মানবতার কোনো নদী নেই, যে নদীগুলো রয়েছে সেগুলো বয়ে চলেছে অন্তর থেকে অন্তরে। তেমনি এক নদীর নাম জর্জি। আইরিশ শহর ডাবলিন, ১৮৫৬ সালে তার জন্ম। বড় হতে হতে তার লেখালেখি এবং সমাজতন্ত্রের প্রতি গভীর অনুরাগ তৈরি হয়। তবে প্রকৃতি ছিল তার বন্ধু। প্রতিদিন জর্জি লিফি নদীর তীরে গিয়ে একটু সময় কাটায়। সেখানে বালুর মধ্যে পাওয়া স্যাফায়ার পাথরের নীল আংটিটি জর্জিকে খুব কষ্ট দিচ্ছে। আংটিটি তার খুব চেনা। কিন্তু জর্জি ভাবে প্রতিদিন এও কী সম্ভব!
লিফি নদীর তীর স্থাপত্যের অপূর্ব শোভা। কাস্টম হাউসের গম্বুজ রোদে ঝলমল করছে। দূরে হাফ পেনি ব্রিজের ধবধবে সাদা রেলিং। একটু পর সূর্য ডুবতে বসেছে, আকাশের রং লালচে কমলা, আর নদীর জল সোনার মতো ঝলমল করছে। এক তরুণী, নদীর ধারে ছবি আঁকছে। হঠাৎ জর্জিকে দেখে চমকে ওঠে। হাওয়ায় তখন মেয়েটির চুল উড়ছে। মেয়েটি মৃদু হেসে বলে : ‘আমি শার্লট, আপনাকে আমি চিনি, আপনার নাটক ‘পিগম্যালিয়ন’ আমার প্রিয়।’
দুজন নদীর ধারে হাঁটতে শুরু করে। ট্রিনিটি কলেজের ঘড়ির ঘণ্টাধ্বনি শোনা যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে শার্লট বলে, ‘আমি ইংল্যান্ড থেকে প্রতি বছর এখানে আসি, একজনকে খুঁজতে। অনেক বছর আগে এখানে আমার একটি স্যাফায়ার পাথরের আংটি হারিয়ে গিয়েছিল। আমি আংটি আর যে আমার ১২ বছর বয়সে আংটিটি দিয়েছিল তাকে পেতে চাই। আমি তাকে উইন্ড বলে ডাকতাম। আর কিছু জানি না।’ জর্জি স্মিত হেসে বলে, ‘ডাবলিন আমার শৈশবের শিক্ষক। এর প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি ব্রিজ, প্রতিটি গাছপালা আমাকে জীবনের পাঠ দিয়েছে। আমি চেষ্টা করব উইন্ডকে খুঁজে দিতে।’ জর্জি মেয়েটিকে কন্টাক নম্বর দিয়ে চলে আসে। এর পরদিন জর্জি মুখোমুখি হয় আরেক নতুন রূপে। এক্সিকিউটিভ বাসভবন ফিলিপ হসে বসে জর্জি লেখালেখি করছিল। এ সময় জানতে পারে সে নোবেল পুরস্কারে জয়ী হয়েছে। জর্জি খুশি হয়, কিন্তু তাকে আচ্ছন্ন করে এক গভীর দুঃখ। জর্জি খুবই মানবিক মানুষ। নোবেল পুরস্কারের প্রতিষ্ঠাতা আলফ্রেড নোবেল ছিলেন ডিনামাইটের উদ্ভাবক। জর্জি জানে নোবেলের সম্পদ অস্ত্র ও ধ্বংসাত্মক বস্তু থেকে অর্জিত, যা মানবতাবিরোধী। তাই নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করতে মন চাচ্ছে না। বন্ধুরা বোঝালে জর্জি পুরস্কারটি গ্রহণ করতে অভিযাত্রা শুরু করে স্টকহোম, সুইডেন। সময়টা ছিল ১৯২৬ সালের ডিসেম্বর। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান চলছে। গ্র্যান্ড হোটেলের রাজকীয় বলরুমে, চারপাশে জমকালো আলোকসজ্জা আর সুসজ্জিত অতিথিদের ভিড়। সবার সঙ্গে বসে আছে জর্জি। জর্জি তার মা-বাবার দেয়া আদরের নাম। পুরস্কার গ্রহণ করতে মঞ্চে উঠে জর্জি, পুরো নাম জর্জ বার্নার্ড শ। তবে তার আচরণ এই সন্ধ্যাকে আরো স্মরণীয় করে তোলে। কারণ জর্জি নোবেল পুরস্কারের অর্থ নিজের জন্য না নিয়ে সেই অর্থ সুইডিশ সাহিত্যিক সংস্থাকে দান করে দেয়। এটি এক মানবতার প্রতি দায়বদ্ধতার প্রতিফলন, বিশ্ব বিহ্বল হয়ে পড়ে। জর্জির মতো মানবিক বোধের নদী লিফি নদীর চেয়ে তীব্র, স্রোতশীল।
অনুষ্ঠান শেষে জর্জি ফিরে আসে ডাবলিনে। মনটা ভীষণ চঞ্চল। কারণ শার্লট ইংল্যান্ডে চলে যাবে, তাই আইরিশ সাগরে দেখা করবে আজ। শার্লটের সঙ্গে জর্জি স্কুলে পড়ত। ইয়ার সেভেনের সময় শার্লট ডাবলিনের স্কুল ছেড়ে চলে যায় ইংল্যান্ডে ওর মা-বাবার সঙ্গে। আর কখনো দেখা হয়নি, অনেক খুঁজেছিল জর্জি। আংটিটি দেখতে ছিল অপূর্ব। গভীর নীল স্যাফায়ার পাথরটি যেন আকাশের একখণ্ড নীল মেঘহীন অংশ। এর চারপাশে ছোট ছোট হীরা জ্বলজ্বল করছিল। জর্জি মুক্তার একটি বক্সে ভরে রওনা হয় আইরিশ সাগরের দিকে। আইরিশ সাগরের তীরবর্তী গ্রামগুলো স্থাপত্যশৈলীর অনন্য রূপ। পুরোনো ক্যাসেল, পাথুরে চার্চ, ছোট ছোট কটেজের সারি প্রাচীন আইরিশ ঐতিহ্যের গল্প বলে। সাগরের রংটি অপূর্ব সূর্যের আলোয় কখনো ফিরোজা, স্বচ্ছ নীল, কখনো সবুজাভ। বিস্তৃত ল্যান্ডস্কেপে রয়েছে পাহাড়, বুনো ফুলের উপত্যকা এবং ক্লিফ। শার্লট জর্জির কাছে এসে দাঁড়ায়। হেসে বলে, ‘দুঃখিত, একটু দেরি হয়ে গেল।’ জর্জি সিরিয়াস, সমস্যা নেই। আপনার অভিনন্দনে আমি সিক্ত, এত ফুল পাঠিয়েছেন, কোথায় রাখব! তাই হৃদয়ে রেখে দিয়েছি। শার্লট লজ্জা পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
জর্জির মনে পড়ে স্যাফায়ার পাথরের আংটিটি ওর দিদা দিয়ে বলেছিলেন, তোমার বউয়ের জন্য। তেরো বছরের জর্জি না বুঝেই সেটা শার্লটকে পরিয়েছিল।
আজ শার্লট অপূর্ব সুন্দর এক পরি। জর্জি মুক্তার বক্স থেকে স্যাফায়ার পাথরের নীল আংটিটি পরিয়ে দেয় শার্লটের অনামিকায়। স্মিত হেসে বলে, আমি তোমার উইন্ড। ছোট বেলার ডাবলিন স্কুলের জর্জি, নোবেল বিজয়ী জর্জ বার্নাড শ। আরো পরিচয় দিতে হবে? শার্লট চমকে ওঠে, স্যাফায়ার পাথরের নীল আংটিতে গভীর ভালোবাসায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘তোমায় আমি কত খুঁজেছি, পুরোনো বাসায় গিয়েছি, কেউ কিছু বলতে পারেনি। তবুও আমি প্রতি বছর আশা নিয়ে আসতাম।’ সূর্যাস্ত যেতেই সাগরের বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। শার্লট জর্জির দিকে তাকিয়ে থাকে রূপকথার মতো, চোখে বিশ্বাসের আলো। সে আলোয় ডুবে যায় জর্জি। শার্লটকে জড়িয়ে ধরে বুকে। চাঁদের আলোর মোম জোছনা ঝরে পড়ছে, ঝরে পড়ছে সব রুপালি নীল তারার ফুল, শার্লট আর জর্জির চোখে, মুখে ও চুলে।