ঢাকা শুক্রবার, ০৯ মে ২০২৫, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

তুষার বনে ভিন্ন মানুষ

তুষার বনে ভিন্ন মানুষ

আলম শাইন
তুষার বনে ভিন্ন মানুষ

এক : শীতকালজুড়ে মস্কোর আকাশ প্রায়ই ঘন তুষারের আবরণে আচ্ছন্ন থাকে। কখনো টানা দুই সপ্তাহ, কখনোবা তারও বেশি সময় ধরে সূর্যের দেখা মেলে না। সেই অনুজ্জ্বল দিনগুলোতে শহরজুড়ে নেমে আসে এক নিঃশব্দ নীরবতা। এমন প্রতিকূল পরিবেশে তবুও মস্কো তার সৌন্দর্য হারায় না। কখনো শুভ্র তুষারের মোড়কে, কখনো বসন্তের মৃদু উষ্ণতায় নিজেকে নতুনভাবে সাজিয়ে তোলে। বিশেষ করে শীত মৌসুমে গোটা রাশিয়া এক অপার্থিব মায়ায় ভরে ওঠে, মনে হয় তখন প্রকৃতি নিজ হাতে শহরজুড়ে এঁকে দিয়েছে এক নৈসর্গিক চিত্রকর্ম।

মস্কোতে আজ কনকনে ঠান্ডা; তাপমাত্রা হিমাঙ্ক ছুঁই ছুঁই করছে। তথাপিও মস্কোবাসীর জন্য এটা একটা আরামদায়ক আবহাওয়া। আনন্দ উৎসবে যোগ দিতে অথবা দূরযাত্রায় এমন আবহাওয়া মস্কোবাসীর জন্য অনুকূলে। আর ঠিক এমন সময়ের প্রতীক্ষায় থাকে পর্যটকের দল। তাদের সেই অপেক্ষার প্রহর শেষ হতেই নতুন এক অভিযানের প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ‘রোসিয়া এক্সপ্রেস’।

মস্কোর ‘ইয়ারোস্লাভস্কি’ রেলওয়ে স্টেশন’ থেকে ট্রেন ভ্লাদিভোস্টকের উদ্দেশে ছেড়ে যাবে অল্প সময়ের মধ্যেই। পৃথিবীর দীর্ঘতম রেলপথ ‘ট্রান্স-সাইবেরিয়া’ পাড়ি দেবে ‘রোসিয়া এক্সপ্রেস’। শূন্যের নিচে তাপমাত্রা আর পিঠে জমে থাকা তুষারকণা নিয়ে সাত দিনের মধ্যেই গন্তব্যে পৌঁছাবে। পুনরায় মস্কো ফিরতে ফিরতে আরও সপ্তাহ খানেকের বেশি সময় পেরিয়ে যেতে পারে। সেই ধারাবাহিকতায় যাত্রার জন্য প্রস্তুত ট্রেন। যাত্রীরা এরইমধ্যে তাদের নির্ধারিত কোচ ও কেবিনে উঠে বসেছে। সাত নম্বর কোচের নয় নম্বর কেবিনে বসেছে দুই বাংলাদেশি যুবক; কালিম উল্লাহ গালিব ও সাইফ হাসান সোপান। বয়স বড়জোর ত্রিশের কোঠায়। তারা ‘মস্কো সেস্ট ইউনিভার্সিটি’ থেকে নৃ-বিজ্ঞানে পোস্ট গ্র?্যাজুয়েট ডিগ্রি সম্পন্ন করে বর্তমানে এমফিলের জন্য গবেষণা করছে। থিসিসের মান ভালো হলে তাদের পছন্দের প্রফেসর ডক্টর ম্যাকসিম নিকোলায়েভিচণ্ডএর অধীনে পিএইচডি করার সুযোগ পাবে। পিএইচডি সম্পন্ন হলে মস্কোর নামকরা কোন ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করার চেষ্টা করবে দুই বন্ধু। মস্কোতে চার-পাঁচ বছর ধরে পড়াশুনার কাজে ব্যস্ত তারা। দীর্ঘদিন বাইরে থাকায় দেশে ফিরতে মরিয়া হয়ে উঠেছে দু’জন। বাংলার মাঠপ্রান্তর, ভোরের কুয়াশা, দীপজলা সন্ধ্যা, নয়নাভিরাম মেঠোপথ তাদেরকে বারবার হাতছানি দিয়ে ডাকছে দেশে ফিরতে। তাই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যত দ্রুত সম্ভব দেশ ফিরে যাবে। তার আগে দুজন দক্ষিণ-পূর্ব সাইবেরিয়ার হাড় হিম করা শীতল রাজ্য ‘বুরিয়াতিয়া’র রহস্যময় বৈকাল পর্বতমালায় থিসিসের কাজে যাবে। ওখানকার আদিবাসী ‘সয়ত’ সম্প্রদায়ের জীবন যাপন নিয়ে গবেষণা করবে। গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একেকজন এক লাখ রুবল প্রণোদনা হিসেবে পেয়েছে। প্রাপ্ত প্রণোদনার সঙ্গে নিজেদের উপার্জিত কিছু রুবল যোগ করে মাস দেড়েকের জন্য বৈকাল পর্বতমালার গহিনে অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ‘বুরিয়াতিয়া’ রাজ্যকে গবেষণার স্থান হিসেবে বেছে নেয়ার কয়েকটা কারণও আছে। তার মধ্যে প্রধান কারণ হচ্ছে, বিখ্যাত ট্রান্স-সাইবেরিয়ার রেলপথ পাড়ি দেয়া, বৈকাল হ্রদ আর তৈগা বনাঞ্চল পরিদর্শন করা। বিশেষ করে তাদের প্রথম যাত্রা বিরতি হবে বৈকাল রেলওয়ে স্টেশনে। সেখানে দু-একদিন কাটিয়ে বৈকাল পর্বতমালার উদ্দেশে রওনা দেবে। নানান বিষয় চিন্তাভাবনা করেই গবেষকেরা থিসিসের বিষয়বস্তু হিসেবে ‘সয়ত’ সম্প্রদায়কে বেছে নিয়েছে। যদিও বিষয়টা মারাত্মক চ্যালেঞ্জের; তথাপিও ঝুঁকি নিতে বাধ্য হয়েছে সয়ত সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রার প্রতি উৎসাহিত হয়ে।

পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বিকেল চারটার আগেই ট্রেনে চেপে বসেছে গবেষকেরা। মস্কোর টাইমজোন অনুযায়ী ট্রেন সন্ধ্যা সাড়ে চারটায় স্টেশন ত্যাগ করবে। তারপর দীর্ঘ পথচলা; প্রায় তিন-চারদিন লেগে যাবে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছতে। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, কয়েকটা আন্তর্জাতিক টাইমজোন পেরিয়ে যাবে বৈকাল পর্যন্ত পৌঁছতে পৌঁছতেই। অন্যদিকে ভ্লাদিভোস্টক পর্যন্ত পৌঁছতেই পেরিয়ে যাবে ৮টা টাইমজোন। দীর্ঘ এই জার্নিতে রয়েছে রাজ্য জয়ের মতো বিশাল এক আনন্দ। যে আনন্দ বিমানে বসে উপভোগ করা যায় না। ট্রেন জার্নির পেছনে এটাও বড় একটা কারণ।

গবেষকেরা কেবিনে ঢুকে জিনিসপত্র গোছগাছ সম্পন্ন করতেই ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠল। ট্রেন নড়েচড়ে উঠল। দীর্ঘ যাত্রার জন্য ইঞ্জিন প্রস্তুত। আজকের আবহাওয়া মস্কোবাসীর জন্যে যথেষ্ট অনুকূলে। সাধারণত মস্কোতে এপ্রিল মাসে প্লাস মাইনাস মিলে তাপমাত্রা ওঠানামা করে। শীত আর উষ্ণতার অনুভব পাওয়া যায় তখন। অন্যদিকে একেবারেই ভিন্ন চিত্র দেখা যায় সাইবেরিয়ায়। সেখানে এপ্রিলেও তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নামে। আর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির চিত্র তো আরও ভয়াবহ; অঞ্চলভেদে তখন শূন্যের নিচে ৫০ থেকে ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে যায় পারদ। হাড় হিম করা ঠান্ডার বিষয়টা চিন্তা করেই ট্যুরিস্টরা এপ্রিল-মে মাসকে জার্নির জন্য বেছে নেয়। যেমন গবেষকরা এপ্রিল মাসটাকেই বেছে নিয়েছে। এতে খানিকটা হলেও ঠান্ডা মানিয়ে নিতে পারবে। দীর্ঘদিন ধরে তারা মস্কোতে বসবাস করছে, তাই এখানকার হিমাঙ্কের নিচের তাপমাত্রা মোকাবিলায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।

কাটায় কাটায় ট্রেন সাড়ে চারটায় ছেড়েছে। ততক্ষণে মস্কোতে রাতের আঁধার নামতে শুরু করেছে। যদিও হরেক রকম আলোর ঝিলিকে আঁধার অনুভূত হচ্ছে না, তথাপিও অনুমান করা যাচ্ছে। শহর পেরুতে এখনো পঁয়ত্রিশ মিনিটের মতো সময় লাগবে। তারপর ক্রমশ ট্রেন হিম শীতল রাজ্যের দিকে ধাবিত হতে থাকবে। এভাবেই রাতদিন ছুটতে ছুটতে ট্রেন একসময় পৌঁছে যাবে গন্তব্যে।

কেবিনে ঢুকে জিনিসপত্র গোছগাছ শেষ করে গবেষকরা নানান গালগল্পে মেতে ওঠল। প্রসঙ্গক্রমে গালিব বলল, ‘জানো, কখনো ভাবিনি ট্রেনে ছড়ে বৈকাল যাব; তাও আবার গবেষণার কাজে।’

সোপান দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘বিষয়টা আমিও ভাবিনি। এখন ভালোয় ভালো গন্তব্যে পৌঁছতে পারলেই হয়।’ ‘বৈকালে পৌঁছানোটা বড় কথা নয়; বড় কথা হচ্ছে ওখানকার তাপমাত্রায় নিজদের মানিয়ে নেওয়া।’ ‘তাপমাত্রা নিয়ে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। যতটা জেনেছি দক্ষিণ-পূর্ব সাইবেরিয়ার তাপমাত্রা এপ্রিলে মাইনাস ১ থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যেই থাকে। এই তাপমাত্রা তো আমরা অনেক সময় মস্কোতে বসেই মোকাবিলা করছি।’

‘তোমার কোথায় যুক্তি আছে; ভরসাও পাচ্ছি। দেখা যাক কী হয়। পরিস্থিতিই বলে দেবে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে। তবে আরেকটা কথা মাথায় রেখো, মস্কোর তাপমাত্রা যতই হিমঠান্ডা হোক না কেন, তা মানিয়ে নেওয়া যায় বাড়িঘর কিংবা শপিংমলে হিটিং সিস্টেম থাকায়। কিন্তু যেখানে যাচ্ছি, সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশেই আমাদের কাটাতে হবে; আধুনিক সুযোগ-সুবিধা মোটেও নেই, এটাও মাথায় রেখো। তবে বিষয়টা নিয়ে নেগেটিভ চিন্তা করো না; আমার বিশ্বাস বড় ধরনের সমস্যায় পড়ব না, প্রকৃতির সঙ্গে নিজদের খাপ খাইয়ে নিতে পারব নিশ্চয়ই।’

‘সমস্যা শুধু একটাই, তিন-চারদিন অলস সময় কাটাতে হবে; বিষয়টা কঠিনই একটু।’

‘চিন্তা করো না। দাবা খেলে সময় কাটিয়ে দেব। এখন ঝটপট গুটিগুলো সাজিয়ে ফেল, দেখবে কোন ফাঁকে সময় কেটে যাচ্ছে টেরই পাবে না। তাছাড়া আঁধার ঘনিয়ে আসছে, বাইরের দৃশ্য দেখার সুযোগ হবে না আর। তাই হয়তো খেলাধুলা করেই সময় কাটাতে হবে।’ চলবে...

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত