এথেনাকে প্রথম দেখেছিলাম বড় অদ্ভুত সময়ে। সারাদিনের রোদ শেষে মিঠেল হাওয়ার অপরাহ্ণে। আমাদের ছোট্ট পুরোনো বাড়ির উত্তর পাশে বিহারি পট্টি। সেখানে সিরাজগঞ্জের একজন ডেভেলপার ১০তলা ফ্ল্যাট অ্যান্ড কমার্শিয়াল সেন্টার নির্মাণ করছে। তখন ফোর্থ ফ্লোর পর্যন্ত ফিনিশিং হয়ে বিল্ডিং উঠেছে আরও দু’তলা। সকাল-বিকাল ডজন ডজন মোটরসাইকেল গলিতে আসা-যাওয়া করে। তেমনই একটি বাইকের ব্যাক সিটে বসেছিল সে। আমি চমকে উঠেছিলাম। ফারিয়া আবার কোথা থেকে এলো? আমার দৃষ্টিতে কী ছিল জানা নেই, একেবারে চোখের উপর চোখ। সেই সংযোগ থেকে গেল কয়েক মুহূর্ত। মোটরবাইক থেমে গেলে নেমে দাঁড়াল সে। বাইকের মধ্যখানে চার-সাড়ে চার বছরের ছেলে। তারপর পুরুষ মানুষটি। তার গায়ের রং কালো। বেশ গাট্টাগোট্টা। সম্ভবত অন্য জেলার এবং জিমে যাওয়া-আসা মানুষ।
তিন-চারদিনের মাথায় গলিতে মুখোমুখি হলাম। তখন সকাল। সেন্ট যোসেফস্ কিন্ডারগার্টেনে ছাত্রছাত্রী আসে। সকাল আটটায় ক্লাস। আমরা থমকে দাঁড়ালাম।
‘হ্যালো ভালো আছেন?’
‘জ্বি। আপনি?’
‘আপনার বাসা কোথায়? কোথাও দেখেছি মনে হয়।’
‘ছোট শহর। দেখা হতেই পারে। আমার বাড়ি বালুবাড়ি।’
‘ফ্ল্যাট নিয়েছেন? কোন ফ্লোর?’
‘থার্ড ফ্লোর। আপনার প্রতিবেশী।’
‘ওয়েলকাম।’
এথেনা এরপর চলে গেল। আমি অপসৃয়মান তাকিয়ে থাকলাম। সে সিঁড়িতে পা রেখে ঘুরে তাকাল। এমনভাবে নিশ্চুপ হেসে উঠল, আমার হারিয়ে যাওয়া দিনকাল আকস্মিক নেমে এলো। তখনো তার নাম জানি না। আমি তাকে একটি নাম দিলাম। এথেনা। গ্রীক মিথলজির দুর্দান্ত এক চরিত্র। তার জন্ম হয়েছিল মেটিসের গর্ভে। তিনি ছিলেন জিউসের অগ্রজা। মেটিস অনেক বৃদ্ধিমতি ও বিচক্ষণ। জিউস তার বোনের প্রেমে পড়ে যান। মেটিস সেটি বুঝতে পেরে নানান কৌশলে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করেন, কিš‘ ব্যর্থ হন। তারই কন্যা এথেনা। তার আশ্চর্যজনক জন্ম ঘটনা গ্রিক দেব-দেবীরা আগে কখনোই দেখেনি। তারা এথেনাকে সম্ভ্রমের সঙ্গে অভ্যর্থনা জানায়। এথেনা ছিলেন অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী ব্যক্তিত্ব সচেতন সৃজনশীল অপ্সরী।
এই এথেনাও কি তেমন ম্যাসকুলিন আচরণের ফিমেল কিনা কে জানে, তবে তখন কেন জানি এই নামটি মনে এসেছিল। উজ্জ্বল ফরসা দীর্ঘাঙ্গী আর চোখের মধ্যে অদ্ভুত জাদুমায়া কোন অংশে অপ্সরীর চেয়ে কম? কোনো জড়তা নেই, কপটতা নেই, ব্যক্তিত্বময় আত্মবিশ্বাস; মন কেমন কেমন করে। আমার তখন অন্য একজনকে খুব মনে পড়ছিল। এই কথাটি পরেরবার সাক্ষাতে বলেছিলাম। সেদিন রোববার, ক্যাথলিক শিক্ষিকাগণের চার্চে প্রার্থনা আছে; স্কুল দেরিতে শুরু হয়। আমি সম্ভবত কোনো কাজে বেরিয়েছি। মোবাইল রিচার্জ। গলির মধ্যখানে দেখা হয়ে গেল। এথেনা জিজ্ঞেস করে,
‘কেমন আছেন? কোথায় যাচ্ছেন?’
‘এই একটু রিচার্জের দোকানে। আপনি বাবুকে স্কুলে দিয়ে আসলেন?’
‘হ্যাঁ।’
আমরা দু-জন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। ফ্ল্যাটের কাজের জন্য মিস্ত্রি-শ্রমিক দলবেঁধে আসছে। গলিতে ভিড় আড়ে। আমার সে-সবে মনোযোগ নেই। তখন আরো একবার তার কথা মনে পড়ে যেতে লাগল।
‘আপনার সাথে আমার পরিচিত একজনের খুব মিল দেখি।’
‘তাই? যেমন?’
‘আমার ইউনিভার্সিটি পড়ার সময়কার একজন বন্ধুর। আপনার সাথে অদ্ভুত মিল। চেহারায় এমন মিল সত্যি বিরল। একেবারে টুইন মনে হয়।’
‘সত্যি নাকি? তার বাড়ি কোথায়?’
‘সে রাজশাহীর মেয়ে। ফারিয়া আকতার।’
‘তাই। এখনো যোগাযোগ রাখেন?’
‘যোগাযোগ নেই।’
‘আচ্ছা আসি।’
এথেনা চলে গেল। তার নাম জানা হলো না। মোবাইল রিচার্জ করতে গিয়ে নিজেকে খুব ছোট মনে হতে লাগল আমার। একেবারে গায়েপড়া আচরণ করছি কেন? একজন বিবাহিতা মহিলা, চার-পাঁচ বছরের ছেলে আছে, তার স্বামী পালোয়ান টাইপের ওয়ালি খান; আমি এভাবে কথা বলি কেন? এর ব্যাখ্যা কী? ওয়ালি খান নামটি এলো কেন? মাসুদ রানা সিরিজের তিন নম্বর বই: স্বর্ণমৃগ। সেই গল্পের ভিলেন ওয়ালি খান। এথেনার হাজব্যান্ড কি ভিলেন? তার সঙ্গে তো একটি কথাও হয়নি। একজন ভদ্রলোক সম্পর্কে এমন কল্পনা কেন করছি? বিষয়টি জটিল উপপাদ্যের মতো বিভিন্ন রেখা টেনে আজগুবি জ্যামিতি করে গেল। কোনো রেখাই সংযোগ খুঁজে পায় না। সম্ভবত এথেনার চেহারা, তার চোখ আর দৃষ্টিতে অচেনা কিছু রয়েছে, যার আকর্ষণ পতঙ্গ মন এড়াতে পারে না। এথেনার রয়েছে আশ্চর্য ব্যক্তিত্ব। সৌন্দর্যের দুর্মর আকর্ষণ।
একদিন ছাদে উঠলাম। কখনো ওঠা হয়। সেদিন আবছায়া আলোর সঙ্গে হালকা বাতাস। আকাশে দুটো ঘুড়ি উড়ছে। হলুদ আর লাল রঙের খেলা। আমি তাকিয়ে আছি। রেলিং-এর সারিবেঁধে কয়েকটি ফুলের গাছ। ওয়াটার ট্যাংক থেকে জল নিয়ে টবে ছড়িয়ে দিই। উত্তরে তাকিয়ে দেখি, এথেনা ঘুড়ির কাটাকাটি দেখছে। আমি একসময় ঘুড়ি ওড়াতাম। তখন স্কুলে পড়ি। স্কুল থেকে ফিরে ঘুড়ি আর নাটাই নিয়ে ছাদে উঠি। এখন কি সেই বয়স আছে? আমার কেন ঘুড়ি ওড়াতে ইচ্ছে করে?
এথেনা খুব সুন্দর করে হেসে উঠল। মানুষের হাসি সুন্দর। কারও কারও হাসি চেহারায় উজ্জ্বল হয়ে ভেসে ভেসে মন স্পর্শ করে যায়। আমার বুকে তেমন ছোঁয়া এসে লাগল। এখনো তার নাম জানা হলো না। এই নাম না জানা মেয়েটির জন্য মন ব্যাকুল হয়ে গেল কেন? আমি গার্ডেন চেয়ারে বসে পড়লাম। এথেনা আরো কিছুক্ষণ গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। একবার কি চোখের উপর চোখ পড়বে? একসময় দেখি চলে গেছে। ফ্ল্যাটের দক্ষিণ দরজা খোলা। কেউ কারও মুখের উপর দরজা বন্ধ করে না। কেউ বাতাস আসবে বলে খোলা রেখে দেয়। আমি মন খুলে রাখলাম। একটু বাতাস আসুক। একটু সুখের স্পর্শ। অনেক কথা বুকে জমে আছে। সেই আলাপের কিছু সময় ও অবসর আসুক। তার নাম জানা হলো না। অন্য এক বিকেলে দেখি ওয়ালি খান মোটরবাইক নিয়ে বিল্ডিং-এর নিচে নেমে আসছে। সে ভারি অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। এথেনা কি কিছু বলেছে? আমি কি খারাপ আচরণ করেছি? একটুপর ছেলের হাত ধরে নেমে আসলো সে। মোটরবাইকের মধ্যখানে ছেলেকে তুলে নিজে পেছনে বসল। তারপর কী ভেবে পেছন ফিরে তাকাল। পুনরায় আরও একবার চোখের সংযোগ হয়ে গেল। তার ঠোঁটে হাসি, দৃষ্টি মোলায়েম রহস্যময় এবং এও হতে পারে যে, কেউ একজন তার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকায়, সে বুঝতে পেরেছে; আমার বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে গেল। ওয়ালি খান বড়ই ভাগ্যবান। সে কি জানে জীবনে কোন অপ্সরী পেয়েছে? বোধহয় সেই ভাবনার সময় পায় না। সেই কথা লেখা আছে এথেনার চোখে। এমন বিষাদ চেহারাই বোধকরি টানে আমায়। সেদিন অনেক সময় ধরে তার কথা মনে এলো। এক-দুই-তিন করে কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। ইউনিভার্সিটির মমতাজ উদ্দিন ফ্যাকাল্টির দ্বিতীয়তলায় যে দৃশ্যের সূচনা মনে পড়ে গেল। আমাদের কথা হচ্ছিল। সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় কোন শক্তি বেশি প্রবল অর্থনীতি নাকি রাজনীতি? কে কার উপর প্রভুত্ব করে? বিষয়টি জটিল। এ রকম যে, মানুষ নিরক্ষর তাই গরিব, আবার মানুষ গরিব বলেই নিরক্ষর। সে যা হোক একফাঁকে কথা বলে উঠে ফারিয়া,
‘আমি যাই, দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
‘চলো আমিও যাব। লাঞ্চের টাইম হয়ে যাচ্ছে।’
‘আমার বাসায় যাবে?’
‘কী রান্না হয়েছে?’
‘আমি জানি না। মা বোধকরি ছোট মাছের চড়চড়ি আর মুগের ডাল রেধেছে।’
‘আমি তো মাছ খাই না। হা হা হা!’
‘সেই তো! ফ্রিজে চিকেন আছে। গরম করে দেব। চলো।’
‘আজ নয় ফারিয়া। স্নান করিনি। অন্য একদিন।’
‘শিওর?’
‘শিওর।’
ফারিয়ার বাসায় একদিন গিয়েছিলাম। তখন মায়ের কথা মনে পড়েছিল। পৃথিবীর সব মায়েরা মনে হয় আপনজন। নিজের ছেলের মতো এটা-ওটা পাতে তুলে দিলেন। ফারিয়া একফাঁকে বাইরে গেল। ফিরে এলো দই নিয়ে।
‘তোমার জন্য নিয়ে এলাম। যা গরম পড়েছে। ভালো লাগবে।’
‘বাবা নিজের বাড়ি মনে করে খাও। লজ্জা করো না।’
‘ওকে ছেড়ে দাও মা। ও নিজে থেকে খায়।’
‘তাই নাকি?’
‘জি আম্মা! আমি খেতে বসে এটা নয় সেটা নয় করি না।’
‘ভালো অভ্যেস।’
‘আর জানো মা, যেটা দরকার, বলবে খুব ভালো রান্না হয়েছে। তাই না?’
‘তুমি সব বলে দিয়েছ নাকি?’
ফারিয়া হাসিখুশি মেয়ে। একদিন আকস্মিকভাবে পরিচয় হয়। সে বাংলা ডিপার্টমেন্টে সেকেন্ড ইয়ার। আমার তিন বছরের জুনিয়র। আমি বছরখানেক থাকব। ফারিয়ার বিয়ে হয়েছে। কমপ্লিকেটেড ম্যারিজ। তথ্য গোপন করে বিয়ে। ছেলেটির নাকি মাথা খারাপ। তখন ফারিয়া ইন্টার শেষ করেছে। ফুড ইন্সপেক্টরের প্রথম পুত্র। বিএ পাস। চেহারা-সুরত নায়কের মতো। ছবি দেখেছি। ফারিয়া বলে,
‘মুখ দেখে ভুল করো না, মুখ তো নয় মনের আয়না।’
‘ওর সমস্যা কী?’
‘আধপাগল। পূর্ণিমা-অমাবস্যায় নাকি উন্মাদ হয়ে যায়। আমি যখন ওখানে গেলাম, দেখি রাতে এতগুলো করে ট্যাবলেট-ক্যাপসুল খাচ্ছে। স্মরণশক্তি নেই। একটুতেই রেগে ওঠে।’
‘চিকিৎসা করে না?’
‘সেটা না করলে অষুধ খায় কেন?’
‘এত বড় ধোকা! তোমার ফ্যামিলি কী বলে?’
‘তারা আর কী বলবে? আমি চলে এসেছি। ছয়-সাতদিন ছিলাম।’
‘তারপর?’
‘হি ইজ ইমপোটেন্ট।’
আমি কথা বলতে পারলাম না। মানুষ মানুষের জীবন নিয়ে এমন চতুর খেলা খেলে? জুয়ার মতো। এরা কি মানুষ নাকি নরাধম! একদিন পিঙ্গল আকাশ। বাস থেকে নেমে এলো একঝাঁক পরি। তাদের একজন ধীরে ধীরে আশপাশে কাউকে খুঁজতে থাকে। এগিয়ে গেলাম। ফারিয়া। সে কাছে এসে বলে,
‘তোমার সাথে কথা আছে। একটু ক্যাফেয় যাবে?’
‘বেশ চলো। আমার ক্লাস নেই।’
এখানের কফি চমৎকার। কফি নিলাম। চলবে...