ঢাকা মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল ২০২৫, ২ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

লেখক হয়ে ওঠেন সংবেদনশীল ও হৃদয়বান মানুষরা

নুসরাত সুলতানা একজন কবি-কথাসাহিত্যিক। তিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ মিলিটারি ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে সিভিলিয়ান স্টাফ অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন ২০ বছর ধরে। কর্মজীবী নারী হয়েও সাহিত্যই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান ও সাধনা। বাংলা সাহিত্যকে আরো ঐশ্বর্যবান করতে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছেন। তিনি দ্বিতীয় দশকের কবি ও কথাসাহিত্যিক হলেও মেধা, বুদ্ধি, কল্পনা এবং শক্তিশালী লেখার কারণে সমসাময়িকদের থেকে অনেক দূর এগিয়ে আছেন। যার কবিতাণ্ডগল্পের মধ্যে সুষম শব্দযোজনা, গূঢ় অর্থব্যঞ্জনা, সাহিত্যের শক্তিশালী ইশারা, রূপকল্প, চিত্রকল্প স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়। সাহিত্যের নানা বিষয় নিয়ে কথা হয়েছে কবি ও কথাসাহিত্যিক নুসরাত সুলতানা’র সাথে
লেখক হয়ে ওঠেন সংবেদনশীল ও হৃদয়বান মানুষরা

প্রশ্ন : আপনি কি মনে করেন কবি বা লেখকরা সামাজ ও রাষ্ট্র থেকে উপেক্ষিত? যদি উপেক্ষিতই হয় তাহলে এসব দেখে ও বুঝে মানুষ কবি বা লেখক হতে চায় কেন?

উত্তর : দেখুন পড়াশোনা করে যা শুধু চেষ্টা করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী বা বিজ্ঞানী হওয়া যায়। কিন্তু আদৌ সাহিত্যিক, কবি বা শিল্পী হওয়া যায় কী? আপনার উত্তর খুব সম্ভবত না। আসলে লেখক হয়ে ওঠেনই সংবেদনশীল, হৃদয়বান এবং সমাজ বা দেশের প্রতি দায়বদ্ধ মানুষরা। তাই উপেক্ষা বা অবজ্ঞা লেখকের প্রতিজ্ঞা বা দায়বদ্ধতায় আদৌ কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না প্রকৃত অর্থে। হ্যাঁ লেখকের নামে আমরা প্রচুর দলকানা, ধান্দাবাজ এবং ফপরদালাল লোককে শিল্প-সাহিত্যের সাথে জড়িয়ে থাকতে দেখি। অইরকম সব ক্ষেত্রেই দেখা যায় যেমন ধরুন সঙ্গীত, অভিনয়, চিত্রকলা। প্রকৃত শিল্পী অইসবের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে ক্ষুরধার নদীটির মতো ছুটে চলেন আর মহাকালের বুকে এঁকে যান নতুন চিত্রকল্প।

প্রশ্ন : আমাদের দেশে প্রায়ই শুনে থাকি তিনি অমুক দলের কবি তমুক ধর্মের লেখক আসলে একজন লেখকের জন্য দল ও ধর্মবিশ্বাস কতটা গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনি মনে করেন?

উত্তর : লেখকের রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। কিন্তু সেই অবস্থানে অবশ্যই সবার আগে দেশ, প্রজন্ম আর নিজের সত্যবোধকে প্রাধান্য দেয়াই প্রত্যাশিত। আর ধর্ম চর্চাও সৃষ্টিশীলতা বা প্রগতিশীলতার অন্তরায় বলে আমি মনে করি না। বরং উদার ধর্ম চর্চা মানুষকে আরো সংবেদী করে তোলে। জীবন বৃক্ষের দুটি ভিন্ন ভিন্ন প্রকাণ্ড শাখা ধর্ম এবং শিল্প-সংস্কৃতি। সর্বোপরি সবার আগে মানুষকে প্রেমিক হয়ে ওঠা জরুরি। প্রেমিকই অনুবাদ করতে পারে ক্ষুধা, ঘুম, কাম আর চোখের জল।

প্রশ্ন : ভার্চুয়াল বিপ্লবের পর আমাদের দেশের সাহিত্য পাড়ায় একটি প্রচলিত কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভাইরাল লেখক। আসলে লেখক কি কখনো ভাইরাল হয়? নাকি সে আগে থেকেই ভাইরাল?

উত্তর : পুঁজিবাদ তো প্রেম আর শিল্পকেও বড় বড় পন্যের মূল্যায়নে ফেলে দিয়েছে। এইক্ষেত্রে বলব নায়ক। ভাইরাল হয় বা ক্রেজি হয় কিন্তু অভিনেতা? কিন্তু সময় কাকে ধরে রাখে? নিশ্চয়ই শিল্পীকেই।

যারা ভাইরাল হতে চায়, চাক। কারণ মৌসুম গরম করার মতো কিছুও তো প্রয়োজন আছে। এদেশের এত মানুষ! কী নিয়ে সময় কাটাবে বলেন? তাই বলে শিল্পী, সাহিত্যিকদের এসব দেখার দরকার নেই। নিজের কাজে আরো নিবিষ্ট হওয়াই কাম্য।

প্রশ্ন : প্রযুক্তির ছোঁয়া সব জায়গাতেই লেগেছে এমনকি অনেক সেক্টর তা গ্রহণ করে সুবিধা ভোগ করছে; কিন্তু এদিক দিয়ে লেখকরা পিছিয়ে আছে বলে আপনার মনে হচ্ছে না?

উত্তর : না। এমন মনে হচ্ছে না। প্রচুর ওয়েব ম্যাগ হয়েছে। লেখক-সাহিত্যিকরা ফেসবুক লাইভ করছে।

ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় কথা বলছেন। বরং লেখকদের শো অফ কিছু কম করে আরো নিবিষ্ট হয়ে লেখা এবং পড়ায় নিবিড় মনযোগ প্রয়োজন বলে মনে করি।

প্রশ্ন : আপনি গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ সবই লিখেছেন। উপন্যাস লিখেছেন কী?

উত্তর : হ্যাঁ। লিখেছি। একটা উপন্যাস খুব দ্রুত প্রকাশিত হবে আশা করি। আরেকটা দ্বিতীয় সম্পাদনা চলছে।

২০২৬-এর মেলায় প্রকাশিত হবে এমন প্রত্যাশা করছি। নতুন দুটো উপন্যাসের প্লট বাসা বেঁধেছে করোটিতে। পড়াশোনা করছি। প্রত্যাশা করছি ভালো কিছু হবে।

প্রশ্ন : অফুরান অভিনন্দন। কবে নাগাদ লেখা শুরু করবেন? আখ্যান কী?

উত্তর : আগে ভালো করে পড়াশোনা করতে হবে। আশা করি আগামী জুনের আগেই শুরু করব। আখ্যান নিয়ে এখনই কিছু বলছি না।

প্রশ্ন : ছোট গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ। কোনটা লেখা বেশি উপভোগ করেন? সাধারণত কখন লিখতে বসেন।

উত্তর : কবিতা যখন নিজেই লিখিয়ে নেয়, তখনই লিখি। এছাড়া লিখি না। অর্থাৎ কবিতা আমার আত্মিক মুক্তি। আর গল্প আমার নিবিড় সমর্পণ। এখনো গল্প লিখতে বসলে ঘেমে যাই। ভয় পাই। গলা শুকিয়ে আসে। কিন্তু গল্প লেখা আমার খুব প্রিয় এবং আরাধ্য। আর প্রবন্ধ যখন ভাবনায় অনিবার্য হয়ে ওঠে তখনই লিখি। আসলে আমি লিখি বেদনার অবমুক্তি, লিখি উদীয়মান সূর্যের কথা, প্রজন্মের প্রত্যাশিত মুক্তির কথা। দ্বিতীয় প্রসঙ্গে আসি আমি সাধারণত রাত ৮টা থেকে সাড়ে ৯টা লিখি এবং রাত ১১ থেকে ১২টা বা ১টা অব্দি পড়ি। প্রায় প্রতিদিনই এই রুটিন ফলো করতে চেষ্টা করি।

প্রশ্ন : আপনার গল্পের মাঝে জাদু বাস্তবতার প্রয়োগ দেখেছি। আমার প্রশ্ন হচ্ছে- জাদু বাস্তবতা ও আরব্য রজনীর মধ্যে পার্থক্য কোথায়?

উত্তর : আসলে ব্যাপারটা অনেকটা কাজল রেখা গল্পের মতো। যেমন ধরুন- কাঁকন দাসী এবং কাজল রেখা দুজনেই আল্পনা আঁকে। কিন্তু আমরা দেখতে পাই দুটোর শিল্পমানের ফারাক। আপনি যদি শহিদুল জহিরের কাঠুরে ও দাঁড়কাক, ডুমুর খেকো মানুষ, সৈয়দ শামসুল হকের রক্ত গোলাপ, জাকির তালুকদারের মাতৃহন্তা পড়েন দেখবেন গল্পগুলোর শিল্পোত্তীর্ণতা।নুসরাত সুলতানার অদ্ভুত গোলাপ বাগানও পাঠকের বিপুল প্রশংসা অর্জন করেছে। আমি মনে করি এই গল্পগুলো যাদু বাস্তবতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

প্রশ্ন : সবশেষে একটা প্রশ্ন করতে চাই। চাকরি, সংসার, লেখালেখি সমানতালে চালিয়ে যাচ্ছেন। রহস্যটা কী?

উত্তর : রহস্য দেশ, প্রজন্ম নিজের সত্যবোধের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং নিজেকে ভালোবেসে সুস্থ থেকে যথাযথ কাজটি করে যাওয়ার চেষ্টা করা। আর হল নিরবচ্ছিন্ন সৎ সাধনা।

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : এনাম আনন্দ (কবি ও শিশুসাহিত্যিক)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত