ঢাকা ০৫ জানুয়ারি ২০২৫, ২১ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নাট্যোপন্যাস (পর্ব ৭)

রাজাবলি

ড. মুকিদ চৌধুরী
রাজাবলি

তৃষিত সৃক্কণী, মেঘাবৃত অশনি সূর্যোদয় হতে-না-হতেই রাজপুরী জেগে উঠল। মহারাজ জাগলেন, রাজপরিবার ও রাজপরিজন জাগল। রাজভ্রাতা নক্ষত্ররায় তন্দ্রালস্য ত্যাগ করতে অবশ্য নারাজ। সাধারণত রাত্রি প্রভাত হওয়ার পরও বহুক্ষণ, প্রায় তিন-চার দণ্ডকাল কোনও কিছু লক্ষ্য করার মতো অবস্থা থাকে না তার। থাকার কথাও নয়। রাত্রে যে-পরিমাণ সোমরস তিনি উদারস্থ করেন, তাতে অপর কোনও সামান্য ব্যক্তি হলে দিনকয়েক হয়তো অচৈতন্য হয়ে থাকতে হতো। রাজভ্রাতা নক্ষত্ররায়ের তেমন কোনও বৈলক্ষণ্যই দেখা যায় না, শুধু একটু আত্মস্থ’ হয়ে থাকেন মাত্র, তখন জেগে আছেন বা নিদ্রিত হয়ে পড়েছেন- বোঝা যায় না; তবে গত রাত্রি তিনি ঘুমোতে পারেননি। মগজের মধ্যে সূক্ষ্ম একটা তার পিড়িং পিড়িং করে কেঁপে গেছে। শিউরে শিউরে উঠেছে রগের কাছটি। তাই তিনি ধারণ করে আছেন তন্দ্রালস্যের মূর্তিটি। কিছুক্ষণ পরে সহজ দৃষ্টি মেলে চারদিক দেখে নিলেন। কোনও কিছু অনাচার বা অনিয়ম দেখলে তিনি অবশ্য ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন, সহজ জীবনযাত্রার লক্ষণে প্রসন্ন হন। আজও তাকে অগণিত রথচক্রের ঘর্ঘরধ্বনি, অশ্বের হ্রেষারব, ভারবাহী অশ্বতরদের অসহিষ্ণু ক্ষুরনিক্ষেপ ক্রুদ্ধ করে তোলে। তন্দ্রার জড়তা কাটার পর, তার প্রাতঃকৃত্য, তৈলমর্দন, স্নানাদি চলে সাধারণভাবেই- অভ্যাসের পথ ধরেই।

রাজভ্রাতা নক্ষত্ররায়, অবশেষে, ভুবনেশ্বরী মন্দিরে এসে উপস্থিত হলেন পড়ন্ত সকালে। রঘুপতির দিক থেকে আদর-আপ্যায়ন-সমাদরের কোনো ত্রুটি নেই। অভ্যর্থনার ভার নিয়েছে স্বয়ং পুষ্কর। সে সসম্ভ্রমে দুই কর যুক্ত করল। নক্ষত্ররায়ের গতি স্থগিত হল না, তবে তিনি চকিত হাসিতে ঠোঁটদ্বয় ঈষৎ উন্মোচিত করলেন। রঘুপতি কিন্তু হাসলেন না, তার মুখখানি রক্তসঞ্চারে একটু উত্তপ্ত মাত্র; আর তার হৃৎপিণ্ড ক্ষণিকের জন্য দুরুদুরু করতে থাকে। আর্যের জয় হোক। খুব নিরীহ ভালোমানুষের মতো এরকম স্বস্তিবাচন উচ্চরণ করলেন চোন্তাই রঘুপতি। রঘুপতির প্রাপ্য মর্যাদা স্মরণ করে একটু ভ্রুকুটি কাটলেন নক্ষত্ররায়।

প্রাপ্য যথাবিহিত আশীর্বাদ, কুশল ও সৌজন্য বিনিময়ের পর, রঘুপতি শিলা-কুট্টিমের ওপর একটি তৃণাসন পেতে দিলেন। নক্ষত্ররায় তার ওপর উপবিষ্ট হলেন। একজন আর-একজনকে পেয়ে মনে হল তারা পরম হৃষ্ট হয়েছেন। নক্ষত্ররায়ের সঙ্গে রঘুপতি সদ্ভাব স্থাপন করে তাকে দুগ্ধপি-ক্ষীর খেতে দিলেন, সঙ্গে পাকা আমও। নক্ষত্ররায় এসব গ্রহণ করে, একটা ঢোঁক গিলে বললেন, আপনার আতিথ্যে সন্তুষ্ট হলাম। তারপর সকৌতূহলে প্রশ্ন করলেন, এখন বলুন চোন্তাই, আপনার কী আদেশ?

বিহ্বল নেত্রে নক্ষত্ররায়ের দিকে তাকিয়ে, এবার ঈষৎ হেসে রঘুপতি বললেন, আমার কোনো আদেশ নেই। তবে আমার পরম সৌভাগ্য আপনার প্রতি মায়ের নির্দেশ আছে।

নক্ষত্ররায় জানতে চাইলেন, নির্দেশ?

