ঢাকা ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৬ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বিজয় পতাকা

ফারুক আহম্মেদ জীবন
বিজয় পতাকা

স্বজল আর কাজলের তিন ছেলেমেয়ে। ছেলেটা বড় নাম জিতু। মেয়ে মিনা মেজো, আর ছোট মেয়ের নাম মিতু। তিন ভাই বোনের মধ্যে জিতুর বয়স দশ। মিনার সাত, আর মিতুর বয়স চার বছর চলছে। মিতু এখনো স্কুলে যাওয়ার মতো হয়নি। জিতু প্রাইমারিতে পঞ্চম শ্রেণীতে আর তার ছোট বোন মিনা তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ছে। আগামীকালকে জিতু, আর মিনাদের স্কুলে ১৬ ডিসেম্বর উপলক্ষে বিজয় দিবস পালিত হবে। রাতে পড়তে বসেছে ওরা। পাশে বসে তসবিহ পড়ছিল ওদের বৃদ্ধা দাদিমা মমতা বেগম। রান্না-ঘরে বসে রান্না করছিল ওদের মা কাজল। বাবা এখনো বাজার থেকে বাড়ি ফেরেনি। ওদের বাবা স্বজলের বাজারে ছেট একটা হোটেল রয়েছে। সবার ছোট মিতু কিছুক্ষণ আগে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ওরা দু’ভাইবোন পড়ার ফাঁকে কবি ফারুক আহম্মেদ জীবন এর কালজয়ী কবিতার বইয়ের একটা কবিতা স্বাধীন পতাকা ‘গানের সুর করে আস্তে আস্তে গুনগুন করে গাইছিল...তুরা, লাল সবুজের পতাকা ঐ/ আকাশ পানে তোল.../পরাধীনতার কোনো আজ আর/ নেই পায়ে শিকল।/ দাসত্বের যতো বেড়াজাল সব/ বাঙালী দেছে ছিঁড়ে.../ তুরা, স্বাধীনভাবে পতাকা উড়া/ বাংলার গগনজুড়ে।/ করবে না কেউ শাসন বারণ/ রাখবে না কেউ ধরে.../ মুক্ত মনে উড় তাই তুরা সবাই/ এবার পেখম ঝেড়ে।/ আজ, বিশ্বের মানচিত্রে আমরা/ একটা স্বাধীন জাতি.../ ডানা মেলা উড়তে থাকা সব ঐ/ যেমন মুক্ত প্রজাপতি।

ওদের দাদিমা এতক্ষণ নিরবে শুনছিল। তারপর জিজ্ঞাসা করলো কি ব্যাপার, তোমরা পড়া রেখে গান গাইছ কেনো দাদু ভাইয়েরা? জিতু বললো...দাদিমা আগামীকাল আমাদের স্কুলে ১৬ই-ডিসেম্বর উপলক্ষে বিজয় দিবস পালিত হবে তো। তাই বিজয় দিবস নিয়ে একটা কবিতা গানের সুরে গাইছিলাম। মিনা জিজ্ঞাসা করলো আচ্ছা দাদিমা..১৬ ডিসেম্বর কি? এদিনে আমরা বিজয় দিবস পালন করি কেনো? মমতা বেগম বললো... সে অনেক কথা। তাহলে বলছি শোনো দাদু ভাইয়েরা। বহু বছর আগে ভারত, বাংলাদেশ, আর পাকিস্তান। এই তিনটা দেশ যখন একটাই মাত্র দেশ ছিল। তখন নবাব আলীবর্দি খাঁর নাতি সিরাজউদ্দৗলা ছিল দেশের নবাব। তার নিকট আত্মীয়রা যেমন, মীরজাফর, মিরন, খালা ঘোঁসাটি বেগম এরকম কিছু লোকজন। ব্রিটিশদের সাথে হাত মিলিয়ে বিশ্বাস ঘাতকতা করে ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত করে নবাব সিরাজউদ্দৗলাকে। এ পর্যন্ত বলেই...মমতা বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে. সেসব অনেক করুণ কাহিনি দাদু ভাইয়েরা। তোমরা যখন বড় হয়ে উপরের ক্লাসের ইতিহাসের বইপুস্তক পড়বে। তখন সবকিছু জানতে পারবে। যেকথা বলছিলাম আমি তারপর এদেশটা চলে গিয়েছিল ব্রিটিশ শাসকদের হাতে। তারা প্রায় দুই-শো বছর রাজত্ব চালিয়েছিল এদেশে। তারা এদেশের মানুষের উপর রাজস্ব কর আদায় থেকে শুরু করে।

অন্যায়ভাবে নানান রকম নির্যাতন নিপীড়ন বর্বরতা শুরু করে। তাদের সেই অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে অবশেষে এদেশের মানুষ প্রতিবাদী মুখর হয়ে উঠে। অনেক সংগ্রাম, সংঘাত করতে হয় এদেশের মানুষদের। তিতুমীরের মত বহু সাহসী বীর পুরুষদের জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছে। অবশেষে ব্রিটিশরা এদেশের মানুষের তোপের মুখে পড়ে এদেশ ছাড়তে বাধ্য হয়, তখন ১৯৪৭ সাল। এই সুযোগে ভারতিরা বিভক্তি হয়ে তারা আলাদা দেশ গঠন করে। আর আমাদের এদেশ তখন পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দু ভাষার খানেদের সঙ্গে রয়ে যায়। পাকিস্তানের খানেরাই ছিল, তখন এদেশের হর্তাকর্তা শাসক। তারা শাসকের মসনদে বসে রীতিমতো শোষণ করতে শুরু করে দিল এদেশ। এদেশের মানুষের উপর। চাকরিবাকরি শিক্ষা থেকে শুরু করে।

পূর্ব বাংলার বাঙালিদের কোনো কিছুতে অধিকার ছিল না, তখন একপর্যায়ে তারা জোর করে এদেশের বাঙালিদের উপর তাদের উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার জন্য পাঁয়তারা শুরু করে। কল্পনা করে বলতে থাকে...তখন তার প্রতিবাদে ১৯৫২ সালে পূর্ব বাংলার ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক শ্রমিক, সাধারণ জনতা। সকলেই পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠীর গড়া আইন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাজপথে নামে ভাষা আন্দোলনের জন্য। সে আন্দোলনে খান সৈন্যদের ছুঁড়া তপ্ত বুলেটে রফিক শফিক, সালাম, জব্বার, বরকত এমন অনেকেই শহীদ হয়। এভাবে বাঙালিদের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানিদের সংঘাতের পর সংঘাত লেগেই থাকে। এরপর অসহোগ আন্দোলন শুরু করল বাঙালি। ১৯৬৬ সালে তখনকার পূর্ব বাংলার নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের নেতৃত্বে ছয়দফা দাবি পেশ করা হলো। আগরতলা ষড়যন্ত্রের মামলা হলো বঙ্গবন্ধুসহ, বাঙালি কয়েকজন নেতার নামে। তারপর ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থান ঘটল। পাকিস্তানিদেও সাথে বিরোধ ধীরে ধীরে আরো ভয়ংকর রূপ নিতে লাগল। তখন ১৯৭১ সাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সকল বাঙালিদের একত্রিত করে ঢাকা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল জনসমাবেশে সকল বাঙালিদের যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে বলে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দিল। এর কিছুদিন পর ২৫ মার্চ গভীর রাতে ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে ওরা পাকিস্তানে নিয়ে চলে যায়। ঐ রাতেই পাকিস্তানি সৈন্যরা ঢাকার ক্যান্টনমেন্টসহ বিভিন্ন জায়গায় অতর্কিত হামলা চালায় নিরীহ ঘুমন্ত বাঙালিদের উপর। বহু বাঙালি মারা যায় সে রাতে। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে। সারা পূর্ব বাংলাজুড়ে যুদ্ধের ডামাডোল বেজে ওঠে। তখন বাঙালি নওজোয়ান পুরুষ-নারী, কিশোর-কিশোরী যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সুদীর্ঘ ৯ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে। অবশেষে খান সেনারা পরাজিত হয়ে ১৬ ডিসেম্বর অস্ত্রসহ আর্তসমার্পণ করে। আর সেদিন বাঙালিরা যুদ্ধে বিজয় লাভ করে। শুনে মিনা বললো...ও...এজন্য এই ১৬ ডিসেম্বরে আমরা বিজয় দিবস পালন করি দাদিমা? মমতা বেগম বললো...হুম, দিদি ভাই। জিতু বললো...আচ্ছা দাদিমা...আমাদের পতাকার চারপাশে সবুজ আর মাঝখানে টকটকে লাল কেনো? মমতা বেগম বললো...খুব সুন্দর প্রশ্ন করেছ দাদু ভাই। শোনো... আমাদের বাংলাদেশ সবুজের দেশ। এদেশের ভূখণ্ডে সেই যুদ্ধে প্রায় ত্রিশ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছিল।

দুই লক্ষ্য মা-বোন তাদের সম্ভ্রম হারিয়ে ছিল। একসাগর পরিমাণ তাদের বুকের তাজা লাল রক্তে এই মাটি ভিজে গিয়েছিল। সে জন্য আমাদের পতাকার পুরো চারিদিকটা সবুজ আর মাঝখানে গাঢ় টকটকে রক্তের মতো লাল। বুঝলে দাদু ভাইয়েরা? জিতু, মিনা বললো...হুম। দাদিমা এবার বুঝলাম কেনো আমাদের পতাকার। রঙটা এমন। ওই রঙটাই আমাদের স্বাধীনতা আর বিজয়ের চিহ্ন। মমতা বেগম বললো...এইতো আমার দাদু ভাইয়েরা এবার বুঝতে পেরেছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত