সবুজ আহমেদ কবিতায় আগামীর স্বপ্নে বিভোর, তথাপি বাস্তবতার নিরিখে তার উপলব্ধি করার ক্ষমতা যথেষ্ট প্রখর। তার কল্পনাশক্তি সুদূরপ্রসারী। সমাজের নানা অসঙ্গতি অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে কাব্যিক সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি পরিবেশ, প্রকৃতি সংরক্ষণে দায়িত্ববোধের প্রমাণ মেলে। আবেগ অনুভূতি প্রকাশে সাবলীল সৌন্দর্য অনুশীলনে ব্যস্ত। তার কবিতায় নতুনত্বের চেষ্টা চলছে। একটি কবিতা থেকে আরেকটি কবিতায় চিন্তা, দর্শন বা সমাজ ভাবনার উত্তরণের পথ খোঁজার আগ্রহ লক্ষণীয়। আমার বিশ্বাস, নিয়মিত কাব্যচর্চা তার কবিতাকে আরও গতিময় করবে।
তার ‘হৃদয়ে জপ জয়’ কবিতায় মুসলিমদের মৌলিক বিশ্বাস ঈমান-আকিদার কথা বলা হয়েছে। ঈমানের পরিপক্বতা জরুরি। তার কবিতায় বলা হয়েছে।
ঈমান আকিদা ঠিক আছে তার
সুমধুর আজানের সুরে ঘুম ভাঙে যার
চরিত্রে দাও শান-কীসে কর ভয়
মুমিন হৃদয়ে জপ আল্লাহ মহান
করুণাময় দেখছে সত্যপথে অভিসম্ভাব্য জয়
কিচিরমিচির পাখি ডাকে আলোকিত ভোরে
উষ্ণ রোদের দেখা পেলে শিশিরকণা ঝরে
সন্ধ্যা ঘনালে প্রকৃতি ঘুমায়-ঝরে যায় ফুল
আধো আঁধারে আঁখি দুটো ভিজে পায় নাকো কূল
মনজানালা খুলে খুঁটিহীনা দাঁড়িয়ে আকাশ দেখ
ভেবো; নদীছোঁয়া হু-হু শীতল হাওয়া কি করে বহে।
‘সশব্দে লেখা ইতিহাসের পা-ুলিপি’ কবিতায় সবুজ আহমেদ উল্লেখ করেন মানুষের অন্তরে যে বিষের ভয়াবহতা, হিংসা-প্রতিহিংসার আগুনে অন্যকে জ্বালাতে গিয়ে নিজেও জ্বলেপুড়ে মরতে হয়। তাছাড়া কাউকে অবহেলা করা যায় না। দমিয়ে রাখা যায় না। ন্যায্য কথা বলার পথ বন্ধ হয়ে গেলে প্রতিবাদী বিকল্প ভাষা ব্যবহার করে সরবে নীরবে, প্রকাশ্যে-গোপনে ন্যায়ের দাবিতে সোচ্চার হয়। তার কবিতা
অপবাদ লেপ্টে দিয়ে জ্বালিয়েছ প্রতিহিংসার আগুন
বলার ফ্লোর যেহেতু পাইনি লাউডস্পিকারে গাইব কবিতার ভলিউম
শোনো; সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়েছ এডিটোরিয়াল
পাঠকক্ষে পাঠকমহলে উস্কে দিয়েছ উচ্চকিত সেøাগান
সশব্দে লেখা ইতিহাসের পা-ুলিপির নাওনি ওপিনিয়ন
প্রবেশাধিকার বন্ধ প্রয়োজনবোধ করনি স্পেস দেওয়ার
প্রেমপঙ্ক্তির ভাষাতৃষ্ণা বন্দোবস্ত না নিয়ে ইমার্জেন্সি জারি করে জবরদখল
ঠিক হল কী পৃথিবীর সকল সংসদীয় ফোরামে কমন হাউসে অবাঞ্ছিত অবরুদ্ধ করার।
অন্যদিকে তার ‘গলিত পিপাসার যন্ত্রণা’ কবিতায় উচ্চারিত হয় হৃদয়ের কথা। মেয়াদোত্তীর্ণ ভালোবাসার কথা। মান-অভিমানের কথা। নীল জ্যোৎস্নার গল্প। কবিতা
যখন ক্ষতচিহ্ন বড় হয়-জেগে ওঠে
ঘুমঢুলু নির্ঘুম রাত্রি আরেকটি সকাল খোঁজে
তখন চোখ রাখি বিরহমলিন ধারাপাতে
একদিন নীল জ্যোৎস্না মুদ্রিত হয়েছিল যে মনে
অল্প আঘাতে ব্যাকুল মুহূর্তগুলো বরষায় ভাঙে
কী আশ্চর্য মেয়াদোত্তীর্ণ বসন্ত কেটে যায় হরষে
তুমি চলেছো আড়াল করে অতীত প্রবর্ধিত আলো
পেছনে পেলে এসেছ অদৃষ্টবাদী প্রাণপুঞ্জে পথিক
স্বপ্নের ভেতর থেকে গলিত পিপাসার অধিক যন্ত্রণা বুঝবে না
কেমন কষ্টে ফুটে উঠে নগরীর এক কোণে পুনর্বার ভুলের চিত্রলিপি।
তার ‘ঘুমঢুলু পঙ্ক্তির পরিপূর্ণ চোখ’ কবিতায় তিনি ব্যাক্ত করেছেন কঠিন কাব্য কথা। ঘুমচোখের কথা। ঘুমঢুলু চোখের মতো ঘুমঢুলু পঙ্ক্তির চমৎকার সুন্দর উপস্থাপন তার কাব্য হয়ে উঠেছে উত্তর আধুনিক। কবিতা
ঊষর মরুতে আবির ছড়ানো সম্ভব?
যদি আঙুর লতার মতো হাত বাড়িয়ে দাও;
বেদনা জয় করব ক্রমেই বোঝাপড়ার পারদ-
নির্জনে সখি নিষেধ করো না যেতে অঘ্রাণের কূলে
লজ্জাকাতর ছেড়ে ফুটো কলি হতে ফুল প্রতীক্ষার বনে
উজ্জয়িনী তুমি তাকালে ঝরে যায় কুঁড়ি-শুকায় কলতান স্রোত
কৌতূহলী ঘুমঢুলু পঙ্ক্তির অধ্যবসার অক্ষর উঠে যায়!
কী স্বপ্নচর্চিত চমকিত চন্দ্র পরিপূর্ণ চোখ-কবোষ্ণ নীল
উত্তর আকাশে দাঁড়িয়ে পেখম মেলে দেখে উড়ন্ত চিল
বেভুল পথিক শব্দহীন স্বপ্ন অনুবাদে ডানা মেলে রঙিন পালক।
কবিতায় তিনি গভীর মগ্ন। ব্যাস্তবতার আয়নায় ঝলমলে দেখলেও নদীর নীরব ভাষা বুঝতে অন্তর্দৃষ্টি লাগে। কথায় আছে অভাব যখন দরজা দিয়ে প্রবেশ করে ভালোবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়। তার কবিতায় সে কথাও আছে। অভাব দেখা দিলে ভুলে যায় সুমিষ্ট বচন। আর আছে সে বিখ্যাত গানের ভাষার মতো প্রেমের কি স্বাদ আছে যদি নিন্দার কাঁটা না বিঁধল তার মতো করে কলঙ্ক জানাশোনা আছে পীড়িত প্রেমিকের। সে কথাই আছে তার ‘ছেঁড়াজীবনের জমাট অন্ধকার’ কবিতায়।
বাস্তবতার আয়নায় ঝলমলে দেখালেও
মনমাঝি বুঝে নদীর নীরবতার ভাষা
জেলের কাছে রহস্য জলের উপাখ্যান
কলঙ্ক জানাশোনা আছে পীড়িত প্রেমিকের
ছেঁড়া জীবন সংসারের জমাট অন্ধকার
অভাব দেখা দিলে ভুলে যায় সুমিষ্ট বচন
নিমিষেই কারো করুণায় বিক্রি হয় প্রিয়জন
তখন ধবল পূর্ণিমা চাঁদ ঝলসানো ধান কাটা মাঠ
রঙের শহরে চাষ করা বৈষম্যের গজালে চারা;
মগজে নীতি আদর্শ ভুলে অলিতে গলিতে ঘুরে ভাব।
তার লেখায় দেশপ্রেমের উৎকৃষ্ট উদাহরণ থাকে। তার দেশপ্রেমের কবিতা
আমার ভালোবাসা বাংলার বিস্তীর্ণ আকাশ
আউশ ধান সুষমা সোনাফলা মাটি
পরান জুড়ানো মায়ের হাতে তৃষিত জল
ভালোবাসি ভাষা বিদ্রোহ বায়ান্নর রাজপথ
প্রাণের প্রিয় শহিদ বেদিতে দিতে ফুল
আজও ভুলিনি এক নদী রক্তমাখা একাত্তর।
আমার ভালেবাসা নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান
স্বৈরাচার হঠাতে সমস্বরে প্রতিবাদী গান
ভালোবাসি গণতন্ত্র-সোঁদা মাটির ঘ্রাণ
অপার প্রেম প্রিয়ফুল রক্ত জবা লাল
ভালোবাসি অধিকার আদায়ে উত্তাল মিছিল
দেশের তরে বুক পেতে দিতে বুলেটের বিরুদ্ধে শির।
তার ‘নাগরিক চোখ’ কবিতায় অনুভূতির প্রকাশ পেয়েছে নানা আঙ্গিকে।
আমাদের চিৎকার শোনার কোথাও কেউ নেই
চিকিৎসকের হাত বদরক্তে লাল
সর্বত্র যোগ হয়েছে কমিশন কামাই
পৃথিবীর ফুসফুস হৃদযন্ত্রে সীসা বাতাসে বিষ
সমাজসেবকের চারপাশে চামচা সমাবেশ
মাইল হেঁটে ঘুষ না দিলে লড়ে না ফাইল
জনতা বটতলায় বসে থাকা ব্যস্ত কুকুর
দেশ বেঁচে আছে অচেনা দরবেশের দোয়ায়
মাবুদ নাগরিক চোখ আর প্রার্থনায় ভেজা হাত
একজন শ্রমিকের লড়াই ধোঁয়া তোলা দু’বেলা ভাত।
তার ‘দু’দিনের নিশিদিন’ কবিতায় আছে নিশাচর জীবনের সব আয়োজনই মিথ্যা। মৃতুই মানুষের জীবনের আসল সত্য। মৃত্যুর পরে রয়েছে অনন্ত মহাকাল। সেখানেও মুক্তি চাই। পরকালীন শাস্তি থেকে মহামুক্তি। একমাত্র আল্লাহর কাছে আমরা সকলে সাহায্য প্রার্থী। আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। আমাদের সকল চাওয়া-পাওয়া তার কাছেই।
নিশাচর জীবনের যত আয়োজন মিছে মনে হয়
মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে শেষ নিঃশ্বাসে নিভে যাবে নক্ষত্র
প্রাণপাখি উড়ে গেলে পড়ে থাকে দেহ নামক খাঁচা
চল্লিশ কদম হাঁটা, জানাজা শেষে বাঁশেরঘর মাটি চাপা
ভাবুন তো একবার পোকামাকড় খাবে সোনারঙা শরীর
মিটে যাবে শূন্যে ওড়াওড়ি, সঙ্গে শুধু আমলনামা;
চোখ বুজলে চুকে যায় ছোটাছুটি, শূন্য লেনাদেনা
দু’দিনের নিশিদিন কিসের অহম, সাঙ্গ হবে সবটুকু বেলা
পেছনে পড়ে থাকবে অল্প আয়ুর বিস্তীর্ণ ধূসর বালুচর
তারপর সমতলে ধীরে কৃষ্ণ গহ্বরে কেটে যাবে যুগ যুগান্তর।
‘ইতিহাসের অভ্যুত্থানে’ সবুজ আহমেদ মানুষের জীবনের নানারকম চড়াই-উৎরাই, সংগ্রাম-সাধনা-সফলতার কথা বলেছেন। কীভাবে সমাজের মানুষের পচন ধরে।
‘লিখতে চাই কষ্টার্জিত বাংলার সংগ্রাম
রক্তঝরা উত্তাল ইতিহাস গণঅভ্যুত্থান।’
অন্যদিকে মগজের কোষে অন্য নগর কবিতায় তিনি ব্যক্ত করেন
এখন ফটোফ্রেমে বন্দি আমাদের সম্পর্ক
নতুন কবিতার স্বপ্নময় শব্দরা জড়োসড়ো
যার জন্য ঘোর লাগা বুকে থামছে না গোঙানি
সে রং বদলে গোপন অভিসারে মিলছে রোজ
হারিয়ে যাওয়ার ছল না করে একবার বলে যেতে...
পচন ধরলেও বোঝাপড়ায় এগিয়ে দিতাম চুপিসারে
মুসাফির যে ঠোঁটে হাসি ফোটাব বলে প্রবাসে দিয়েছি পাড়ি
বাইশ বসন্ত জেগে থেকে প্রতিটি প্রহর করেছি আলিঙ্গন
আর অন্তরালে আমার শহরে থেকে মগজের কোষে লালন করেছ অন্যনগর শুষ্ক লাবণ্য ছোঁয়া প্রেম নিস্তব্ধ।
আরব সাগরের নীল ঢেউ উপচে পড়ে হৃদউপকূলে।