সবাই সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মায় না কেন। দুনিয়াতে এতো মানুষ, বেশিরভাগই দরিদ্র। দারিদ্র্য কি নিয়তির লিখন? লিমা আরো কত কীভাবে। সে শৈশব থেকেই অভাব অনটনের মধ্যে বড় হয়েছে। চোখের সামনে অবস্থাপন্নদের দেখে বৈষম্যের কারণ জানতে ইচ্ছে করে। যাদের ভালো অবস্থা তাদের মতো তার জীবন কেন হলো না। এ নিয়ে তার খুব আক্ষেপ। সবার সামনে সে নিজেকে সামর্থ্যবান হিসাবে তুলে ধরে। বানিয়ে বানিয়ে দু’চারটা কথা তার বলা চাই। এটা তার অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। তার সঙ্গী সাথীরা সবাই জানে লিমাদের আর্থিক অবস্থা। তারপরও তারা মেনে নেয়, লিমা যদি এটা বলে শান্তি পায় পাক। লিমার বিয়ে হয়। নিয়তি ছাড়ে না তার পিছু। সেখানেও স্বামীর আর্থিক অবস্থা ভালো না। এটা নিয়ে লিমার আক্ষেপের শেষ নাই। বাবার বাড়ির অবস্থা ভালো না, ঠিক আছে। স্বামীর বাড়ির অবস্থা ভালো হবে, এমন করে নিয়তি তৈরি হলে কী ক্ষতিটা হতো! ‘দুঃখে যাদের জীবন গড়া’ তাদের সারা জীবন দুঃখ বয়ে বেড়াতে হবে এমন কোন কথা আছে?
সে স্বামীর বাড়ির স্বচ্ছলতার কথা সবার কাছে বলে বেড়ায়। লিমা যে খুব চাপা মারতে পারে এটা সবাই জানে। লিমা যার কাছে যা বলে এটা নিয়ে কেউ লিমার সঙ্গে বাদ প্রতিবাদ করে না। তার কথায় স্বামী বাড়ি নিয়ে তার ফলাও প্রচার। স্বামী আমাকে দামি শাড়ি দিয়েছে, দামি গহনা দিয়েছে, ঘরে কত জৌলুস, দামি আসবাবপত্র। শ্বশুরবাড়ি নিয়ে আরো কত কথা। সবাই বুঝতে পারে এসব লিমার চাপা। এদিকে লিমা মনে মনে ক্ষোভে জর্জরিত। কেন দারিদ্র্যের মধ্যে তাকে জীবন পার করতে হচ্ছে। লিমা মাকে বলে, কেন তোমরা আমাকে দেখে শুনে বিয়ে দাওনি। আমাকে বিড়ম্বনার বোঝা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। নাহার মেয়েকে সান্ত¡না দিয়ে বলেন, মা তোর কপালে যদি সুখ থাকে তাহলে এখানেই সুখ হবে। আর যদি দুঃখ থাকে, সুখে থাকলেও দুঃখের বোঝা বইতে হবে। এটা নিয়ে ভাবিস না, সবই আল্লাহর ইচ্ছা। নিরুপায় মা একটা কিছু দিয়ে মেয়েকে বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করেন।
স্বামী আতিক লিমাকে খুব ভালোবাসে। লিমার কথা, শুধু ভালোবাসা দিয়ে কী হবে! টাকা পয়সা না থাকলে ভালোবাসার ভালো উবে যায়। টাকায় সুখ-শান্তি সব পাওয়া যায়। আতিক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, টাকায় সুখ-শান্তি হয় ঠিক আছে, আবার টাকায় সব সুখ-শান্তি কেনা যায় না এটাও ঠিক। লিমা স্বামীকে ঝামটা মেরে বলে, তুমি টাকা এনে দাও দেখো আমার সুখ-শান্তি আসে কিনা। আতিক বলে, যদি সেটা পারতাম তাহলে তোমাকে আমি সুখেই রাখতে চাইতাম। দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে রাখতাম না। কী আর করা পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন মেনে নিতে হবে। মেনে নিলে শান্তি পাবে। লিমা বলে, হ্যাঁ এছাড়া তোমার আর বলার কি আছে। আমি তোমাকে সান্ত¡না দেওয়া ছাড়া আর কী করতে পারি। তোমার হাতে কাজ নাই, কিছু করতে পারো না। হাতে তো কাজ আছে বউ, কাজ তো করি কিন্তু ভাগ্যের পরিবর্তন তো আসে না। দুর্দশায় পার করছি জীবন।
লিমা এখন এক পুত্র সন্তানের জননী। স্বামীকে বলে, তুমি তো আর আমাকে সুখের মুখ দেখাতে পারলে না। দেখো আমার ছেলে আমাকে ঠিকই সুখে শান্তিতে রাখবে। আতিক হেসে বলে, আমি না পারলেও আমার ছেলে পারলেই হবে। হঠাৎ করে বেচারা আতিকের অকাল মৃত্যু ঘটে। লিমা কাঁদে, আমাদের দুঃখের সাগরে ভাসাইয়া গেলা! কিছুই তো রেখে গেলা না। কীভাবে জীবন পার করব। স্বামী একজন নারীর কত বড় শক্তি আজ সে বুঝতে পারে। সে বিলাপ করে, সেই স্বামী ও আমাকে ছেড়ে গেল। হতভাগী আমি। লিমা একটা এনজিও তে চাকরি নেয়। অফিস থেকে ফিরে ছেলেকে বুকে নিয়ে সান্ত¡না খোঁজে। তার তো একটা ভরসা আছে। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে সব দুঃখ কষ্ট ভুলতে চেষ্টা করে। ছেলে ফরহাদ বুঝতে শিখেছে। মায়ের চোখের পানি মুছে বলে, মা আমি বড় হয়ে তোমাকে চাকরি করতে দেব না। আমি তখন চাকরি করব তোমাকে আর কাঁদতে দেব না। লিমা বলে, আমার বাবা তোমার মনের আশা আল্লাহ পূরণ করুক। তুমি বড় হও দোয়া করি।
ফরহাদের পড়ালেখা শেষ। তার আশা মায়ের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করবে। বিভিন্ন জায়গায় চাকরি খোঁজ করে। চাকরি হলো সোনার হরিণ, চাইলেই তো আর পাওয়া যায় না। লিমার কাছে ফোন আসে। ফোন ধরেই লিমা চিৎকার করে ওঠে। তার ছেলে রাস্তায় অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। আল্লাহ একি হলো আমার! আমি এখন কী করি। এ খবর জানার আগে আমার মৃত্যু কেন হলো না। সে হাসপাতালে ছুটে যায়। ছেলে তার হাসপাতালের শয্যায় মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে। অনেক টাকার প্রয়োজন, কী করবে কোনো পথ দেখে না। ছেলের পা যদি ঠিক রাখতে চায় তাহলে তাকে দ্রুত টাকার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু টাকার কোন ব্যবস্থা করতে পারে না সে। বান্ধবী মিলি অবস্থাপন্ন। তার কাছে টাকা চায়; কিন্তু সে টাকা দেয় না। মিলি ভাবে লিমাকে টাকা দিলে সে তো টাকা ফেরত দিতে পারবে না। তাই সে নানা বাহানায় অভাব দেখায়।
হায়রে দুঃখের কপাল, যেদিকে তাকায় সেদিকে শুকিয়ে যায়। লিমা বাসাভাড়া ঠিকমতো দিতে পারেনা বাড়িওয়ালা তাকে না বলে দিয়েছে। লিমা মিলির কাছে কিছুদিন থাকার জন্য আশ্রয় চায়। লিমার অসহায়ত্ব দেখে মিলির মায়া হয়। সে লিমাকে আশ্রয় দেয়। লিমা ভাবে মহা বিপদের মধ্যে থাকার জায়গা তো হলো। লিমার ছেলে ফরহাদ হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে অসহায়ের মতো কাঁদে। ছেলের কান্না মায়ের চোখে পড়ে। লিমার হৃদয় ছিঁড়ে যায়। বাবা কাঁদছিস আমি বুঝি তোর দুঃখ! ফরহাদ চোখের পানি লুকিয়ে বলে, না মা কাঁদছি না। লিমা বলে, বাবা মায়ের চোখ ফাঁকি দিতে চাস! ফরহাদ বলে, মা আমার পা নিয়ে তুমি ভেবোনা। টাকা থাকলে আমার পা দুটোর ভালো করার ব্যবস্থা করা যেত। আমার দুটি পা অপারেশন করলে ভালো হবে। কিন্তু থাক মা আমি এটা নিয়ে আফসোস করি না। তুমি আমার জন্য অনেক করেছ। কিন্তু আমি তো তোমার জন্য কিছু করতে পারলাম না। লিমা বলে, বাবারে আমার জন্য কিচ্ছু করতে হবে না। তুই বেঁচে থাক তাতেই আমার সব চাওয়া পাওয়া পূর্ণ হবে। লিমার হৃদয় বারবার কেঁপে ওঠে। পায়ের জন্য ছেলের নীরব কান্না দেখে। চিকিৎসা ব্যয় বহন করা গেলে ছেলের পা ভালো করা যেত। লিমার মাথায় কিছুই খেলে না। যে করেই হোক ছেলের পা ভালো করতে হবে। সে উপায় খুঁজতে থাকে এবং পেয়ে যায়। লিমা বান্ধবীর মিলির কিছু গয়না চুরি করে। চুরি করে মিলির বাসা থেকে পালিয়ে যায়। সেই গয়না বিক্রি করে ছেলের চিকিৎসা চালায়। ছেলের পা ভালো হয়। লিমা হাফ ছেড়ে বাঁচে। কিন্তু গহনা চুরির গ্লানি তাকে তাড়া করে ফিরে। ফরহাদ সুস্থ হয়। ছোট একটা ব্যবসা শুরু করে। ভাগ্য প্রসন্ন, সেই ব্যবসা ধীরে ধীরে অনেক বড় হয়। অনেক টাকার মালিক হয় ফরহাদ। লিমাভাবে একদিন পায়ের নিচে মাটি ছিল না আজ তার সব হয়েছে। সেদিন বান্ধবীর স্বর্ণ বিক্রি না করলে ছেলেকে সুস্থ করা যেত না। বান্ধবীর স্বর্ণ বিক্রি করে যে টাকা পেয়েছিল তার চেয়ে বেশি টাকা নিয়ে বান্ধবীর সামনে হাজির হয়। বান্ধবীকে টাকা দিয়ে বলে, তুই ক্ষমা করিস। আমি নির্লজ্জের মতো তোর স্বর্ণ নিয়ে পালিয়ে গেছিলাম। সেদিন সেই কাজটা না করলে আমার ছেলেটা ভালো হতো না। আমি দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। ছেলের কথা ভেবে সেদিন আমার ভালো-মন্দ কোন জ্ঞান ছিল না। তাই আমি চুরি করতে বাধ্য হয়েছিলাম। আজ আমার ছেলে সুস্থ অনেক টাকা পয়সার মালিক। তাই তোর টাকা তোকে ফেরত দিতে আসছি। যে শাস্তি তুই দিতে চাস আমি মাথা পেতে নেব। মিলি খুব খুশি হয়। লিমার হাত ধরে বলে, আসলে আমি কাণ্ড জ্ঞানহীন কাজ করেছিলাম সেদিন। আমি বরং নিজেকে অপরাধী মনে করছি। বিপদের সময় আমার উচিত ছিল তোর পাশে দাঁড়ানো; কিন্তু আমি তা করিনি। তুই সেদিন পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলি। আর সুদিনে সেটা বুঝতে পেরে আমার টাকা ফেরত দিতে এসেছিস এটা তো অনেক বড় ব্যাপার। সামাজিক বিবেচনায় কাজটা কোনভাবে সমর্থনযোগ্য না হলেও আমার মনে কোন অনুযোগ নাই। তুই যা করেছিলি আমি সমস্ত অন্তর দিয়ে তা মার্জনা করছি ইহকাল এবং পরকালের জন্য। লিমা বান্ধবীর টাকা পরিশোধ করতে পেরে মনে স্বস্তি পায়। তবে একটা নৈতিকতার কাঁটা তাকে বিদ্ধ করে দীর্ঘদিন।