ঢাকা শনিবার, ১০ মে ২০২৫, ২৭ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

শীতের বুড়ী

ফারুক আহম্মেদ জীবন
শীতের বুড়ী

সাজ্জাদ সায়মার ফুটফুটে দুটি ছেলে-মেয়ে শাহজাদা আর সুজাতা। সাজ্জাদের সাত আর সুজাতার বয়স পাঁচ বছর চলছে এখন। খুব মিষ্টি দেখতে ওরা দুই ভাইবোন। যেমন চটপটে তেমনি হাসিখুশি। সাজ্জাদের দেশের বাড়ি সিলেট। বেশ অবস্থাপূর্ণ ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান সে। ঢাকায় জব করার সুবাদে ফ্যামিলি নিয়ে এখন সে ঢাকায় থাকে। কয়েকদিন আগে শাহজাদা আর সুজাতার বার্ষিক পরিক্ষা শেষ হয়েছে। আর তাই শীতের ছুটিতে ওরা মা-বাবার সাথে যশোরে ওদের নানু বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছে। সেই আনন্দে ওরা দুই ভাইবোন একসাথে কবি ফারুক আহম্মেদ জীবন এর লেখা শীতের বুড়ী নামক মিষ্টি ছড়া কাটছে হেসে হেসে অঙ্গভঙ্গি করে হাত, চোখ, মুখ নেড়ে নেড়ে... শীতের বুড়ী এলো এবার/ দিয়ে হামা-গুড়ি,/ মিঠে পিঠা খাবো রসের/ খাবো যে গুড়-মুড়ি, ওদের মা, সায়মা এসে বললো...বুঝতে পারছো না

ওখানে নানা-নানির আদর পাবে। একটু বাঁদরামি করে ঘুরে বেড়াতে পারবে গাঁয়ের মাঠে। শীতের মিষ্টি খেজুর রস, পিঠা খেতে পারবে। আরো কতো কি...সাজ্জাদ বললো... হুম বাচ্চারা নানা-নানিকে কাছে পেলে তো একটু বেশি আনন্দ করবেই। নাও চলো তাড়াতাড়ি ট্রেন ধরতে হবে। সায়মা বললো...হুম চলো।তারপর সকলে বেরিয়ে

পড়লো বাড়ি থেকে...। ওদের নানা প্রতাপ চৌধুরী একজন এলাকার বেশ গণ্যমান্য সম্মানি লোক। যেমন তার প্রভাব পতিপত্তি তেমনি প্রতাপশালী। পলাকমুখে শোনা যায় একসময় নাকি চৌধুরীর বংশের পূর্ব পুরুষরা জমিদার ছিল। যদিও এখনো প্রচুর ধন-সম্পদ জায়গা-জমি রয়েছে চৌধুরীর। তার স্ত্রী মিসেস মিনতি চৌধুরী খুব পর্দা শীল পরহেজগার মহিলা। দুপুরের একটু আগে সাজ্জাদ পরিবার নিয়ে যশোর পৌঁছালো। জামাই মেয়ে নাতিনাতনি আসবে সংবাদটা পেয়ে চৌধুরী আগেই গাড়ি পাঠিয়েছে স্টেশনে ওদের আনতে। ওরা সব ট্রেন থেকে নামতেই ওদের সামনে একটা গাড়ি এসে থামলো। সকলেই সে গাড়িতে ওঠে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যে ওদের নিয়ে গাড়ি এসে পৌঁছালো বাড়ি। গাড়ির শব্দ শুনে চৌধুরী, স্ত্রী মিসেস রাবেয়া চৌধুরী ও বাড়ির অন্য অন্য লোকজন গাড়ির কাছে ছুটে এলো। সাজ্জাদ সায়মা গাড়ি থেকে নেমে সালাম করে।

