গল্প

লাল ফড়িংয়ের বিপদ

নেয়ামুল হক

প্রকাশ : ১৩ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

এক যে ছিল লাল ফড়িং। মা-বাবার সঙ্গে একটা ফুলের বাগানে ছিল তার বাস। তিড়িংবিড়িং লাফিয়ে, ঝাঁপিয়ে বাতাসে ঘুরে বেড়াত সে। ইচ্ছে হলে লাল, নীল বা বেগুনী ফুলের ওপর বসে জিরিয়ে নিত। আর মনের সুখে গুনগুন করত,

 

হেসে খেলে

পাখা মেলে

উড়ে উড়ে

ঘুরে ঘুরে

ফিরি তাই

মজা পাই।

হঠাৎ তার ইচ্ছে জাগল বিশ্বভ্রমণে বের হওয়ার। জগৎটাকে দেখবে, জানবে। নতুন নতুন জায়গা দেখা হবে। অনেক অপরিচিত জিনিস জানা যাবে। সে তার ইচ্ছার কথা মা ফড়িংকে জানাল। মা ফড়িং শুনেই ভয়ে আঁতকে উঠল।

বলল, না বাছা, তুমি এখনও অনেক ছোট। বড় হও, তখন যেও।

বাবা ফড়িং বলল, তাছাড়া অচেনা পরিবেশে পদে পদে বিপদ থাকে। বন্ধু, শত্রু বোঝার বয়স তোমার হয়নি, বাবা।

শুনে লাল ফড়িং রেগে গিয়ে বলে, তোমাদের কাছেই শুধু আমি ছোট। জানো, আমি এক উড়ালে দূরের ওই ঢিবি পর্যন্ত চলে যেতে পারি। প্রজাপতিদের সঙ্গে ওড়ার পাল্লায় সবাইকে ছাড়িয়ে প্রথম হই। আর আমার বুদ্ধিও কম নয়।

তুমি অনেক বুদ্ধিমান আর বীর ফড়িং। কিন্তু এখনও নিজেকে সামলানোর মতো বয়স তোমার হয়নি। বোঝায় মা আর বাবা ফড়িং।

লাল ফড়িংয়ের বেজায় মন খারাপ হয়। সে মনে মনে স্থির করে কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে পড়তে হবে।

ফুলবাগানটা পাড় হলেই বড় রাস্তা। বড় রাস্তা পেরুলে চাষিদের মাঠ। মাঠ পার হলে ঘন জঙ্গল। সেটা পেরুলেই সুন্দর সুন্দর, নতুন নতুন জায়গার হাতছানি। লাল ফড়িং ভেবে ভেবে শিহরিত হয়।

পরদিন মা-বাবা খাবারের সন্ধানে বের হয়ে গেলে লাল ফড়িং অজানার উদ্দেশে দেয় উড়াল। লাফিয়ে লাফিয়ে, উড়ে-উড়ে পার হয়ে যায় ফুলের বাগান, ঘন ঝোপঝাড়। পথে দেখা হয় বুড়ো গঙ্গাফড়িংয়ের সঙ্গে।

ছোট্ট লাল ফড়িং, কোথায় যাও একা একা? - গঙ্গাফড়িং জানতে চায়।

ঘুরতে যাই, দূরে কোথাও।

একা একা যেও না, বিপদে পড়বে।

সে আমি বুঝব।

বলেই বড় রাস্তা, মাঠ পার হয়ে ঢুকে পড়ে জঙ্গলের ভেতর। ততক্ষণে তার বেশ ক্ষুধাও পেয়েছে। সে ছয় পায়ে গিয়ে বসল একটা নিচু কচুপাতার ওপর। আর খুঁজতে লাগল মশা, পিঁপড়া বা কোনো পোকামাকড় পাওয়া যায় কি-না। দেখতে পেল একটা পিঁপড়া কচুর ডগা বেয়ে হেঁটে আসছে। লাল ফড়িং পাকা শিকারির মতো নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে লাগল। পিঁপড়াটা গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসছে আর সে অপেক্ষা করছে। হঠাৎই শুনতে পেল শুকনো পাতা নড়ার শব্দ। লাল ফড়িং সচকিত হলো। সে সতর্কতার সঙ্গে তার বড় বড় চোখ মেলে তাকাল। দেখল একটা মস্ত কোলাব্যাঙ ইয়া বড় হা করে বসে আছে। এখনই বুঝি লাফিয়ে পড়বে তার ওপর। লাল ফড়িং ভয়ে চুপসে গেল। কিন্তু মাথা ঠান্ডা রেখে ঠিক করে নিল কী করতে হবে। তারপরে প্রাণপণে দিল উড়াল। উড়ে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল একটা ঘন ঝোপের আড়ালে।

কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে লাল ফড়িং যেই না উঠতে যাবে, দেখে তার চার পাখাই আটকে গেছে মাকড়সার জালে। সে আসলে ঝোপের ভেতর অন্ধকারে বুঝতে পারেনি, সে পা দিয়েছে আরেক শিকারির ফাঁদে। লাল ফড়িংয়ের ভাগ্য ভালো ছিল, মাকড়সাটা তখন ঝিমোচ্ছিল। সেই ফাঁকে বেচারা লাল ফড়িং বহু কষ্টে নিজেকে জাল থেকে মুক্ত করতে লাগল। তবে একটা পাখা বেশ শক্তভাবে জালে জড়িয়ে গিয়েছিল। তাই সে জোরে জোরে পাখা ঝাপটাতে লাগল। পাখা ঝাপটানোর শব্দ আর দুলুনিতে মাকড়সার ঝিমুনি গেল ছুটে। সে আড়মোড়া ভেঙে লাল ফড়িংয়ের দিকে এগুতে লাগল। লাল ফড়িং পড়িমরি করে দিল উড়াল। উড়তে সে পারল ঠিকই; কিন্তু তার পাখার একটা অংশ গেল ছিঁড়ে। সে উড়ে গিয়ে বসল একটা গাছের ডালে। সেখানে ছিল একটা শালিক পাখির বাসা। বাসা থেকে একটা মস্ত শালিক মাথা উঁচু করে লাল ফড়িংকে দেখল।

নরম সুরে জানতে চাইল, কি হয়েছে লাল ফড়িং, কোনো সমস্যা? শালিকের মিহি কণ্ঠের মোলায়েম শব্দে বেচারা ফড়িং গলে গেল। ভাবল, এতক্ষণে বুঝি একজন শুভাকাক্সক্ষী পাওয়া গেল।

ফাঁদে পড়ে পাখা ভেঙেছে, উড়তে কষ্ট হচ্ছে, কি যে করি! করুণ কণ্ঠে শালিককে জানায় লাল ফড়িং।

ও এই ব্যাপার! আহারে বেচারা! সহানুভূতির সুরে আক্ষেপ করে শালিক।

দাঁড়াও, জোড়া দিয়ে দিচ্ছি। বলে সুচালো ঠোঁট উঁচিয়ে এগিয়ে আসে শালিক।

পালাও, বেটা লাল ফড়িং, পালাও। ও তোমাকে গিলে ফেলবে। চিৎকার করে ওঠে কেউ একজন। লাল ফড়িং পেছনের দিকে মাথা ঘুরিয়ে দেখে শালিকটা হা করে আছে তাকে গিলে খাওয়ার জন্য। তার চোখ লোভে চকচক করছে। আর তার পেছনে পাতার ফাঁকে দেখা যাচ্ছে মা আর বাবাকে। সে শালিকের মতলব বুঝে ফেলে গায়ের সমস্ত শক্তি এক করে দেয় উড়াল। শালিক আর তাকে ধরতে পারে না।

মা আর বাবা ফড়িং লাল ফড়িংকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠে। খাবার নিয়ে বাড়ি ফিরে লাল ফড়িংকে খুঁজে না পেয়ে তারা খুঁজতে বের হয়। পথে বুড়ো গঙ্গাফড়িংয়ের কাছে জানতে পারে লাল ফড়িং জঙ্গলের দিকে এসেছে।

তারপর লাল ফড়িংকে কাঁধে নিয়ে বাবা আর মা ফড়িং ফিরে আসে ফুলবাগানে, তাদের বাসায়। কবিরাজ ঘাসফড়িং বাউলাগোটার ফলের রস দিয়ে লাল ফড়িংয়ের ছেঁড়া পাখা জোড়া দিয়ে দেয়।

কয়েক দিনের মধ্যেই লাল ফড়িং আবার সুস্থ হয়ে যায়। তার পাখা ঠিক হয়ে যায়। সে এখন আবার উড়ে ঘুরে বেড়ায়। তবে বড়দের কথা আর অমান্য করে না। উল্টো ছড়া কাটে,

বড়দের বারণ শুনতে হয়