আষাঢ় মাস। ঝড়-বাদলের ঠিক-ঠিকানা নাই। এই আকাশ ফর্সা, বকের ডানার মতো ধবধবে সাদা; একটু পরে আবার কালো ও বিশ্রী মেঘের হানা; এক মুহূর্তে পাতিলের তলার মতো হয়ে যায় পুরো পৃথিবী। মুছে যায় সবটুকু আলো।
তুলপাই বাজারে মফিজ মিয়ার চায়ের দোকান। ছোট নাতনি ঋতুকে সঙ্গে নিয়ে দোকানে বসে আছেন তিনি। বাইরে তুমুল বৃষ্টি। কাজের ফাঁকে নাতনিকে পাশে বসিয়ে নানা রকম গল্প শোনান। আজগুবি সব কল্প-কাহিনি বানিয়ে বানিয়ে নাতনিকে তুষ্ট রাখার চেষ্টা করেন। নাতনি তার দারুণ ভক্ত। ঋতুর ধারণা, তার দাদু পৃথিবীর সেরা জ্ঞানী-গুণি মানুষ।
বৃষ্টি থামার কোনো উপায় দেখা যায় না। এই কমে, এই বাড়ে। এরই মধ্যে কাকভেজা শরীর নিয়ে জবুথবু হয়ে একটা লোক মফিজ মিয়ার দোকানে এসে ঢুকলেন। লোকটাকে খুব আন্তরিকতার সঙ্গে বসতে দিলেন তিনি। বৃষ্টির ছাট থেকে বাঁচাতে দোকানের ভেতরে আসন পেতে দিলেন। চেয়ারে বসতে বসতে চা অর্ডার করলেন ভদ্রলোক।
নাতনিকে গল্প শোনানো আপাতত বন্ধ। চায়ে দুধ মেশাতে মেশাতে মফিজ মিয়া লোকটার নামণ্ডঠিকানা জিজ্ঞেস করলেন। নাম তার জমিরুল। এখানে নতুন এসেছেন। এ কথা, সে কথায় আলাপ জমে উঠল। সামান্য পরিচয়ে দু’জনের মধ্যে সুন্দর একটা সখ্যভাব তৈরি হলো। আলোচনা বাড়তে থাকল, দেশ-সমাজ-সংস্কৃতি ও রাজনীতি নিয়ে দু’জনের খুব গল্প-গুজব চলল।
তাদের কথার আগা-মাথা কিছুই বোঝে না ঋতু। শুধু এদিকে একবার, ওদিকে একবার ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে চুপচাপ বসে রইল সে।
বৃষ্টি একটু কমে এলো। তবে গুঁড়ি গুঁড়ি ঝরছে এখনও। সুযোগ বুঝে ভদ্রলোক দোকান থেকে বেরিয়ে পড়লেন। রাস্তায় নেমে হাতের পত্রিকা মাথায় তুলে নিয়ে দিলেন দৌড়। এক নিমিষে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
পাইছি- বলে হঠাৎ উচ্চ স্বরে হেসে উঠল ঋতু।
কী পেয়েছ?- অবাক হয়ে মফিজ মিয়া জানতে চাইলেন।
ঋতু উচ্ছ্বসিত হয়ে একটা মানিব্যাগ দেখিয়ে বলল, যে লোক এতক্ষণ বসা ছিল। এটা উনার পকেট থেকে পড়েছে। আমি দেখে কিছু বলিনি।
মফিজ মিয়া ব্যাগটা তার কাছে দিতে বললেন। একটু কাচুমাচু করে দাদুর হাতে মানিব্যাগ তুলে দিল ঋতু। তিনি ব্যাগ খুললেন। দেখলেন, ব্যাগে প্রায় হাজার তিনেক টাকা! সঙ্গে কিছু ভিজিটিং কার্ড।
একটা কার্ডে ভদ্রলোকের ছবি দেখে চিনতে পারলেন। সময় নষ্ট না করে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলেন। ডেকে এনে ব্যাগ ফিরিয়ে দিলেন। ধন্যবাদ জানিয়ে খুশি মনে ভদ্রলোক চলে গেলেন।
মফিজ মিয়ার কাজটা পছন্দ হলো না ঋতুর। সে খুব ব্যথা পেল। মনে মনে দাদুর প্রতি নারাজ হলো। ভাবল, টাকা পেয়ে কেউ ফেরত দেয়? এমন বোকা লোক কখনও হয়? ইস, কতগুলো টাকা! দাদু কি পাগল নাকি? আরে টাকা জিনিসটা তো পাগলেও চেনে।
মফিজ মিয়া ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন। নাতনিকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। বললেন, কারো কিছু পেলে ফেরত দেওয়া উচিত। নইলে পাপ হয়। যে ব্যক্তি কোনো কিছু হারায়, সে ব্যক্তি খুব ব্যথা পায়। অনেক খোঁজাখুঁজি করে। পাওয়া জিনিস ফেরত দিলে লোকে খুশি হয়। সৃষ্টিকর্তাও খুশি হোন। হতে পারে এ টাকা তার অনেক দরকার। এটা খোয়া গেলে খুব বিপদ নেমে আসত।
মফিজ মিয়া যতই বোঝানোর চেষ্টা করে, ঋতুর মন তাতে সায় দেয় না। টাকাগুলোর মায়া তার মন থেকে কিছুতেই দূর হয় না। দাদুকে এখন সে কিছুতেই জ্ঞানী-গুণী মানুষ ভাবতে পারছে না। তার কাছে মনে হয় মফিজ মিয়া একটা বোকা লোক। পৃথিবীতে এমন বোকা আর একজনও নেই।
সেই থেকে নিজের দাদুর প্রতি ঋতুর ধারণা পাল্টে গেল। দাদুকে ভাবত পৃথিবী-সেরা বোকা মানুষ। তবে টাকার জন্য দু-একদিন মন খারাপ লাগলেও এক সময় তা স্বাভাবিক হয়ে যায়। কিন্তু দাদুর প্রতি তার ধারণার পরিবর্তন আসে না।
ঋতু চতুর্থ শ্রেণিতে থাকতেই তার দাদু মারা যান। এখন সে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। প্রায় এক বছর আগে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন মফিজ মিয়া।
স্কুলে যাওয়ার সময় একদিন তার বাবা টিফিনের জন্যে ২০ টাকার একটা নোট দেয়। কিন্তু বন্ধুদের সঙ্গে দুষ্টুমি করতে গিয়ে সেটা হারিয়ে ফেলে ঋতু। পেটে তখন দারুণ ক্ষুধা। কিছু কিনে খাওয়ার মতো টাকাণ্ডপয়সাও হাতে নেই। অনেক খোঁজাখুজির পর মন খারাপ করে ক্লাসরুমে বসে রইল। টাকা হারানোর কষ্টে কাতর হয়ে টেবিলে মাথা রেখে নিশ্চুপ পড়ে রইল সে।
তার বন্ধু রুনা বিষয়টা খেয়াল করল। কাছে এসে জানতে চাইল কী হয়েছে। ঋতু ভাঙা ভাঙা গলায় টাকা হারানোর কথা জানাল।
রুনা বলল, মন খারাপের কিছু নেই। মতিন আজ স্কুল মাঠে ২০ টাকার একটা নোট পেয়েছে। সবাইকে সে জিজ্ঞেস করেছে। টাকার মালিকের খোঁজ মেলেনি। এখন জানলাম ওটা তোমার টাকা। ঠিক আছে। আমি মতিনকে বলব। ভয় নেই, টাকা তুমি পেয়ে যাবে।
এ সময় ক্লাসে প্রবেশ করল মতিন। রুনা মতিনকে ডেকে আনল। ঋতুর টাকা হারানোর বিষয়টা জানাল।
মতিন মিষ্টি হেসে বলল, ও-ও-ও, তাহলে এটা তোমার টাকা? এই নাও। আমি কত্তজনকে জিজ্ঞেস করলাম। কেউ বলতে পারেনি এটা কার।
টাকা পেয়ে ঋতুর মন খুশিতে নেচে উঠল। বন্ধুদের ধন্যবাদ দিল। পরক্ষণেই দাদুর কথা মনে পড়ে গেল। দাদু ভাইয়ের উপদেশ বাণীটা বেজে উঠল তার কানে। চোখে জল নেমে এলো।
দাদু আজ বেঁচে নেই। কিন্তু একটু দেরিতে হলেও ঋতু বুঝতে পেরেছে, তার দাদু মফিজ মিয়া কখনোই বোকা ছিলেন না। তিনিই ছিলেন পৃথিবীতে একজন প্রকৃত জ্ঞানী-গুণী মানুষ।