কুশলাদি জিজ্ঞাসা করে কদমবুসি করলো চৌধুরী আর তার স্ত্রী মিসেস চৌধুরীকে। শাহজাদা সুজাতা দুই ভাইবোনও ওদের নানা-নানিকে সালাম দিয়ে ভালোমন্দ জিজ্ঞাসা করল। প্রতাপ চৌধুরী সুজাতাকে, আর মিসেস চৌধুরী শাহজাদাকে আদর করে কাছে টেনে নিলো। চৌধুরী কাজের লোক রাজনকে ডেকে বললো, জাল ফেলে পুকুর থেকে বড় মাছ ধরতে। বাড়ির কেউ কেউ মিষ্টির প্যাকেট আর ওদের সাথে আনা ব্যাগ গাড়ি থেকে নামিয়ে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেলো। চৌধুরী আর চৌধুরীর স্ত্রী বহুদিন পর ছোট-ছোট দুটি দুষ্টু-মিষ্টি নাতি-নাতনি আর মেয়ে জামাতাকে একসঙ্গে পেয়ে খুব খুশি। দুপরের লাঞ্চের পর বিকেল বেলা শাহজাদা আর সুজাতা ওদের নানার সাথে গাঁয়ে একটু ঘুরতে বের হলো গ্রাম দেখার জন্য। বেরুনোর সময় ওদের নানি মিসেস মিনতি চৌধুরী স্বামী প্রতাপ চৌধুরীকে ডেকে বললো...ওগো, শেনো...কাল সকালে কিন্তু করিমকে খেজুরের রস দিতে বলো কেমন। তারপর শাহজাদা আর সুজাতার দিকে তাকিয়ে বললো...।

আমার নানু ভাইয়েরা এসেছে। ওদের যে খেজুরের মিষ্টি রসের পিঠে খাওয়াতে হবে। চৌধুরীও হেসে বললো...আচ্ছা ঠিক আছে. বলবো। আমার নানু ভাইয়েরা শীতের সকালে খেজুরের মিষ্টি রস খাবে। জিরেন কাঠের মিষ্টি রসের পিঠে খাবে...।

আর আমি বলবো না! সেটা কি হয় বলো তো...? আজই বলে দেবো করিমকে ঠিক আছে। মিসেস চৌধুরী হেসে বললো: হুম ঠিক আছে যাও। সেসময় শাহজাদা আর সুজাতার মা, মানে চৌধুরীর মেয়ে সায়মা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললো: আব্বা...কোথাও যাচ্ছেন নাকি? প্রতাপ চৌধুরী

গ্রাম ঘুরতে বের হচ্ছি। কেনো.কিছু বলবি মা সায়মা? সায়মা বললো: না এমনি জিজ্ঞাসা করছি আব্বা। প্রতাপ চৌধুরী বললো: ও আচ্ছা...।

সে সময় চৌধুরীর জামাতা সাজ্জাদ বললো...যাক।

শহরে তো কোথাও মুক্ত জায়গা নেই। একটু গাঁয়ের খোলা-মেলা সবুজ পরিবেশে ঘুরে আসুক। চৌধুরী বললো...জামাই বাবাজি ঠিক বলেছে মা।

গ্রামের মতো চোখ জুড়ানো সবুজ প্রকৃতি আর বেঁচে থাকার জন্য নির্মল বিশুদ্ধ অক্সিজেন কি শহরে পাওয়া যায়? নানা ফুল পাখিদের মিষ্টি মধুর গান। সায়মা বললো...জ্বি, আব্বা ঠিক বলেছেন।

তারপর, শাহজাদা আর সুজাতার হাত ধরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাঁয়ের মেঠো পথ দিয়ে হাঁটতে লাগলো চৌধুরী। আর চলার পথের এদিক-সেদিক তাকিয়ে হাত ইশারা করে গাঁয়ের সবুজ ফসলের মাঠ সিম, মটরশুঁটি, সবজি ক্ষেত এসব দেখাতে লাগলো নাতি-নাতনীদের. হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ! করিমের সাথে পথে দেখা হয়ে গেল চৌধুরীর।

তখন পড়ন্ত লালিমা গোধূলি বেলা। করিম তখন তার খেজুর গাছগুলো কেটে বাড়ি ফিরছিলো। মাজায় ঠুঙ্গি দড়া বাঁধা রয়েছে। কাঁধে রয়েছে বাগ। বাগের দুইপাশে দুটো ভাড়ও ঝুলছে। করিম চৌধুরীকে দেখেই সালাম দিলো। আসসালামু আলাইকুম চৌধুরী সাহেব। চৌধুরী সাহেব কেমন আছেন? চৌধুরী সালামের উত্তর দিলো...ওয়া আলাইকুমুস সালাম। তারপর চৌধুরী বললো...।

আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।

তুমি কেমন আছ করিম মিয়া? বউ ছেলেমেয়ে সব কেমন আছে? করিম প্রতিউত্তরে বললো...জ্বি, আলহামদুলিল্লাহ আমরা সবাই ভালো আছি। চৌধুরী বললো, যাক বেশ ভালো আছ জেনে খুশি হলাম। আচ্ছা শোনো করিম মিয়া। করিম মিয়া বললো: জ্বি, বলেন চৌধুরী সাহেব। চৌধুরী বললো: তোমার সাথে দেখা হয়ে ভালোই হলো। তোমার চাঁচি বলছিলো...কাল সকালে আমার বাড়িতে দুই ভাঁড় খেজুরের রস দিয়ে আসতে। দিয়ে এসো কিন্তু কেমন। আমার নানু ভাইয়েরা এসেছে শহর থেকে। ওদের যে এই শীতের মিষ্টি খেজুরের রস। গরমণ্ড গরম ভাপা পুলি, পাটিসাপটা আর রসের পায়েস ঘির খাওয়াতে হবে।

করিম বললো..জ্বি, চৌধুরী সাহেব তাণ্ডতো বটেই, তাণ্ডতো বটেই। তারপর...করিম, শাহজাদা আর সুজাতার দিকে তাকিয়ে বললো...তা, নানু ভাইয়েরা ভালো আছ তো তোমরা? শাহজাদা আর সুজাতা হেসে ঘাড় নেড়ে বললো জ্বি, ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন তো? করিমও হেসে ওঠে বললো...আলহামদুলিল্লাহ্ আল্লার রহমতে ভালো আছি। তারপর বললো... চৌধুরী সাহেব, চিন্তা করবেন না, আমি আগামীকাল সকালেই রস পৌঁছে দেবো।

আপনার বাড়িতে। চৌধুরী বললো...আচ্ছা ঠিক আছে। এবার তাহলে তুমি যাও করিম মিয়া...। এমনিতেই গাছ কেটে তোমার অনেক কষ্ট হয়ে গেছে। করিম মিয়া বললো: জ্বি, চৌধুরী সাহেব তাহলে আসি। তারপর সালাম দিয়ে বাড়ির দিকে

হাঁটতে শুরু করলো...। চৌধুরীও সালামের জবাব দিয়ে নাতি-নাতনীদের নিয়ে হাঁটতে লাগলো আর বিভিন্ন ডোবা-পুষ্করিণী গাছপালা-পাখপাখালি দেখাতে লাগলো। একসময় সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়তেই মাগরিবের আজান শুরু হলো। চৌধুরী শাহজাদা আর সুজাতাকে নিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলো। বাড়ি ফিরে অজু সেরে চৌধুরী নামাজ পড়তে গেল মহল্লার মসজিদে। রাতে একসাথে সব ডিনার করতে বসলো ডাইনিং টেবিলে। খাওয়ার সময় একপর্যায় চৌধুরী জামাই সাজ্জাদকে জিজ্ঞাসা করলো...তাণ্ড জামাই বাবাজি তোমার জব কেমন চলছে? সাজ্জাদ খাওয়ার ফাঁকে বললো...জ্বি, ভালো চলছে আব্বা। মিসেস চৌধুরী বড় মাছের মাথাটা জামাইয়ের প্লেটে দিয়েছে। মাছের তরকারি খাওয়ার পর খাসির মাংস রান্না তুলে দিলো জামাই সাজ্জাদের প্লেটে।

মিসেস চৌধুরী আবার মাংস দিতে যাবে সেসময় সাজ্জাদ বললো...থাক...থাক...আম্মা, আর খেতে পারবো না। মিসেস চৌধুরী বললো...তাই বললে হয় বাবা...আর একটু নাও...বলে আবার চামচে কয়েক পিচ মাংস তুলে দিলো। খাওয়া-দাওয়ার পর সবাই কিছুক্ষণ গল্প করে ঘুমাতে গেল। পরের দিন সকালে করিম মিয়া খেজুরের রস নিয়ে এলো। মিসেস চৌধুরী নানান রকম শীতের মিষ্টি খেজুরের রসের পিঠে বানাই খাওয়া মেয়ে-জামাই নাতি-নাতনীদের। এক সপ্তাহ বেশ আনন্দে কাটলো শাহজাদা আর সুজাতার স্কুল ছুটির দিন গুলো ওদের নানু বাড়িতে। তারপর একসময় ওরা নানু বাড়ির সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার নিজেদের বসবাসের গন্তব্য স্থলে রওয়ানা দিলো ঢাকায়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত