ঢাকা ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ২৩ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নাট্যোপন্যাস (পর্ব ৮)

রাজাবলি

ড. মুকিদ চৌধুরী
রাজাবলি

র ঘুপতি এ কথায় অস্বীকৃতি জানিয়ে বললেন: না, না, আর কোনো লোককে এই বিষয়ের বিন্দুবিসর্গ জানাতে দেওয়া যাবে না। কেবল পুষ্করকে আপনার সাহায্যে নিযুক্ত করতে পারি। আগামীকাল প্রাতে এখানে আসবেন। কী উপায়ে এই কার্যসাধন করতে হবে তা বলে দেব।

রঘুপতির কাছ থেকে শিগগিরই পালিয়ে বাঁচতে চান নক্ষত্ররায়। পলায়ন করলেনও বটে। কিছুক্ষণের জন্য এক অখণ্ড নীরবতা নেমে এল। কয়েক মুহূর্ত থমথম করতে থাকে চারদিক।

নক্ষত্ররায় চলে যাওয়ার পর পুষ্কর এগিয়ে এল; তার চক্ষু জলে ঝাঁপসা হয়ে উঠল। রঘুপতির কথাগুলো তার হৃদয়ে আঘাত করছে, বলল : প্রভু, এমন ভয়ানক কথা এর আগে কখনও শুনিনি। আপনি মায়ের সম্মুখে মায়ের নামে ভ্রাতৃবধের প্রস্তাব করলেন?

রঘুপতি যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না পুষ্কর কী বলতে চাইছে, তার মনের চিন্তারও তল পাচ্ছেন না। কিছুক্ষণ ভেবে নিলেন, বুঝলেন, পুষ্করের স্থিরবুদ্ধি ও অসামান্য প্রজ্ঞা রয়েছে। তিনি ভবিষ্যতের জন্য উদ্বিগ্ন। অনিবার্য জেনেও কণ্টকিত হলেন। সকল বিপদ ও বিপর্যয়ের মুখেও রঘুপতি অনুদ্বিগ্ন থাকলেও, এই মুহূর্তে, উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন : আর কী উপায় আছে বলো!

পুষ্কর বিস্মিত হলেও বিহ্বল হলো না। স্বেচ্ছাপ্রণীত স্বেচ্ছারোপিত নিয়মে সুচিন্তিত, সুবিবেচিত, সুবিনত কিন্তু দৃঢ়কণ্ঠে বলল, কীসের উপায়!

রঘুপতির ঈর্ষাগ্নি থেকে পুষ্করের অব্যাহতি মিলল না। তার অস্তিত্বকে স্বীকার করার ইচ্ছেই নেই রঘুপতির। বললেন : বৎস, তুমিও দেখছি, রাজভ্রাতার মতো হয়ে যাচ্ছ। এতক্ষণ তবে কী শুনলে?

অত্যল্প-প্রায়-নিমেষকালের মধ্যেই পুষ্কর লক্ষ্য করল শুধু লজ্জা নয়, আকস্মিক শিষ্যদর্শনের দুঃখের অনির্বচনীয় বার্তাও রঘুপতির চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে। রঘুপতির মুখের দিকে একটা অজ্ঞাত ও দুর্বোধ্য অমঙ্গলাশঙ্কার দৃষ্টি ছুড়ে, অনুরোধ ও অনুনয় কণ্ঠে বলল, যা শুনলাম তা শোনার যোগ্য আমি নই। শুনেছি বলেই মনে পাপ বোধ হচ্ছে।

ত্রিপুরায় যিনি সর্বাধিক বিদ্বেষের পাত্র, যিনি বারবার নিজের শৌর্যবীর্য ও অন্যান্য গুণাবলির আধিক্য দ্বারা রঘুপতিকে ধর্মক্ষেত্রে ও রাজন্যসমাজে ছোট করে দিয়েছেন- তিনিই তার মুখে কালি লেপে দিলেন- এই জ্বালা কিছুতেই ভুলতে পারছেন না রঘুপতি, তাই পুষ্করের উদ্দেশ্যে বললেন : পাপপুণ্যের তুমি কী বোঝো?

পুষ্কর কোনও সময়েই বিচলিত হয় না। ধর্মের ব্যাপারেও সে অবিচল, স্থির। ধর্মের গতির মতোই সে ধীর। তবু, রঘুপতির কথায় তার মনের প্রশান্তি যেন নষ্ট হয়ে গিয়েছে, ঈষৎ উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে তাকে। প্রাণপণ চেষ্টা সত্ত্বেও যেন বিবর্ণ হয়ে উঠল। মুখশ্রী পাণ্ডুরবর্ণ ধারণ করল। চিন্তিত ও বিমর্ষ মুখশ্রী নিয়েই পুষ্কর বলল : না, কিছুই বুঝি না। এতকাল আপনার কাছে যা শিক্ষা পেয়েছি, তা থেকে পাপপুণ্যের কিছুই বুঝিনি।

রঘুপতির ঈর্ষা ও হতাশা- পুষ্কর তার অধিকারে আসাতে ঈর্ষা এবং বারবার চেষ্টা সত্ত্বেও তাকে দমন করতে না- পারার হতাশা- এই দুই অনুভূতি মিলিয়ে উন্মত্তবৎ রঘুপতি নানারকম ছেলেমানুষি প্রস্তাব করতে থাকেন, বললেন : শোনো বৎস, পাপপুণ্য বলে কিছুই নেই। কে-বা পিতা, কে-বা ভ্রাতা, কে-বা আপনজন- বধ করা যদি পাপ হয়, তাহলে সকল বধই সমান। কিন্তু কে বলে বধ করা পাপ? বধ তো প্রতিদিনই হচ্ছে। কেউ-বা মাথায় একখণ্ড পাথর পড়ে নিহত হচ্ছে, কেউ-বা বন্যায় ভেসে গিয়ে শব হচ্ছে, কেউ-বা ছুরিকাঘাতে আহত হচ্ছে। কত পিপীলিকা আমরা প্রতিনিয়ত পদতলে দলন করে যাচ্ছি, আমরা তাদের অপেক্ষা এমনই কি বিশাল? এই ক্ষুদ্র প্রাণীদের জীবন-মৃত্যু খেলা বই তো কিছুই নয়- সবই তো মহাশক্তির কালরূপিণী মহামায়ার কাছে প্রতিদিন এমন কত সহস্র-কোটি প্রাণীর বলিদান হচ্ছে, জগতের চতুর্দিক থেকে জীবশোণিতের স্রোত তার মহাখর্পরে এসে গড়িয়ে পড়ছে। আমিই না-হয় এই স্রোতে আর-একটি কণা যোগ করে দিলাম। তার বলি তিনি এককালেই গ্রহণ করতেন, আমি না-হয় মাঝখান থেকে উপলক্ষ্য হলাম।

রঘুপতির দিকে স্থিরদৃষ্টি নিক্ষেপ করে পুষ্কর মনে-মনে বলতে লাগল : বিবেকের সঙ্গে ছলনা করা যায় না, অসত্যের সঙ্গে আপস চলে না। সত্যের একটিইমাত্র পথ- ধর্ম ও অধর্মের মধ্যে কোনও মধ্যপন্থা নেই। আমরা যে-নিয়ম করেছি তা যদি লঙ্ঘন করি, তাহলে পূজারিরা আর আমাদের উপদেশে কর্ণপাত করবে না। না প্রভু, অন্যায় জেনে তাকে প্রশ্রয় দেয়া- এই দৌর্বল্য আপনাকে শোভা পাচ্ছে না। তারপর দেবীর উদ্দেশ্যে পুষ্কর মনে মনে বলল : এজন্যই কি সকলে এমন পাষাণী রাক্ষসী ভুবনেশ্বরীকে ‘মা’ বলে ডাকে? ‘মা’ তুই সমস্ত জগৎ থেকে রক্ত নিষ্পেষণ করে নিয়ে উদর-ভর্তি করার জন্য এই লোলজিভ প্রসারিত করে আছিস্? প্রেম-মমতাণ্ডসৌন্দর্য সমস্তই অলীক, বাস্তব কেবল তোর এই অনন্ত রক্ততৃষ্ণা? তোর উদর-পূরণের জন্য মানুষ পশুর গলায় ছুরি বসায়? ভ্রাতাকে ভ্রাতা বধ করে?

পুষ্করের চোখ দিয়ে কয়েক বিন্দু জল গড়িয়ে পড়ল।

ঈষৎ হেসে রঘুপতি বললেন : তাহলে দেখছি, বৎস, তোমার চোখের জল দেখে মনে হচ্ছে, বলিদানের পালা একেবারেই উঠিয়ে দিতে হবে।

পুষ্করের হৃদয়ে আঘাত লাগল। রঘুপতির কথার উত্তর সে খুবই সহজে দিল, বলল : সেটা স্বতন্ত্র কথা। এতে অন্য অর্থ বিদ্যমান। চোখের জল ফেলা তো পাপ নয়। কিন্তু তাই বলে ভ্রাতাকে দিয়ে ভ্রাতাবধ? প্রভু, আপনার পায়ে পড়ি, আমাকে আর প্রবঞ্চনা করবেন না, সত্যিই কি মা স্বপ্নে বলেছেন যে, তিনি রাজরক্ত না পেলে তৃপ্ত হবেন না!

কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকেও রঘুপতির চিত্তধৈর্য প্রত্যাবৃত্ত হল না। তিনি অধিকতর অস্থির হয়ে বললেন, সত্যি না হলে কি মিথ্যে বলছি? তুমি আমাকে অবিশ্বাস করো?

রঘুপতির পদধূলি নিয়ে পুষ্কর বলল, প্রভুর প্রতি আমার বিশ্বাস শিথিল হবে না কোনওদিন। কিন্তু রাজভ্রাতারও তো ত্রিপুরার রাজকুলে জন্ম!

রঘুপতি রীতিমতো উত্তেজিত ও নৈর্ব্যক্তিকভাবে ক্রুদ্ধ। বললেন, মায়ের ইঙ্গিত : মহারাজের প্রতি মায়ের অসন্তোষ রয়েছে, অসন্তোষের সম্পূর্ণ কারণও আছে। অতএব মা যখন রাজরক্ত চাইছেন, তখন বুঝে নিতে হবে, তার মহারাজের রক্তই চাই।

পুষ্কর দেখল রঘুপতির কৌতূহলী দৃষ্টি তার ওপর নিবদ্ধ। এই বিসদৃশের জন্য লজ্জিত বোধ করল পুষ্কর। দুই দণ্ড অপেক্ষা করল, নিজেকে শান্ত করার চেষ্টায়। অবশেষে নিজেকে সংযত করে বলল : তা যদি সত্য হয়, তাহলে আমিই রাজরক্ত এনে দেব। তবে অনুরোধ, রাজভ্রাতাকে পাপে লিপ্ত করবেন না।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত