ঢাকা ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

গল্প

সেদিন খুব শীত ছিল

আমির খসরু সেলিম
সেদিন খুব শীত ছিল

বেলা সাড়ে ১১টা বাজে। তিতুন কম্বলের নিচ থেকে চিৎকার করে, ‘মা, মা মাআআ..।’

রান্নাঘর থেকে মায়ের গলা ভেসে আসে, ‘চেঁচচ্ছিস কেন?’

‘চা দাও।’

আধঘণ্টা আগে কফি খেয়েছিস। তোর বাবার বারণ, তাও দিয়েছি। এখন আবার চায়ের বায়না? ওঠ বিছানা থেকে।’

‘উঠব না মা। আজ তো স্কুল ছুটি। আজ সারাদিন শুয়ে থাকব। আর বাইরে কি ঠান্ডা!’

‘সব ঠান্ডা তো তোরই লাগে। আমাদের কারও লাগে না। উঠবি, না গায়ে পানি ঢেলে দেব।’

তিতুন উঠে পড়ে। গায়ে কম্বল জড়িয়েই রান্নাঘরের দিকে যায়। ওখানে মা মহাব্যস্ত। বিকালে আন্টিরা আসবে। তারই খাবারের আয়োজন চলছে। তিতুনকে দেখে মা বলেন, উঠেছিস! খুব ভালো। গোসল করে আয়। চা বানিয়ে দেব তারপর।’

‘অসম্ভব। নো গোসল-ফোসল আজ। ঠান্ডা পানি গায়ে লাগলে চামড়া উঠে যাবে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে জানো? ফ্রস্ট বাইট।’

‘তোর বাবাকে বলে দেব, পানিচোর কোথাকার।’

‘বাবারই তো আমার কাছ থেকে বকা পাওনা আছে। আমাকে না নিয়ে দিব্যি শ্রীমঙ্গল চলে গেল!’

‘ওরে পাগল,’ মা বলে, ‘গেছে অফিসের কাজে। ১০টা চা-বাগান ভিজিট করবে। তোকে নিয়ে অত দৌড়াদৌড়ি করতে পারবে না। তোর কষ্ট হবে দেখেই তো সঙ্গে নিল না। শীত একটু কমুক। আমরা তিনজনই একসঙ্গে যাব।’

‘ঠিক আছে, তাহলে আমি শীত কমার পর শ্রীমঙ্গলে গিয়েই গোসল করব। এখন একটু নিচে যাচ্ছি।’

মা হাসলেন। কিছু বললেন না। তিতুন ঘরে গিয়ে ট্রাউজারের ওপরই ফুলপ্যান্ট পরল। গায়ের ফুলহাতা সিøপারের ওপর একটা হালকা সোয়েটার পরে তার ওপর পরল জ্যাকেট। পায়ে পরল জুতা। টুপি না মাফলার নেবে ভেবে, দুটোই নিল। নিচে গিয়ে দেখে বাসার কেয়ারটেকার কার সঙ্গে যেন হইচই করছে।

ছোট্ট একটা ছেলে। বয়সে-আকারে ওর সমানই হবে। একটা হাফপ্যান্ট পরে আছে। পা খালি। গায়ে একটা ফুলহাতা গেঞ্জি। সেটাও ওর সাইজের চেয়ে অনেক বড়! গেঞ্জির হাতা ছেলেটার আঙুল ছড়িয়ে নিচে নেমে এসেছে, নিচের ঝুল ঢেকে দিয়েছে প্যান্টের অর্ধেক।

‘কি হয়েছে কেয়ারটেকার মামা?’

‘দ্যাখেন না তিতুন বাবা, গায়ের কাপড় চায়, আমি কি নিয়া বইয়া আছি, কন দেখি জ্বালা। পোলা পাশের বস্তিতে থাকে, চুরিরও মতলব থাকতে পারে।’

‘তোমার গরম কাপড় নেই?’ তিতুন জানতে চায়।

‘একখান আছে। মায়ে ধুইয়া দিছে। কাইল থেইকা রউদ উঠে নাই, জামাও শুকায় নাই। তাই ভাবলাম, কোথাও যদি কেউ দেয়। এট্টু ভালো হয়।’

তিতুন কেয়ারটেকার মামাকে ছেলেটাকে বসাতে বলে লিফটে ঢুকল। ভাবল, ওর কত সেট কাপড় আছে সে নিজেও জানে না। শুধু গত ঈদেই ও উনিশ সেট পোশাক পেয়েছিল। ফ্ল্যাটে গিয়ে মায়ের সামনে দাঁড়াল সে। বলল, ‘মা, আমি গোসল করব, চা খাব না। আমার একটা কথা শুনবে?’

মা হাতের কাজ থামিয়ে অবাক হয়ে তাকান। ছেলের চোখে অদ্ভুত এক বেদনার ছাপ। কাছে এসে মাথায় হাত রেখে সব শুনলেন তিনি। তারপর কেয়ারটেকারকে ইন্টারকমে বললেন, আমি বিস্কুট পাঠাচ্ছি, ছেলেটাকে খেতে দাও, বসিয়ে রাখো আধঘণ্টা। তারপর তিতুনকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বললেন, ‘আজ আমি তোমার ওপর খুব খুশি হয়েছি। তুমি যে মানুষের জন্য মমতা অনুভব করছ এটা খুব ভালো ব্যাপার।’

এরপর তিতুন আর মা মিলে ছেলেটার জন্য পাঁচ সেট কাপড় আলাদা করল। মা যা রান্না করছিলেন তার সবই একটু একটু করে প্যাক করে দিলেন। তিতুন সব নিয়ে যখন ছেলেটার হাতে তুলে দিল, ওর চোখের কোনায় পানি দেখা দিল। কিন্তু হাসিতে হলুদ দাঁত বের হয়ে পড়ল।

তিতুন জানল ওর নাম তানজির। বলল, ‘তানজির, কাল বিকালে একবার এসো। কেয়ারটেকার মামাকে বলে রাখব।’ বলে তিতুন লিফটে উঠে পড়ল। ওর এখন মোটেও শীত লাগছে না। তিতুন হাতে আঙুলে গুনতে শুরু করল তানজিরের আর কী কী লাগবে, ‘জুতো দিতে ভুলে গেছি আজ..., গায়ে মাখার লোশন, টুথব্রাশ, পেস্ট, ঠোঁটের জন্য জেলি, কিছু কলম, খাতা, বই...।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত