বিশাল এক ফসলের মাঠ, মাঠের মাঝ বরাবর একটা টিলার ওপর একটা পুরোনো বটগাছ। সেখানে রাখালের দল বিশ্রাম নিত। কিন্তু সেই টিলায় ছিল অসংখ্য গর্ত। যখন ফসলের মাঠে ধান পাকা শুরু হতো। তখন শুরু হতো ইঁদুরের উৎপাত। কেউ কেউ সারারাত জেগে ঝংকার বাজাত, আবার কেউ আলো জ্বালিয়ে রাখত, আবার কেউ ফাঁদ পেতে রাখত, আবার কেউ বিষ মাখানো ভাত ছিটিয়ে রাখত। তাতে অনেক ইঁদুর ফাঁদে আটকা পড়ত, আবার অনেক ইঁদুর বিষ মাখানো খাবার খেয়ে সেখানেই মরে থাকত। এরপর হঠাৎ বর্ষা শুরু হলে গর্তে ঘুমিয়ে থাকা ইঁদুর গর্তেই মরে যেত। হঠাৎ বর্ষা শুরু হয়ে গেল বন্যায় তলিয়ে গেল পুরো মাঠ। ইঁদুরের একমাত্র আস্তানা এখন সেই উঁচু টিলা আর বটগাছের চিপায়। একদিন জোসনা রাতে ইঁদুর রাজা সব ইঁদুরকে ডেকে সভা করল। ইঁদুর রাজা বলল-
আমি এ রাজত্বের ভার থেকে অব্যাহিত চাচ্ছি।
সব ইঁদুর একসঙ্গে বলে উঠল...
কেন রাজা মশাই
একদিকে আমি বৃদ্ধ হয়ে গেছি, আরেক দিকে আমার প্রজাদের রক্ষা করতে পারছি না। গত এক বছরে আমার বহু সাধারণ প্রজা গৃহস্থের হাতে মরেছে। এভাবে সাধারণ প্রজাদের মেরে ফেললে এ রাজ্য ইঁদুরশূন্য হয়ে যাবে। আস্তে আস্তে আমাদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
হঠাৎ গাচ্ছা ইঁদুর বলে উঠল...
রাজা মশাই আপনি হুকুম দিলে আমি একটা প্রস্তাব দিতে পারি।
বলো কি প্রস্তাব?
রাজা মশাই আমি গাচ্ছা ইঁদুর, আমি খুব দ্রুত চলতে পারি। আমি আমার গাচ্ছা ইঁদুরদের নিয়ে লোকালয়ে বিভিন্ন ফলের গাছে আক্রমণ চালাব।
আর বাইতারি ইঁদুর গৃহস্থের ঘরে হানা দেবে, সারাদিন গর্তে লুকিয়ে থাকবে আর রাতের বেলায় ধানের মাচা ও দরকারি জিনিস কেটে কুচিকুচি করবে। গৃহস্থ তখন ফলগাছ আর ঘর বাঁচানো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। তখন মাঠে যারা থাকবে ধান কেটে গর্তে মজুত করবে।
এটা করতে গেলে তো অনেকে মারাও যাবে।
রাজা মশাই, খাবার খেতে না পারলে তো আমরা তো এমনিই মারা যাব। তার চেয়ে যুদ্ধ করে খেয়ে মরব।
কথাটা ঠিকই বলেছিস, তোকেই আমার রাজ্যের প্রধান সেনাপতি করছি। এখন থেকে তুই লোকালয়ে সৈন্য-সামন্ত নিয়ে হামলা করবি। আর আমি এদের নিয়ে মাঠে হামলা চালাচ্ছি।
রাজা মশাই, যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন, তিনি আমাদের জন্য আলাদাভাবে কোনো খাদ্য ভান্ডার দেননি। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য মানুষের খাদ্য শস্যের ভেতরে হক দিয়ে দিয়েছে। কেন দিবে না আমাদের খাবার।
গাচ্ছা ইঁদুর স্লোগান ধরল ‘বাঁচতে হলে খেতে হবে।’
গাচ্ছা ইঁদুর ও বাইতারি ইঁদুর রাতের আঁধারে রওনা দিল লোকালয়ে। রাতের মধ্যেই পৌঁছে গেল। গাচ্ছা ইঁদুর নারকেল গাছের ওপর আশ্রয় নিল, আর সব বাইতারি ইঁদুর ঢুকে গেল গায়ের গৃহস্তের ঘরে ঘরে। প্রথম দিন লুকিয়ে থেকে সার্বিক অবস্থা বুঝে নিল। পরদিন গাছ থেকে নেমে এলো গাচ্ছা ইঁদুর, এক ঘরের চালে। সব বাইতারিকে ডাকল এবং কে কীভাবে অপারেশন চালাবে, সব দিকনির্দেশনা দিয়ে দিল। কে কখন কোন দিকে অপারেশনে অংশগ্রহণ করবে। শুরু হয়ে গেল ইঁদুরের খাবারের জন্য যুদ্ধ।
একরাতের ভেতর গাচ্ছা ইঁদুর বাহিনি যত নারকেল-সুপারি ছিল সব কেটে দিল এবং যত সবজি গাছ ছিল সব গাছের গোড়া কেঁটে দিল।
আর এদিকে রাত গভীর হতেই বাইতারি ইঁদুর অপারেশন শুরু করল, কেউ দরকারি কাগজপত্র কাটল, কেউ লেপ-তোশক, কাপড় চোপড় কাটল আবার কেউ টাকার ঝুলি কাটল। এক রাতেই মোটামুটিভাবে গৃহস্থকে পঙ্গু বানিয়ে ফেলেছে।
গাঁয়ের গৃহস্থরা ঘুম থেকে উঠে দেখে সর্বনাশ হয়ে গেছে। সব কিছু তছনছ করে দিয়েছে ইঁদুরের দল। গাঁয়ের ভেতর একটা হৈহল্লা পড়ে গেল। গাচ্ছা ইঁদুর গাছের ওপর থেকে গৃহস্থের আহাজারি দেখে। আর মনে মনে বলে তোমাদের সম্পদে আমাদের হক আছে। আর তা চাইলেই আমাদের মেরে ফেল।
এদিকে ফসলের মাঠেও চলছে ধান কাটার উৎসব, গোলা ভরছে ইঁদুরের দল। গৃহস্থের দল দিশেহারা হয়ে পড়ে, আর ইঁদুরের দল খাদ্যশস্য নিয়ে তাদের ভান্ডারে মজুত করে।