সাহিত্য সাধনার দিক থেকে আলেকজান্ডার সের্গেইভ পুশকিন এবং কাজী নজরুল ইসলাম এই দুই মহান কবির মধ্যে বিস্ময়কর মিল পুশকিন এর জন্ম ১৭৯৯ সালে আর কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ১৮৯৯ সালে। দুইজনে অত্যন্ত খ্যাতিমান কবি যারা সাহিত্যের জগতে স্থায়ী প্রভাব ফেলেছেন। দুই কবির কাব্যভাবনায় প্রগতিবাদী চিন্তায় আর স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। রুশ সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি আলেকজান্দার পুশকিন এবং সাহিত্যের জনক হিসাবে পরিচিত। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার। ঙফব ঃড় খরনবৎঃু স্বাধীনতার গাঁথা শিরোনামের একটি বিদ্রোহাত্মক কবিতা লেখার কারণে জার সরকার পুশকিনকে নির্বাসন দিয়েছিল ককেশাসের দুর্গম পর্বত এলাকায়। পুশকিন ‘দা প্রিজনার অফ দ্যা ককেশাস’ লিখে তীর বিদ্ধ করেছিলেন জার সরকারের হৃদপিণ্ডে। ঠিক তেমনি কবি কাজী নজরুল ইসলামকেও ব্রিটিশ সরকারের কারা নির্যাতন ভোগ করতে হয়। ‘বিদ্রোহীর কৈফিয়ত’ আর ‘আনন্দময়ীর আগমন’ এই দুটি জ্বালাময়ী কবিতার জন্য।
এছাড়াও ভাঙার গান, অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ রচনা করে ক্ষতবিক্ষত করেছিলেন ব্রিটিশ সরকারের ক্ষমতার দুর্গ। আলেকজান্ডার পুশকিন এবং কাজী নজরুল ইসলাম উভয়েই ছিল গণমানুষের কবি এবং স্বাধীনতা ও গণমুক্তির প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। আধুনিক রুশ লেখক ও পাঠকদের বারবার ফিরে যেতে হয় পুশকিনের কাছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে পরিচিত কাজী নজরুল ইসলাম যার কবিতায় তার বিপ্লবী চেতনা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি অদম্য অঙ্গীকার। যার দুয়ারে বারবার কড়া নাড়তে হয় আমাদেরও। এই জাতির মুক্তির জন্য নজরুলের সেই বিখ্যাত গান ‘কারার ওই লৌহ কপাট, ভেঙে ফেল কররে লোপাট’ তার এই অসামান্য অবদান জাতি কখনোই ভুলতে পারবে না।
উভয় কবিই তাদের শিল্পকে সামাজিক ভাষ্যের একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। পুশকিনের কবিতা সমাজের অন্যায়ের সমালোচনা করে এবং স্বাধীনতা ও সাম্যের আদর্শকে সমর্থন করে। পুশকিনের সাহিত্যিক অবদান রাশিয়ান সাহিত্যিক ঐতিহ্য গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। একইভাবে, কাজী নজরুল ইসলাম একাধারে কবি, সাংবাদিক, এবং রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে স্বাধীনতার জন্য আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন সাম্রাজ্যবাদী যুগে। কবি কাজী নজরুল ইসলাম গান, গজল, গল্প, নাটক, উপন্যাসে, ব্যঙ্গ রচনায় ভরাট করে তুলেছিলেন বাংলা সাহিত্যকে। পাশাপাশি শিশুতোষ রচনায়ও। বিদ্রোহ বিপ্লবী আগুনঝরা কবিতায় বাংলা সাহিত্যে যেমন জুড়ি নেই। তেমনি শিশু সাহিত্যেও, কাঠবিড়ালি, লিচুচোর, প্রভাতী, ঝিঙ্গেফুল ইত্যাদি সাহিত্যে এরকম ছড়া কবিতা আর সৃষ্টি হয়নি। ঠিক পুশকিনও ছোট গল্প, উপন্যাস, নাটক এবং রূপকার গল্পে ভরে তুলেছিলেন রুশ সাহিত্যে। রুসলান, লুদমিলা ও ঘোড়সওয়ার সারাজীবন শিশুদের মনে আনন্দ দিবে। সাহিত্য সাধনার আয়ুর দিক থেকে দুই কবির অদ্ভুদ মিল খুজে পাওয়া যায়। পুশকিন বেঁচে ছিলেন মাত্র আটত্রিশ বছর। ১৮৩৭ সালে দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি। ১৯১৮ সালে প্রথমে গল্প ও কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে নজরুল পা রাখেন সাহিত্যের আঙিনায়। ১৯৪১ সালে এসে সাহিত্য সাধনার ইতি ঘটে নজরুলের। পুশকিন এবং নজরুলের পটভূমি এবং প্রভাব তাদের কাব্যিক দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। পুশকিন যখন সামন্ত রাশিয়ার সামাজিক অবিচার থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছিলেন, নজরুল ভারতে ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। তাদের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও, উভয় কবিই সাধারণ মানুষের সঙ্গে সহানুভূতি এবং সংহতির গভীর অনুভূতি ভাগ করে নিয়েছিলেন তাদেরকে গরীব দুঃখী মানুষের কবি হিসাবে স্বীকৃতি পায় এবং সারা বিশ্বের মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে।