বৈশাখ বাঙালির কাছে ধরা দেয় অন্যরকম বৈশিষ্ট্য নিয়ে। বৈশাখ, নববর্ষ আর রবি ঠাকুর এক অনন্য বন্ধনে বাঁধা। বৈশাখ তথা পহেলা বৈশাখ বাঙালি সংস্কৃতির এক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত দিন। বাঙালি ক্যালেন্ডারের এক মহিমান্বিত দিন, ২৫ শেখ বৈশাখ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। ১২৬৮ সালের পঁচিশে বৈশাখ কবিগুরু কলকাতার বিখ্যাত জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে জন্ম নেন। ৮ বৈশাখ ১২৯১ কবির সাহিত্যের সঙ্গী তার বৌদিদি কাদম্বরীর মৃত্যুদিন। কাদম্বরী দেবীর শোক রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতা ও গানে বিধৃত হয়েছে। তার বৈশাখী স্মৃতি মধুরতা খেয়ার কবিতাটিতে যেমন তেমনি দুটি গানেও বিধৃত হয়েছে।’ বৈশাখের এই ভোরের হাওয়া আসে মৃদুমন্দ
আনে আমার মনের কোণে সেই চরনের ছন্দ।/ পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব, আনন্দের সঞ্চার, কবিগুরুর গানে গানে বাঙালি গানে গানে আপ্লুত হয় বারবার।’ এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ/ মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা/অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’। বৎসরের প্রথম দিনে পহেলা বৈশাখে রবীন্দ্রনাথ বাঁধা জয়ের অভিযাত্রায় ডাক দিয়েছেন সকলকে, ‘এসো, এসো, দলে দলে বাহির হয়ে পড়ো- নববর্ষের প্রাতকালে পূর্ব গগণে আজ জয়ভেরি বেজে উঠেছে। সমস্ত অবসাদ কেটে যাক জয় হোক তোমার,জয় হোক তোমার প্রভুর। কালবৈশাখীর কালো মেঘ আকাশ আচ্ছন্ন করে ফেললেও অভয়বানী শুনিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। মানুষ কে সাড়া দিতে হবে, বুক পেতে গ্রহণ করতে হবে এ ঝড়কে। কারণ নড়বড়ে যা কিছু সব ভেঙে শক্ত দৃঢ় ঘাতসহ যা কিছু তাই অক্ষত থাকবে নতুন যাত্রার অবলম্বন হিসেবে। বৈশাখ যদিও সাহসী বৈরী অশান্ত তবু তার সৃষ্টিশীলতা কল্পনাকেও হার মানায়। প্রেম প্রকৃতি আর মানুষের গান নিয়ে রবি এলেন বৈশাখে আমাদের মাঝে একরাশ পূর্ণতা নিয়ে। কবিগুরু বৈশাখ কে আমাদের মাঝে উপস্থাপন করেছেন বিশেষ দর্শন নিয়ে। বাঙালি ঐতিহ্যের প্রাচীনতম ধারাবাহিকতায় বাউল জারি সারি আর কীর্তন আবহমান কাল ধরে চলে আসলেও রবির আবির্ভাবের পর বাঙালির বৈশাখ উদযাপন অনেকটা বদলে গেছে। হয়তো এ মাসে জন্য নিয়েছিলেন বলে এ মাসের প্রতি বিশেষ টান কবিগুরুর। পৃথিবীর সকল বাঙালি বর্ষ বরণের সাথে নিজেকে একাত্ম করে বৈশাখের আনন্দ ধারায়। বিশ্বকবি নিজের মতো করে বৈশাখ পালনের মাধ্যমে দিনটি কে আরো মহিমান্বিত করেছেন। বৈশাখে বর্ষবরণের যে ধারা অব্যাহত আছে রবীন্দ্রনাথের এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ, কাহারবা তালের এই গানের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি ভাবনার এক নিপুণ নির্মাণ এর পরিচয় পাওয়া যায়। বৈশাখ এলে আমরা অনুভব করি অসাম্প্রদায়িক এই সাংস্কৃতিক উৎসব কতটা শক্তিশালী। রবীন্দ্রনাথের গানের ‘ মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা শুচি হোক ধরা’ চরণটি যেন সমস্ত বাঙালির প্রাণের কথা। কবিগুরু চেয়েছেন সমস্ত জরা ব্যাধি বৈশাখী বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে অগ্নিস্নানের এক অপরূপ স্নিগ্ধতার সন্ধান পেতে। কল্পনা কাব্যের বৈশাখী কবিতায় কবি লিখেছেন’ হে ভৈরব হে রূদ্র বৈশাখ/ ধুলায় ধূসর রুক্ষ উড্ডীন পিঙ্গলা জটাজাল/ তপ্তক্লিষ্ট তপ্ত তনু মুখূ তুলে বিষান ভয়াল/ কারে দাও ডাক/ হে ভৈরব হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ।’
কবিগুরু তার বলাকা কাব্যের ছবি কবিতায় লিখেছেন, ‘এই ধুলি / ধূসর অঞ্চল তুলি / বায়ু বয়ে ধায দিকে দিকে/ বৈশাখে সে বিধবার আবরণ খুলি/ তপস্বিনী ধরনীকে সাজায় গৈরিকে। বিশিষ্ট রবীন্দ্র- বঙ্কিম গবেষক অমিত্রসুদন ভট্টাচার্য লিখেছিলেন- বাঙালির গর্বিত সংস্কৃতির ইতিহাস বেঁচে আছে দু’তিনটা বাংলা তারিখ ১ বৈশাখ, ২৫ শেখ বৈশাখ, ২২ শ্রাবণ, ৭ পৌষ (শান্তি নিকেতনের পৌষ মেলা)। এর মধ্যে তিনটিই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাপুরষটিকে ঘিরে’। ১৩৪৪ সালের ১ বৈশাখ শান্তি নিকেতনে চীনা ভবনের উদ্বোধন হয়। রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ নববর্ষ ১৪৪৮ বঙ্গাব্দে সভ্যতার সংকট পঠিত হয়। আর গাওয়া হয় ‘ঐ মহামানব আসে’।
পয়লা বৈশাখ নিয়ে একটা ভিন্ন রকম কথা বলেছেন সনজীদা খাতুন তার ‘আমার সোনার বাংলা’ বইতে। তিনি লিখেছেন- পয়লা বৈশাখ ভোরবেলায় আনন্দে মেতে উঠি আমরা। শুরু হয় গান আর কবিতা পাঠ করে। তুমি নির্মল কর, মঙ্গল কর/ মলিন মর্ম মুছায়ে কিংবা নব আনন্দে জাগো আজি, এইসব গান গেয়ে।
বৈশাখ আর রবীন্দ্রনাথ যেন একে অন্যের পরিপূরক। বৈশাখ এলেই রবীন্দ্রনাথ এসে যায়। আবার রবীন্দ্রনাথ এলে বৈশাখ এসে যায়।