তর উদ্গত নিশ্বাস বুকে ধারণ করে যুবতির চোখে চোখ রাখেন। সারা অঙ্গে আঙুলগুলো কামপোকার মতো চরে বেড়ায়। সমস্ত দেহজুড়ে তার অদ্ভুত শিহরন সৃষ্টি হয়, ভালোলাগারই আবেশ। যুবতির চেতনা ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়, যদিও বাধা দেওয়ার মতো তার শক্তি ছিল না।

দুটি বিপরীত রক্তমাংস-দেহের সংস্পর্শে শরীর ও হৃদয়জুড়ে বেজে ওঠে কামসংগীত। রঘুপতির মনে হয়, জীবনের চরম প্রাপ্তি ও পরম নিবৃত্তি এই যুবতিতে। এতদিন তিনি জীবনকে ফাঁকি দিয়ে বৃথাই মোক্ষ খুঁজছিলেন। এখন যুবতি সত্যবতীই তার কাছে হয়ে ওঠেন তার জীবনসর্বস্ব। তাকে গ্রহণ করে চরিতার্থ করার জন্য তিনি যুবতি সত্যবতীকে মন্দিরে এনে, তার হৃদয় করেন সমর্পণ। রঘুপতির আহ্বানে যুবতির বুক কেঁপে ওঠে, একরকম উদ্ভ্রান্ত উত্তেজনায়। বারংবার শিহরিত হতে থাকে সর্বাঙ্গ। মুগ্ধতা, কাম, তীব্র আকর্ষণে বিভোর তন্ময়তায় তাকে পেয়ে বসে। বুদ্ধিভ্রংশ হয়ে পড়ে তার। একটি ঘনশ্বাস ছেড়ে আবেগমথিত স্বরে যুবতি সত্যবতী বলেন : আপনার প্রার্থনা উপেক্ষা করার সাহস আমার নেই। আপনি আমাকে সম্মোহিত করেছেন। (চলবে)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত