কবিতা মানে আবিষ্কার। কবিতা হবে কবির মতো। সেই সূত্রে একজন কবিই তার কবিতার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। কবিতাকে হওয়া উচিত সুঠাম নারীর কোমরের মতো তীক্ষè, তেমনি প্রশস্ত নিতম্বের মতো দায়িত্বশীল। লোভনীয় টকের রসায়নে রসসিক্ত প্রকৃত কবিতা যেন জল আসা জিভের জৈবহন্তারক। গৃহযুদ্ধের দেশে যেমন অতর্কিত ঘুমের মধ্যেও জেগে থাকে অতি বিপ্লবীরা...। অপরাধবিজ্ঞানে কবি-সাহিত্যিকদের বলা হয় পেশাগতভাবে মিথ্যাবাদী। ব্যাখ্যায় বলা হয়, মিথ্যা-টিথ্যা লেখাই তাদের পেশা। দীর্ঘ বছর এ-পথে হেঁটে এটুকু উপলব্ধি হয়েছে, কবিতার জন্য ছন্দের ওপর দখল না থাকলে ছন্দের সীমা অতিক্রম করা যায় না। এমনকি উপযুক্ত ফ্রি-ভার্স লেখাও অসম্ভব হয়ে পড়ে। কবিতা কবির সৃষ্টিধর্মী কাজ। শব্দের পবিত্র শিখা দিয়ে একে প্রজ্বলিত করার দায়ভার একমাত্র কবিরই।
অনেক সূক্ষ্ম অনুভূতি, নানা ইন্দ্রিয়-অভিজ্ঞতা ভাষায় মূর্ত হয়ে ধরা দেয় কবিতার পরতে পরতে এবং কে না জানে, অনুভূতির ভাষাই শাশ্বত, সর্বজনীন। বুদ্ধি ও যুক্তির ভাষা যেখানে গিয়ে হয়ে পড়ে অকার্যকর, সেখান থেকে শুরু হয় অনুভূতির ক্রীড়া; শুরু হয় লীলা, অনুভূতি আর অনুভূতিময় ভাষার। কবিতায় কবির নিজস্ব ভাষা, স্বর, সুর বহন করাটা জরুরি, গোপন গুপ্ত রোগের মতো নিজেরই অজান্তে। কুহক-ছড়ানো রূপময় ল্যান্ডস্কেপে দাঁড়িয়ে তিনি ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েন আমাদের নীরব নিউরনে।
প্রকৃত অর্থে কবি হবেন বহুদিশাময়। ঝরনার মতো অনর্গল ঝরবে তার কলম থেকে শব্দের ফুলঝুরি। তিনি হবেন বিস্তৃত। দেখায়, ভাবনায়, স্পর্শেবর্ণে হবেন বহুমাত্রিক লীলাময়। কবিতা কখনোই হুট করে লেখার বিষয় নয়। টাটকা বীজসত্তা নিয়ে প্রথমে তাকে কবির গর্ভেই পুষ্ট হতে হয়। সময় হলে সে জানান দেবে। ঠিক তখনই কবি তার আপন ভাষায়, নিজস্ব ডিক্সন দিয়ে পৃথিবীর আলো-বাতাসে ছাড়ার অনুমতি দিয়ে করবে তার আত্মপ্রকাশ। ভাব, ভাষা, ছন্দ এই তিনের সন্নিপাতে গড়ে ওঠে কবিতা। কবিতার মধ্যে সব সময় একটা ধাঁধা থাকবেই। কবিতা লেখার কাজ খুব সহজ-এ ভাবনা থেকে আমাদের নিষ্কৃতি নিতে হবে। কেননা কবিতা কেবল এক জায়গায় আলো ফেলবে না, সে আলো ছড়িয়ে যাবে সবখানে।
আমার মতে কবিতার জন্য দুগ্ধপোষ্য শব্দের চেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক শব্দই বেশি কর্মঠ। কবিতা একার নয়, ব্যক্তি ছাড়িয়ে তা সবার হয়ে উঠুক। কবিতা লেখার দায় কবির, পাঠকের দায় কবিকে স্বীকৃতি দেওয়া। কেননা, কবিতা শুধু বাজবার জন্য নয়, বাজাবার জন্যও। কোনো শিল্প সৎ অথচ অধিকাংশ লোকের কাছে দুর্বোধ্য-এ কথা বলাও যা, তেমনি কোনো খাবার খুবই উৎকৃষ্ট অথচ অধিকাংশ লোকের অনাস্বাদ্য-এ কথা বলাও তাই। কাজেই কবিতা লিখতে গিয়ে ব্যাপারটা মাথায় রাখা জরুরি। কবিতার ভাষা মানে ‘ভাবের ভাষা’, পরিপাট্যের চেয়ে তার প্রয়োজন ভাবাত্মক হয়ে ওঠা। কবিতাণ্ডকখনো সে ঝিলিক দেয় নিত্যকিরিচের মতো। কখনো বা জং-ধরা ভিখারির থালার মতো পড়ে থাকে অচেনা ধুলোয়। নানা ম্যাজিক আর মেঘ এসে ভর করে আমার ওইসব কবিতার পথে।
আমার দেখা, না-দেখা, বোঝা, না-বোঝার ত্রিশঙ্কু এই ভুবনে তবু সে প্রবেশ করে। কাজেই অজাত সতিনের আকার নিয়ে সে এসে হানা দেয় রোজ। নানা উসকানি, মশকারায় নিষিদ্ধ প্রলোভনে সে শুধুই ডাকে। তাকে লিখতে বলে। আমি লিখি, আমি কাটি। গ্রহণে, প্রত্যাখ্যানে অস্থির এক ঝড় বয়ে যায় মগজ, মন, কোষ, কণিকা, হাড়ের অভ্যন্তরে। কখনো সে জিতে যায়। কখনো বা হারে। আমি ঘুমিয়ে পড়ি সদ্য লেখা কবিতার আশপাশে প্রতিটি পঙ্ক্তিকে সজোরে সাপটে ধরে।
কবিতা হলো- তাই-ধরা যাক সবুজ কচুরিপানায় ভর্তি কোনো পুকুর। আপাত দৃষ্টিতে কোনো জাজমেন্টেই যার হিসাব মেলে না। ফলে ভয় হয়, যদি একবার পা পিছলে পড়ে যাই। নিচে তার কী আছে? কতটা গভীর? বোঝা বড় দায়। এই তল-অতলের বিভ্রমে কেটে যায় সারাটা বেলা। চরম সভ্যতার মাঝেও টুপ করে ডুব দেয় গভীর এক অন্ধকার। নেমে আসে রাত। কখনো তা আশ্বিনের। কখনো হেমন্তের। শ্মশান না থাকলে শব-সাধন হয় না। প্রত্যেক সাধনায় সাধনপীঠের প্রয়োজন হয়। প্রকৃত কবিতার সাধনপীঠ কোথায়, কোনদিকে, কতদূর নিজ মর্মে হে মন আজও তা স্পষ্ট হলো না। মনে হয় সে কারণেই ভবিষ্যতে যেতে চাইলে আমাদের অতীতগুলো বারবার ঘুরে দেখা দরকার। বুঝি রাত ও নারীর মতো কবিতা চিরকালই রহস্যময়। সে আমাদের হাতছানি দিয়ে ডেকে নিয়ে যায়, যাবে। শয়তানের মতো ঘরছাড়া করবে শান্ত-সুবোধ সেসব বালক কিংবা বালিকাকে। গোপনে গোপনে সে নিরাকারের রূপ ধরে হানা দেয় আমাদের সমস্ত আর সামগ্রিক ইন্দ্রিয়তে। আর তখনই আকার হয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে চায় প্রত্যেকের বুকে ও বাহুতে। আমি সেই কবিতার চারায় পানি ঢালতে রাজি-যে কি না হয়ে ওঠে প্রতীকে প্রজ্বলিত, যার স্তরে স্তরে নানা বিভঙ্গে ফুটে থাকে চিত্র আর কল্পনার জটিল মিথস্ক্রিয়া। যে কি না আততায়ীর রূপে নিঃশব্দে ছুরির ছোবল হানতে পারে সরাসরি আমাদের মেধার মর্মমূলে। তখনই কবিতা, যখন সে হয়ে ওঠে নানা দ্যোতনার। বিবিধ চিহ্ন ও সংকেতে যে কেবল অজর-অমর জিজ্ঞাসার দিকে নিজেকে ধাবিত করে। পল হতে পলকে, চূর্ণ হতে বিচূর্ণর দিকে।
মনে করা হয় মিসরীয়রা বিষাক্ত পাথরের ব্যবহার জানত। তারা কবিদের মতো বিষ মেশানোর পদ্ধতি শিখেছিল। অর্থাৎ কবিরা যেমন মেশাতে শেখে শব্দ। কবিতার অনুভব চিরকাল বেদনার রঙে রঞ্জিত, কবিতায় নিহিত অভিজ্ঞতা রিক্ততার বিষে নীল-এর ইতিহাস বুকের রক্ত আর চোখের জলের ইতিহাস। সতত জাগ্রত ছাড়া ফাঁকি দিয়ে কবিতা লেখা অনেকটাই টাফ। যেমন বনভোজনের শেষে ভাতঘুম দিয়ে যে কবিতা রচিত হবে তার ভাগ্যে পুরস্কারের চেয়ে তিরস্কারের পাল্লাই যে ভারী হবে, সে কথা সামান্য একটি ভাঁটফুলও জানে।
অহংই চৈতন্য। এই চেতনা থেকেই বেরিয়ে আসে নানা সৃষ্টি। কবিতা হলো অহংয়ের ফসল। যেকোনো পথের মতো কবিতারও শুরু আর শেষ বলে কিছু নেই। যন্ত্রণা বায়বীয় হলে তা অপরের মনে জমাট বাঁধে না। কবিতায় জনপ্রিয়তা অর্জন একজন কবির কাম্য নয়, তার কাম্য কালোত্তীর্ণ কবিতা নির্মাণে অসম্ভবের সাধনা করে যাওয়া। এ কথা ঠিক কবিতা লিখতে না পারার হতাশা কবিকে কখনো কখনো উন্মাদ করে তোলে। আসলে কবিতা, সে তো অভিজাত ঘরের নববধূ। বিভিন্ন ভাসুরকে-শ্বশুরকে এড়িয়ে নানা জাতের ঘোমটা দিয়ে তাকে চলতে হয়।
মানুষের একটা বড় মুশকিল হলো, সবকিছুই সে বুঝে নিতে চায়। শূন্যে গিয়ে খোঁজে কোথায় চরাচরের সংগুপ্ত রাহসিকতা, তারা ভাবে আপেল কেন মাটিতে এসে পড়ে, ইত্যাদি ইত্যাদি...। কবিতা গভীরতম দেশ থেকে উদিত হয়, কবিতা বুদ্ধিমত্তার অতীত। কবিতা প্রজ্ঞাবোধের সঙ্গেও সম্পৃক্ত নয়। কবিতা এমন কিছু, যার সবকিছুই একান্ত নিজস্ব-এর প্রকৃতিও তাই নিজস্ব, সংজ্ঞাতীত কবিতা হলো মায়ার খেলা। ঘোরের মধ্যে ঘূর্ণির ওঠানামা। রহস্য আর সাহসের মোহময় পঙ্ক্তিমালা। ভাবতে ভালো লাগে, আমাদের হৃদয়-নিংড়ানো কথাগুলো, ভাবনাগুলো লাফিয়ে উঠছে দ্রুত। ফসফরাসের মতো সাদা আর নীল দাঁত দিয়ে ছোবল মারছে নৈঃশব্দ্যের গায়ে। সত্যিকারের কবি যেন সার্কাসের সেই বাঘ, যে কি না জীবন-মৃত্যুকে মুঠোয় বন্দি করে অবলীলায় লাফ দিতে পারে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনের রিঙে!