নক্ষত্ররায়কে কোনও চিন্তার অবসর বিশেষ না দিয়ে, একবারে সরাসরিই বললেন রঘুপতি, আপনি মহারাজ হবেন।

কিছুক্ষণ ভুরু কুঞ্চিত করে বসে থেকে রঘুপতির কথাটির মর্মার্থ অনুধাবনের চেষ্টা করলেন নক্ষত্ররায়। তারপর বলে উঠলেন, আমি মহারাজ হব? আপনার মুখে এ কী কথা!

কিন্তু নক্ষত্ররায়ের ভঙ্গিতে যে স্বীকৃতি প্রকাশিত হয়, তা দেখে রঘুপতি মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। তারা এগিয়ে চললেন ভুবনেশ্বরী মন্দিরে দেবী-অর্চনা করার জন্য। পুষ্কর একটু ইতস্তত করে তাদের অনুসরণ করতে থাকে। মন্দিরের দ্বারপার্শ্বে এসে পৌঁছলেন উভয়। একসময় নক্ষত্ররায় ভুবনেশ্বরী দেবীর সম্মুখে এসে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করলেন। সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত শেষ করে উঠে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই তীক্ষèতর তিরের মতো রঘুপতির কথা এসে যেন তাকে বিদ্ধ করল। রঘুপতি বললেন : রাজভ্রাতা, আমি বলছি আপনি মহারাজ হবেন।

কণ্ঠে যথেষ্ট জোর দিয়ে কথাগুলো বলার পর, একটু উৎসুকভাবেই নক্ষত্ররায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রঘুপতি সমর্থন অন্বেষণ করতে থাকেন। কিন্তু নক্ষত্ররায় মনে মনে চমকে উঠলেন। মনে মনেই বললেন : চোন্তাই কী চান? তার একটা উদ্দেশ্য আছে সন্দেহ নেই; কিন্তু কী সেই উদ্দেশ্য? তারপর হাসলেন, মধুর কৌতুকের হাসি, বললেন, আপনি বলছেন? প্রশ্নটি শেষ করে একটি অতিক্ষুদ্র দীর্ঘশ্বাস মোচন করলেন নক্ষত্ররায়।

অকস্মাৎ নিজের কর্তব্য ও কার্য সম্বন্ধে রঘুপতি সচেতন হয়ে ওঠেন, হয়তো তাই বলে উঠলেন, আমি অলীক কথা বলি না।

আপনি অলীক কিছু বলবেন, তা অসম্ভব!

বিদ্রুপ-বাণটি বেশ পরিষ্কার হয়ে ওঠে নক্ষত্ররায়ের কণ্ঠে; কিন্তু রঘুপতি একথা গায়ে মাখলেন বলে বোধ হল না, বরং প্রশান্তগম্ভীর কণ্ঠে বললেন, আপনার কপালে রাজটিকা অঙ্কিত হয়েই আছে।

এবার নক্ষত্ররায় বুঝতে পারলেন, রঘুপতির কথায় ত্রিপুরার শান্তিভঙ্গের ইঙ্গিত রয়েছে; তবে তিনি অবগত যে, মহারাজের সঙ্গে প্রকাশ্যে কলহ করে রক্ষা পাওয়া যাবে না; তাই অন্যকথা ভাবতে ভাবতে লাগলেন, ভাবনার বিষয়বস্তুর অভাব নেই।

তিনি মহারাজের কৃপায় সুখী জীবনযাপন করছেন। ত্রিপুরার রাজভোগ ছেড়ে তিনি অসুখী হতে চান না। তবুও বললেন, আপনি বলছেন রাজটিকা অঙ্কিত হয়ে আছে? যদি না হয়ে থাকে?

রঘুপতি হাসলেন, তবে ঠিক অপ্রতিভের হাসি নয় এটি, কৌতুকেরও নয়; কেমন যেন একধরনের রহস্যময় গভীরতা বিদ্যমান এই হাসিতে। একইসঙ্গে তার দৃষ্টিও হয়ে এল স্বপ্নাচ্ছন্ন। ধীরে ধীরে স্বগতোক্তির মতো রঘুপতি বললেন : আমার কথা ব্যর্থ হওয়ার নয়।

রঘুপতির কথাটির তল নক্ষত্ররায় পেলেন তা নয়, তাই ভাসা-ভাসাভাবে কথাটির সূত্র ধরে বললেন : না, না, সেকথা হচ্ছে না। এই বলে একটু থেমে আবার বললেন, শুধু জানতে চাই, যদি আমার কপালে রাজটিকা অঙ্কিত না হয়ে থাকে- দৈবাৎ কি এমন...

কাঁধে এক বিচিত্র ভঙ্গি করে হাসলেন রঘুপতি, ঈষৎ বিষণ্ণ হাসি, তারপর বললেন, না, না, তার অন্যথা হওয়ার নয়।

একথা বলা সত্ত্বেও নক্ষত্ররায়ের মনে হতাশা দেখা দেয়, একইসঙ্গে বীতস্পৃহাও। অতঃপর বললেন, তার অন্যথা হবে না, আপনি বলছেন! তাহলে নিশ্চিত থাকতে পারেন, আমি মহারাজ হলে আপনাকে আমার মহামন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত করব।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত