‘পাড়ার লোকেরা আমার কবিগান শুনে মন্তব্য করিত, কালে এই ছেলেটি চেষ্টা করিলে একজন বড় কবিয়াল হইবে। কিন্তু তাহাদের সে ভবিষ্যৎবাণী সফল হইল না। আমি কবিয়াল হইতে পারিলাম না, হইলাম কবি জসীম উদদীন।’ জসীম উদদীন মূলত মধ্যযুগ এবং আধুনিক যুগের মধ্যকার বিচ্ছিন্নতার সাঁকো। যে সুতা ছিঁড়ে গিয়েছে সেই সুতা কিংবা দুটি প্রান্তের সংযোগ করতে চেয়েছেন। সেই সঙ্গে বাংলা কাব্যকে তিনি বাংলা কাব্যের গণমুখী নিজস্ব ধারায় রাখতে চেয়েছেন। এজন্য তার সাহিত্যে তিনি তাদের কথাই বলেছেন যাদের কথা তথাকথিত ‘আধুনিক’ বা ভদ্র-সাহিত্যে বলা হয় না। আধুনিক ভদ্র-সাহিত্য পাশ্চাত্য সাহিত্য এবং জীবনচেতনার প্রভাব সম্পর্কে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ সচেতন। ‘আধুনিক’ সাহিত্য যে নিচ থেকে উপরের সাধনা করেনি, এই সাহিত্য যে উপর থেকে নিচের সাধনা করেছে- অধিকাংশ সময় শুধু উপরের সাধনাই করেছে- সে বিষয়ে জসীম উদদীন সচেতন থেকেই নিজের সাহিত্য চর্চা করেছেন।
জসীম উদদীনের জন্মশত বছর হয়েছে দেড় যুগ আগে, মৃত্যুরও ৪০ বছর পার হয়েছে। তার বহুলপঠিত ‘কবর’ কবিতার প্রকাশের (১৯২৫) শতবর্ষের অল্পই বাকি আছে। নোবেল জয়, ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশের বাইরে এরকম প্রভাব সঞ্চারী ঘটনা, শতবর্ষ উদযাপনের এমন উপলক্ষ বাংলা কবিতা তো বটেই, বাংলা সাহিত্যেও খুব বেশি নেই। লক্ষণীয় যে, আধুনিককালে শুধু জসীম নন অনেকের হাতেই রচিত হয়েছে বিশেষ ধরণের কবিতা- বাংলায় আমরা যাকে বলি গীতিকবিতা। বাংলাসাহিত্যে বিহারীলাল এজন্যই বিখ্যাত। খোদ বিশ্বকবির হাতেও রচিত হয়েছে গীতিকবিতা।
বিশ্বসাহিত্যের যেটুকু আলো আমাদের কাছে পৌঁছেছে তাতেও রয়েছে কোলরিজ, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কিটস, কিপলিং, অস্কার ওয়াইল্ড, পুশকিন প্রমুখ লিরিক্যাল ব্যালাডস বা লৌকিক জীবনালেখ্য-ভিত্তিক কাহিনীকাব্য রচয়িতার নাম। আবার, প্যাস্টোরাল বা রাখালি কবিতাও কম পরিচিত নয় বিশ্বকাব্যের মানচিত্রে। জসীম উদদীন প্যারাডক্স হিসেবে আবির্ভূত হন ১৯২৮ সালে। সে বছর তার প্রথম ব্যালাডধর্মী কাব্য ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ প্রকাশিত হয়। আমরাও জসীম উদদীনের অধিকাংশ রচনায় চোখ রেখে বলতে পারি- এক বিস্ময়কর মানবপ্রেমী; বিশেষ করে দরিদ্র কৃষক, দিনমজুর, রাখালের প্রতি তার অসম্ভব মমতা লক্ষ্য করার মতো। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তথা বাংলার হিন্দু-মুসলমান উভয় সমাজের মানুষের যাপিত জীবন অসামান্য দরদে উপস্থাপন করেছেন। সমাজ বাস্তবতায় মানুষের জাগতিক দুঃখের রূপায়ণ করেছেন। সবসময় সহানুভূতিশীল ছিলেন নিপীড়িত ও অবহেলিত মানুষের প্রতি।
সেই তুলনায় বিরলপ্রজ মানুষদের একজন সেই সঙ্গে বাংলার মা মাটির সন্তান জসীম উদদীন। অসাম্প্রদায়িক বাংলার আলো-বাতাসে ‘মুসলিম তাঁর নয়নমণি হিন্দু তাহার প্রাণ’ আবহমান পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন দুর্লভ এই বৃক্ষ। সমন্বয়বাদী ও উদারপন্থি সাহিত্য সাধক বাংলার মানুষের জীবন-কর্ম নিয়ে অনবদ্য সৃষ্টি করে অমর হয়ে থাকবেন কাল থেকে কালান্তর।
খ. বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র যে আদর্শবাদ অনুশীলন করে চমকৃত করেছেন- সেই সমাজের রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে শরৎচন্দ্র একটু অতিমাত্রায় বিদ্রোহের সুরেই বাস্তববাদের পরশ লাগিয়ে আমাদের উচ্চকিত করে তুললেন। আর রবীন্দ্রনাথ এই আইডিয়ালিজম ও রিয়ালিজমের সমন্বয় সাধন করে অতি-প্রান্তিক ধারার সম্মিলন সাধন করে একমুঠো পথের ধুলো নিয়ে বললেন: ‘সোনা হও’। আর, অমনি সোনা হয়ে গেলো। অন্যদিকে ফিরে তাকালে দেখা যাবে- মধুসূদনের মহাকাব্য গড়ে ওঠে পৌরাণিক মহাকাব্য, বিশেষ করে, বাল্মীকির ‘রামায়ণ’কে আশ্রয় করে। কিন্তু, বীজ এ দেশের হলেও রস ও সার সঞ্চারের কাজ করেছেন বিদেশি হোমার, দান্তে, মিলটন থেকে। তেমনিভাবে, রবীন্দ্রজ্যোতি ভেদ করে আসেন নজরুল ইসলাম। তার কাব্যেও মূল প্রেরণা পুঁথি সাহিত্যের ঐতিহ্য হলেও তার নিজস্ব অনন্য প্রতিভার অনুকরণ সমসাময়িক বা উত্তরকালে সার্থকতা মণ্ডিত হয়নি। (সাহিত্য পত্রিকা, চৌত্রিশ বর্ষ, কাজী দীন মুহম্মদ, পল্লীকবি জসীম উদদীন ও তাঁর দুটি কবিতা)
জসীম উদদীন বহুমুখী আধুনিক ব্যক্তিত্ব। তিনি একাধারে কবি, কাব্যোপন্যাসিক, ঔপন্যাসিক, গীতিকার, ভ্রমণকাহিনীকার, নাট্যকার, স্মৃতিকথক, প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক ইত্যাদি বহুবিধ পরিচয়ে পরিচিত। তার ‘নকসী কাঁথার মাঠ’ ১৯৪০ সালের মধ্যে একাধিক ভাষায় অনূদিত হয়ে বিশ্ববিখ্যাত হয়। ১৯৬৯ সালে ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ ইউনেস্কোর অনুবাদ প্রকল্পে দ্বিতীয় গ্রন্থ হিসেবে অনূদিত হয়। এই বইয়ের ভূমিকায় কবি লিখেছিলেন-
“আমাদের ফরিদপুর অঞ্চলে বহু চাষী মুসলমান ও নমঃশূদ্রের বাস। তাহাদের মাঝে সামান্য ঘটনা লইয়া প্রায়ই বিবাদের সূত্রপাত হয়। এইসব বিবাদে ধনী হিন্দু-মুসলমানরা উৎসাহ দিয়া তাহাদিগকে সর্বনাশের পথে আগাইয়া দেয়। মহাজন ও জমিদারের মধ্যে কোন জাতিভেদ নাই। শোষণকারীরা সকলেই এক জগতের। ইহাদের প্ররোচনায় হতভাগ্য নমঃশূদ্র ও মুসলমানদের যে অবস্থা হয় তাহা চক্ষে দেখিলে অশ্রু সংবরণ করা যায় না।’ পাক-রুশ মৈত্রী সমিতির সহ সভাপতি ড. গস্কোওস্কির আমন্ত্রণে জসীম উদদীন সোভিয়েত রাশিয়া যান। কবির নিজের ভাষায়, ‘সারাজীবন আমার দেশের জনগণকে লইয়া সাহিত্য করিয়াছি। তাহাদের সুখ, দুঃখ, স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা, লইয়া কবিতা উপন্যাস লিখিয়াছি। আমার খুব বড় স্বপ্ন ছিল একবার সোভিয়েত দেশে যাইব। সে দেশের রাষ্ট্র কিভাবে তার জনগণকে সব চাইতে বড় আসন দিয়াছে ও কূপমণ্ডুকতা হইতে মুক্ত করিয়া উপরে তুলিয়া ধরিয়াছে’। লেনিন, সোভিয়েত দেশ ও সমাজতন্ত্রের প্রতি কবির গভীর শ্রদ্ধা ছিলো। সোভিয়েতের সেই ব্যবস্থা দেখে কবি বলেছেন, ‘ইস্ আমার বাংলাদেশে যদি এমন ব্যবস্থা থাকতো সকলে সোভিয়েত দেশের মতো সুখে থাকতো’। গ. আজও রোগে তার পথ্য জোটেনি, ওষুধ হয়নি আনা,/ ঝড়ে কাঁপে যেন নীড়ের পাখিটি, জড়ায়ে মায়ের ডানা।/ঘরের চালেতে হুতুম ডাকিছে, অকল্যাণ এ সুর, মরণের দূত এল বুঝি হায়। হাঁকে মায়, দূর-দূর। (পল্লী জননী) এটি কি আমাদের চিরায়িত বাংলার দৃশ্য নয়? জীবন সংসারের শাশ্বতরূপ তো এমনি হয়। এক কথায় জসীম উদদীন হতে চেয়েছেন গ্রামীণ মানুষের অলিখিত জীবনের রূপকার। বরাবরই সফল- কী গদ্যে, কী পদ্যে। কারণ, সেসময়ে রবীন্দ্র বলয় থেকে বের হওয়া দুরহ ছিল! সেই সঙ্গে ক্যালকুলেটিভ বুদ্ধদেব বসু যখন ইউরোপীয় সাহিত্য অনুবাদ শুরু করেন। পরিকল্পনাহীন কাজী নজরুল ইসলাম অনুবাদ করেন ওমর খৈয়াম, কাব্যে আমপারা। জসীম উদদীন স্বপ্ন-কল্পনার আচ্ছন্নতা কিংবা রূপকথার অলীক মায়ার কাছে তিনি নিজেকে সমর্পণ করেননি। শিল্পের ভেতর দিয়ে নিঃস্ব-নিপীড়িত-রিক্ত-ভাগ্যহীন গ্রামীণ মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ ও সহমর্মিতা পোষণই ছিল তার প্রতিজ্ঞা। প্রসঙ্গত, অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের কথা বলা যাক- মুসলিমপ্রধান পূর্ববঙ্গের লোকজীবনের মধ্যে গতানুগতিকতা সত্ত্বেও যে সজীবতা ও প্রাণময়তা আছে, তাকেই তিনি রূপ দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্মের লেখকেরা যখন নিত্য নতুন উপন্যাস উপহার দিচ্ছেন, তখন তিনি ছন্দে লিখছেন কাহিনী। প্রত্যাখ্যাত হওয়ার আশঙ্কা যে ছিল না, তা বলা যায় না। কিন্তু, হলো উল্টোটা। তার কাব্যের আবেগের, ভাষার চিত্রকল্পের অকৃত্রিমতা মন জয় করে নিলো আধুনিকমনা বাঙালি পাঠকের, বিদগ্ধ ইউরোপীয়দের। জসীম উদদীনের আবির্ভাবের পর আধুনিক বাংলা কবিতার কোনো যোগ্য সঙ্কলনে তাকে অবহেলা করা অসম্ভব ছিলো। (জসীম উদদীন : মানুষ ও কবি) বিশ্বগ্রামের যুগে কেউ জসীম উদদীনকে ‘পল্লীকবি’ হিসেবে প্রচার করলে তা হবে সাহিত্যচিন্তার চরম সংকীর্ণতা। তিনি গ্রামের সহজ-সরল মানুষের প্রাত্যহিক ভাবনাকে আধুনিক মনে অমায়িক দরদ দিয়ে বর্ণনা করেছেন।
বাংলার এই অসামান্য রূপকারকে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে- তিনি কাব্য-ভাব, ভাষা, চিন্তা, যুক্তি, শিল্পমানের গভীরতা, ভাষা ও কাহিনীর বুনন, কাব্য চয়ন, চিত্রকল্প, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক এবং প্রতীক বিনির্মাণে সত্যিকারের জীবনশিল্পী। গ্রামীণ জীবন তাকে ভীষণভাবে নাড়া দিতো- এ কথা আজো সত্য। কিন্তু, বিস্ময়করভাবে শব্দচয়নে তিনি সর্বোচ্চ আধুনিকতাকেই টেনে ধরেছেন। জীবনের সুরে, লাঙলের টানে, কৃষকের গানে, কিংবা মানুষের একাত্ববোধ তিনি নৈর্ব্যক্তিক ধারণায় নির্মাণ করেছেন। নদীমাতৃক বাংলাদেশের লোকজীবনের রূপায়ক জসীম উদদীন। পল্লীবিষয়ক কবিতার রচয়িতা তিনি- এ কথা সত্য। কিন্তু, এই দেশের মা-মাটি মানুষের প্রকৃতিগত জীবন জসীমের হাতে রূপ পেয়েছে অনন্যভাবে। সেই সঙ্গে তার জীবন ও কর্ম আধুনিক সাহিত্যেরই অংশীদার। পল্লী কবি বা আধুনিক কবি- এখানে পল্লীর সঙ্গে আধুনিকের যে সম্পর্ক বা দ্বন্দ্ব নেই তা শতভাবে উঠে আসছে।