ঢাকা শনিবার, ০৩ মে ২০২৫, ২০ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বই আলোচনা : জলের ক্যালিগ্রাফি

সত্যজিৎ মজুমদার
বই আলোচনা : জলের ক্যালিগ্রাফি

‘জলের ক্যালিগ্রাফি’ কাব্যগ্রন্থটি সঞ্জয় দেওয়ানের অনন্য সৃজনশীল সৃষ্টি কর্ম। সৃজনশীলতার অপরূপ সাজে তিনি তার কাব্য ফসলের মাঠ সাজিয়েছেন। তার এ মাঠে কী না আছে, আছে প্রাগিতিহাসের আখ্যান, প্রাচীন ইতিহাসের নানান খুঁটিনাটি জিনিসে ভরপুর কাব্য সম্ভার। মহাভারতের জন্মান্ধের স্ত্রী গান্ধারী, ভীষ্মের শরশয্যা, রামায়ণের শম্বুক, বেহুলার স্বামী লখিন্দরসহ নানা চরিত্রের উৎকলনে সমৃদ্ধ হয়েছে তার কাব্যগ্রন্থ। তার গ্রন্থে প্রাগিতিহাস, প্রাচীন থেকে শুরু করে বর্তমানের সমসাময়িক প্রেক্ষাপটের নিদারুণ মেলবন্ধন লক্ষ্য করা যায়। তার গ্রন্থটি কেন পড়বেন বলে মনস্থির করবেন? তার গ্রন্থটি পড়লে আধুনিক কবিতার ছন্দ কিরকম হয় তা জানতে পারবেন। আরো জানতে পারবেন ভাষার সঠিক ব্যবহার ও উৎকর্ষতা। বৃদ্ধি পাবে ভাষা দক্ষতা, জ্ঞানার্জন হবে বহুভাষার।

সমৃদ্ধ করতে পারবেন বহু ভাষার জাল কীভাবে বুনন করতে হয়। জন্মান্ধের ‘আখ্যান কবিতায়’ ‘শত পুত্রের ব্যর্থ পিতা হই কালান্তরে’ লাইনে কবি প্রাচীন সভ্যতা থেকে শুরু করে আধুনিক সভ্যতার মানুষের ব্যর্থতা, হাহাকার ও হতাশার চিত্র অংকন করেছেন। ‘পুঁজির চিত্রকলা’ কবিতায় ‘স্বেদবিন্দুতে গড়া এ জনপদে মৃত চোখ নির্নিমেষ দেখে পুঁজির চিত্রকলা’ শীর্ষক লাইনের মাধ্যমে পুঁজিবাদের নীলনকশার মুখোশ উন্মোচন করেছেন। ‘জলের ক্যালিগ্রাফি’ কবিতায় নারীবাদের বিষয়টি চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন। কবি বলতে চেয়েছেন, সাপ যদি লখিন্দরের পরিবর্তে বেহুলাকে দংশন করতো, তাহলে লখিন্দর কী বেহুলার মতো ত্যাগ স্বীকার করতেন? তাই কবি লেখেন, ‘ত্রিবেণী সঙ্গমে মত্ত বেহুলা আজও কি বোঝেন প্রাচীন জলের ক্যালিগ্রাফি’? ‘মেঘবাসর’ কবিতায় কবি নারী-পুরুষের শাশ্বত মিলনের জয়গান গেয়েছেন। ‘জলবিভাজিকা’ কবিতায় কবি ঈর্ষামুক্ত, হিংসামুক্ত জীবনের কামনা করেছেন।

কবি বলেন, ‘নদীর অনুচর হও, শুনো আনোখা পথের পদাবলি হিংসার চোরাবালিতে ডুবে যায় মনের শ্রী’। ‘কালসমুদ্রের পাড়’ কবিতায় কবি মানব জীবনের চিত্র আঁকার প্রয়াস করেছেন। কবি বলেন, ‘হাওয়ায় ভেসে ভেসে মেঘ জানে, পতনের হাহাকার মেঘপিয়ন জানে, চাতকের আর্তনাদ’। ‘একদিন পরাশর’ কবিতায় কবি মহাভারতের লিপিকার কৃষ্ণ দ্বৈপায়ণ বেদব্যাস এর পিতা পরাশরের বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের আখ্যান চিত্রিত করেছেন প্রাসঙ্গিক উৎক্ষেপে। কবি বলেন, ‘আমি একদিন পরাশর হয়ে যাই, গোপনে বৈঠা চালাই সত্যবতীর খেয়ানৌকায়’। ‘ক্লান্ত গোধূলি ’ কবিতায় রাধার বিরহের কথা ফুটে ওঠেছে। কবি লিখেন, ‘ক্লান্ত গোধূলিলগ্নে কার বাঁশি বাজে যমুনার পাড়ে? রাধিকার মন যে পোড়ে বৃন্দাবনের পথের কোণে’! ‘আগুনমুখী’ কবিতায় কবি মহাভারতে পঞ্চপা-ব কর্তৃক জতুগৃহে নিষ্ঠুর ও নির্মমভাবে মাতাসহ পাঁচ নিষাদ পুত্রের হত্যার কথা উল্লেখ করেছেন। কবি বলেন, জতুগৃহের আগুন পোড়া নিষাদ পুত্র আমি স্মৃতিতে অগ্নিদগ্ধ মায়ের মুখ! আমার শরীরের মাংসপিন্ডে লেপ্টে আছে পঞ্চপান্ডবের শঠতা, তুমি আর কতটা করবে খলতাণ্ড আগুনমুখী’। ‘বিমুখ বিকেলের প্রজ্ঞাপন’ কবিতায় কবি পৃথিবী থেকে চিরবিদায়ের বেদনার কথা, মানুষের মাঝে বেঁচে থাকার কথা উল্লেখ করেছেন।

কবি বলেন, ‘বিমুখ বিকেলের কাছে তার নিবেদন; আমাকে গ্রহণ করো মাঠফেরত রাখালের রাঙা পথের ধুলায় গোধূলি বেলায় বড় অবহেলায়’! ‘শম্বুক ফিরে আসে’ কবিতায় তোমার পুরাণ অস্ত্রে আমার পরানে আঘাত হান দুর্বার ইতিহাস কয়- শম্বুক ফিরে আসে বারংবার’ শীর্ষক লাইনের মাধ্যমে সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণির শাসক কর্তৃক শোষণের নির্মম চিত্র অংকন করেছেন। ‘মেঘনার চক্রনৃত্য’ কবিতায় কবি মাতৃভূমির প্রতি প্রগাঢ় প্রীতির কথা উল্লেখ করেন। কবি বলেন, ‘এ জনপদ ছেড়ে কোথায় যাব, কেন যাব?

আমাদের আর কোথাও ভূমি নেই, বাড়ি নেই! স্বপ্নও নেই’। ছোট ছোট কবিতায় ভরপুর বইটি পাঠকের পাঠতৃষ্ণা জিইয়ে রাখে। বইটি প্রথম প্রকাশ পেয়েছে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে। বইটির চমৎকার ফ্লাপ লিখেছেন- জনাব মহীবুল আজিজ, অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। চার ফর্মার এ কাব্যগ্রন্থটি প্রচ্ছদ করেছেন রাজীব দত্ত, প্রকাশক : অভিযান, মূল্য ২০০ টাকা মাত্র।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত