২৮.০৩.১৯৭১, বিকেল ৫টা : ডায়েরি কি করে লিখতে হয় আমি জানি না। ভাইয়া, তুমি আমাকে এটা উপহার দিলে; কিন্তু কী করে লিখতে হয় তা তো বলনি। তাই আমি ঠিক করেছি আমার যা লিখতে ইচ্ছে করবে তাই লিখব।
আজ আমার মন খুব খারাপ। আগে সবাই মিলে খুব হইচই করে খেলতাম। কিন্তু আজকের বিকেলটা কেমন যেন ফাঁকা আর বিষণ্ন লাগছে। কেমন যেন দম বন্ধ করা ভাব। এসব আমার ভালো লাগছে না।
ভাইয়া তুমি যুদ্ধে চলে গেলে, অথচ আমাদের কাউকে বলেও যাওনি। তোমার ঘড়িটাও ফেলে গেছ। মা শুধু কাঁদে তোমার জন্য। তবে ডায়েরির জন্য তোমাকে ধন্যবাদ।
১৬.১২.১৯৭১, দুপুর ২টা : আজ আমার খুব আনন্দ লাগছে, এতো আনন্দ যে চিৎকার সেটা করে বলতে ইচ্ছে করছে। মা বলেছে আজ তুমি ফিরবে।
আমাদের বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে। আমি নিজেও মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক সাহায্য করেছি। তাই স্বাধীনতা মানে আমি বুঝতে পেরেছি। আর আমাদের দেশকে পূর্ব পাকিস্তান বলতে হবে না। মিলিটারিদের অত্যাচার সহ্য করতে হবে না। কঠিন ‘উর্দু’ পড়ার জন্য স্যারের মার খেতে হবে না।
১৭.১২.১৯৭১, সকাল ১০টা : ভাইয়া তুমি এখনও এলে না। মা কাঁদতে শুরু করেছে। তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো।
বিকেল ৫টা : সকালে মা বলছিল আজ তুমি আসবে। কিন্তু তা হয়নি। ভাইয়া, তুমি কেন আসো না? শুনেছি তুমি মারা গেছ! কিন্তু আমার যে তা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না।
রাত ১১টা : মা কাঁদছে। তাকে কীভাবে সান্ত¡না দেব, বুঝতে পারছি না। ভাইয়া আমি এখন কী করব?
১৬.১২.১৯৯৬ ভোর ৫টা : মা এখন ঘুমাচ্ছে। যখন তিনি জাগবেন তখন তিনি বলবেন, দেখিস আজ খোকন ঠিক আসবে। (ভাইয়া, মা তোমাকে আদর করে খোকন বলে, আমাকে ওরকম করে কিছু বলে না কেন?)
ভাইয়া, আমি জানি তুমি আসবে না। কিন্তু মা ঠিকই অপেক্ষা করবেন তোমার জন্য। তিনি আজ সারাদিন তাকিয়ে থাকবেন রাস্তার দিকে। তারপর যখন রাত গভীর হবে, তখন কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়বেন।
আমি সব জানি। আজ মা কী করবেন, সব। কারণ ১৯৭১ থেকে আমার জীবনের প্রত্যেকটা ১৬ ডিসেম্বর এভাবেই কাটে।
১৭.১২.৯৬ সকাল ১০টা : মা কাঁদছে, আমি তার সামনে যেতে পারছি না। কারণ, আমিও কাঁদছি। আমি কখনও কাঁদি না, আমার চোখের পানি কেউ কখনও দেখেনি। আজইবা মাকে সেটা দেখাই কেমন করে!