ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নেতানিয়াহুর ক্ষমতা গ্রহণ : ছড়াচ্ছে উত্তেজনা

অধ্যাপক শাব্বির আহমদ
নেতানিয়াহুর ক্ষমতা গ্রহণ : ছড়াচ্ছে উত্তেজনা

গত ২৯ ডিসেম্বর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আবারও শপথ নিয়েছেন কট্টর ডানপন্থি নেতা হিসেবে পরিচিত বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত প্রথম মেয়াদে এবং ২০০৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় মেয়াদে টানা ১২ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকার পর ২০২২-এর ৫ জুন ইসরাইলি পার্লামেন্টে (নেসেট) একটি নতুন জোট সরকার গঠন নিয়ে বিতর্কের পর অনুষ্ঠিত অনাস্থা ভোটে হেরে গিয়েছিলেন নেতানিয়াহু। এসময় নাফতালি বেনেটের নেতৃত্বাধীন নতুন জোট সরকারের পক্ষে ভোট পড়েছিল ৬০ এবং নেতানিয়াহুর পক্ষে ৫৯। কিন্তু, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই নাফতালি বেনেটের জোটে ফাটল দেখা দেয়। ফলে ফের ক্ষমতায় ফিরে আসতে বেশি সময় লাগেনি নেতানিয়াহুর। গত ১ নভেম্বর ২০২২ নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। এ নির্বাচনে নেতানিয়াহুর দল লিকুদ পার্টি জয় পায়। গেল ২৯ ডিসেম্বর নেসেটে নেতানিয়াহুর সরকার নিয়ে অনাস্থা ভোট হয়। এতে উতরে যান তিনি। নেতানিয়াহুর নতুন সরকারের পক্ষে ভোট পড়ে ৬৩, বিপক্ষে ৫৪টি। নেতানিয়াহুর জয়ের পর এমনিতেই পশ্চিমতীর, জেরুজালেম, গাজা উপাত্যকায় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে উত্তেজনার পারদ। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের পরপরই নেসেট সদস্যদের উদ্দেশে বক্তব্যে নেতানিয়াহু ইরানকে পারমাণবিক ক্ষমতার অধিকারী হতে না দেওয়ার তার স্বভাবসুলভ দৃঢ় অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্তের পাশাপাশি অধিকৃত পশ্চিমতীরে নতুন করে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণের ওপর জোর দিলে উত্তেজনা নতুন গতি লাভ করে। বক্তব্যের এক পর্যায়ে দাম্ভিকতার সুরে নেতানিয়াহু বলেন, ‘ষষ্ঠবারের মতো আমি সরকার গঠন করতে যাচ্ছি। এবারও আমি আগের মতোই উত্তেজিত।’ নেতানিয়াহুর দম্ভোক্তির পরদিন ৩০ ডিসেম্বর ইসরাইলি দখলদারিত্বের কারণে ফিলিস্তিনিদের অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে কি-না, তা খতিয়ে দেখতে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতকে (আইসিজে) ক্ষমতা অর্পণ সংক্রান্ত এক ঐতিহাসিক প্রস্তাব গৃহীত হয় জাতিসংঘে। প্রস্তাবটির পক্ষে ভোট দেয় ৮৭ দেশ। বিপক্ষে ২৪ দেশ। আর ভোটদানে বিরত ছিল ৫৩ দেশ।

জাতিসংঘে ঐতিহাসিক প্রস্তাবটি পাস হওয়ার পরপরই ‘ইহুদি জনগণ তাদের নিজস্ব ভূমিতে দখলদার নয়, জাতিসংঘের কোনো প্রস্তাব এই ঐতিহাসিক সত্যকে বিকৃত করতে পারে না’- উল্লেখ করে ইসরাইল এই ‘ঘৃণ্য সিদ্ধান্ত’ মানতে বাধ্য নয় বলে আস্ফালন দেখালেও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, প্রস্তাবটি নিঃসন্দেহে নতুন প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর জন্য একটি চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। উল্লেখ্য, নেদারল্যান্ডসের হেগভিত্তিক ‘আইসিজে’ জাতিসংঘের শীর্ষ আদালত।

বিভিন্ন দেশের মধ্যকার দ্বন্দ্ব মেটাতে কাজ করে থাকেন এই আদালত। জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলোর আইসিজের রায় মেনে চলার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে রায় বাস্তবায়নে বাধ্য করার কোনো ক্ষমতা আদালতটির নেই। এদিকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ভোটকে স্বাগত জানিয়ে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের মুখপাত্র নাবিল আবু রুদেনেহ বলেন, ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে চলমান অপরাধের জন্য ইসরাইলকে জবাবদিহির মুখোমুখি করার সময় এসেছে। হামাসের কর্মকর্তা বাসেম নাইম বলেন, দখলদার ইসরাইলকে আটকানো ও বিচ্ছিন্ন করার ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এদিকে গত ৩ জানুয়ারি নবগঠিত নেতানিয়াহু সরকারের জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রী ইতামার বেন-গভির আল-আকসা মসজিদ এলাকায় সফরে গিয়ে উত্তেজনা আরও একধাপ এগিয়ে দেন। তার সঙ্গে যোগ হয় গত ৪ জানুয়ারি জর্দানের বাদশা কর্তৃক ‘রেড লাইন’ লঙ্ঘন করলে ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধের হুমকি। সব মিলিয়ে বেশ কিছুদিন শান্ত থাকার পর আবার উত্তপ্ত হতে চলেছে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি।

আল-আকসা মসজিদ কমপ্লেক্সটি ৩৫ একর জমির ওপর নির্মিত। এই জায়গায় অবস্থিত ইহুদিদের পবিত্র ভূমিখ্যাত ‘টেম্পল মাউন্ট’ বা ‘ঈশ্বরের ঘর’, যা মুসলমানদের কাছে ‘কুব্বাত আস সাখরা’ নামে পরিচিত। টেম্পল মাউন্টকে ঘিরে থাকা ‘ওয়েস্টার্ন ওয়াল’ ইহুদিদের কাছে ‘পৃথিবীর ভিত্তিপ্রস্তর’ হিসেবে স্বীকৃত। আন্তর্জাতিকভাবে সেখানে অমুসলিমদের যাওয়ার অধিকার স্বীকৃত হলেও প্রার্থনা করার কোনো অধিকার স্বীকার করে না মুসলিমরা। কিন্তু ইসরাইলি ইহুদিরা ব্যাপারটিকে এখন আর মেনে চলে না। সেখানে ইহুদি প্রার্থনাকারীদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এর ধারাবাহিকতায় আল-আকসায় বেন-গভিরের সফরকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের সংঘাতের আবহ তৈরি হয়। ১৯৬৭ সাল থেকে আল-আকসা মসজিদসহ ইসরাইলের রাজধানী ওল্ড সিটিতে পবিত্র স্থাপনাগুলোর রক্ষক জর্দান। বেন-গভিরের সফরের পর গত ৪ জানুয়ারি জেরুজালেমের পবিত্র স্থাপনাগুলোর ‘রেড লাইন’ লঙ্ঘন করলে ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধের হুমকি দিয়েছেন জর্দানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ। জর্দানের বাদশাহ আরও সতর্ক করেছেন যে, নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন নতুন সরকার পশ্চিমতীরে নতুন ইহুদি বসতি নির্মাণসহ জেরুজালেমে পবিত্র স্থাপনাগুলো ইস্যুতে যে ‘স্ট্যাটাস’ রক্ষা করা হয়, যদি তা পরিবর্তন করে ‘রেড লাইন’ লঙ্ঘন করে তাহলে আরেকটি ‘ইনতেফাদা’ শুরু করতে পারে ফিলিস্তিনিরা।

বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইসরাইল তার অবৈধ বসতি বিস্তার এক মুহূর্তের জন্যও থামায়নি। ইসরাইল তার সীমান্তকে এদিকে নীল নদ, ওদিকে জর্ডান নদী, আরেক দিকে ফোরাত নদী পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার মহাপরিকল্পনা কখনও লুকায়নি। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ হিসেবে জায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরাইল বিশ্বে বসবাসকারী সব ইহুদিকে ইসরাইলের নাগরিকত্ব প্রদান করে। বিশ্বের যেকোনো দেশের ইহুদি নাগরিক ইসরাইলে বসবাস করতে চাইলে অনায়াসে তাকে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ করে দেয়ার রেওয়াজ বিদ্যমান, যা পৃথিবীতে বিরল। ১৯৯৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় সম্পাদিত ইসরাইল ও ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থার (পিএলও) মধ্যে অসলো শান্তি চুক্তির ভিত্তিতে ১৯৯৬ সালে ইসরাইল পশ্চিম তীর ও গাজা ফিলিস্তিনিদের কাছে হস্তান্তর করে এবং সেখানে স্বায়ত্তশাসনের সুযোগ ছিল পুরোটাই লোক দেখানো। ততদিনে এসব অঞ্চলে অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপনের মাধ্যমে দলে ভারী হয়েছে তারা। চারিদিকে দেয়াল তুলে সীমানা নির্ধারণ, চলাফেরায় নানা ধরনের অপমানজনক বিধিনিষেধ, বিদ্বেষ, বৈষম্য এই সবকিছু মিলিয়ে বছরের পর বছর ধরে এক দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে ফিলিস্তিনিরা। এর পরও হাল ছাড়েনি ফিলিস্তিনিরা।

অন্যদিকে বছরের পর বছর সহিংসতা চালাতে গিয়ে সময়ের ব্যবধানে ইসরাইল নামক ক্ষুদ্ররাষ্ট্র আজ অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত। ইসরাইলি জনগণের মাঝেও ইসরাইলের ভবিষ্যৎ নিয়ে মারাত্মক আতঙ্ক এবং অনিশ্চয়তাবোধ তৈরি হয়েছে, যা অতীতে আর কখনও দেখা যায়নি। ফলে অনেক ইসরাইলি প্রাণভয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় আবাস গড়তে চাইছে। ভেতর থেকেই ইসরাইলের ধসেপড়া ও বিলীন হওয়ার সম্ভাবনার কথা ইসরাইলের পৃষ্ঠপোষকদের কণ্ঠেও ধ্বনিত হচ্ছে! ২০১৩ সালের ১২ মার্চ ‘নিউইয়র্ক পোস্ট’-এ মার্কিন কূটনীতির প্রবাদ পুরুষ হেনরি কিসিঞ্জারের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছিল : ১০ বছরের মধ্যে ইসরাইল আর থাকবে না। অনেক আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক কিসিঞ্জারের মতো নির্দিষ্ট করে সময়সীমার কথা উল্লেখ না করলেও তাদেরও আশঙ্কা, নিকট ভবিষ্যতে ইসরাইলের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেতে পারে।

ইসরাইলের অস্তিত্ব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন খোদ সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেটও। ২০২২ সালের ৫ জুন প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগকালে তিনি বলেছিলেন, দেশের ভবিষ্যৎ এখন বিপদের মুখে রয়েছে। নাফতালি বেনেটের আগে ইসরাইলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও সামরিক বাহিনীর সাবেক জেনারেল এহুদ বারাক গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে ২০২০ সালের ৮ এপ্রিল ইসরাইলের হিব্রু ভাষার পত্রিকা ইয়েদিয়েত অহরোনথকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ইতিহাসের নিরীখে দেখা যায় যে, ইহুদিরা কখনও ৮০ বছরের বেশি শাসনকাজ পরিচালনা করতে পারেনি। তিনি আরও বলেছিলেন, বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী ডেভিড ও হাসমোনিয়া রাজত্বকাল ছাড়া ইহুদিরা কখনও ৮০ বছরের বেশি শাসন পরিচালনা করতে পারেনি। এই দুই রাজত্বকালেও ৮০ বছর পর বিভেদণ্ডবিভ্রান্তি শুরু হয়।

অনেক আন্তর্জাতিক সমর বিশ্লেষকের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সমর্থন ছাড়া চতুর্দিক শত্রুরাষ্ট্র বেষ্টিত ক্ষুদ্রতায়নের ইসরাইলের অস্তিত্ব বিপন্ন। তাদের মতে, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী উপস্থিতি না থাকলে যে কোনো সময় বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে ইসরাইলের। সে হিসেবে অনেকে ইসরাইলকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে মানতে নারাজ।

সুতরাং ইসরাইলের অস্তিত্বের প্রশ্নে মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতার পালাবদলও যে জড়িত- তা বলাই বাহুল্য। যার লক্ষণ এরই মধ্যে ফুটে উঠেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আরব জাহানে মার্কিনিদের একচ্ছত্র আধিপত্য এখন তলানিতে। তাদের জন্য দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে আরবের মাটি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব একসময়ের সমৃদ্ধ জনপদ ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়াকে বিরাণভূমি বানিয়ে আজ নিজেরা অন্তর্কলহের অনলে পুড়ে মরছে। দীর্ঘদিনের অশান্ত মধ্যপ্রাচ্যে যখন শান্তির সুবাতাস বইছে, তখন ইউরোপের সর্বত্রে বিরাজ করছে যুদ্ধ উন্মাদনা। এটাই হচ্ছে প্রকৃতির প্রতিশোধ।

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে আমেরিকার শূন্যস্থান পূরণে এরই মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে রাশিয়া-চীন। চীন-রাশিয়া-ইরান-তুরস্কের মধ্যে গড়ে উঠেছে প্রতিরক্ষা ও অর্থনৈতিক ঐক্য। তুরস্কের সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে এখন ইরানের সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে ফেলতে চাইছে সৌদি-আমিরাত জোট। আমেরিকার প্রধান অস্ত্র আমদানিকারক সৌদি আরব ইয়েমেন আগ্রাসন চালাতে গিয়ে চোরাবালিতে আটকে পড়ে আজ মহা বেকায়দায়। সম্মানজনক প্রস্থানের পথ খুঁজে পেতে এরই মধ্যে ইরানের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে দিয়েছে সৌদি আরব। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ফিরে আসতে দেখে এবং তুরস্ক ও ইরানের বিস্ময়কর সামরিক উত্থান দেখে এরই মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় অস্ত্র নির্মাতাদের কপালে ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে। রাশিয়া পরাশক্তি ইউক্রেন যুদ্ধে জয় পেতে ইরান- তুরস্কের অস্ত্রের ওপর নির্ভরশীলতা দেখে তাবৎ বিশ্ব বিস্ময়ান্বিত। সিরিয়া, লিবিয়া, আজারবাইজানে পরাশক্তির নাকের ডগায় তুরস্কের দোর্দা- প্রতাপ দেখেছে বিশ্ববাসী। ইরানি সমরাস্ত্র ব্যবহার করে ইউক্রেনে রাশিয়া জয়ের দ্বারপ্রান্তে।

সুতরাং, ঠুনকো অভিযোগ এনে জাতিসংঘকে ব্যবহার করে কোনো মুসলিম জনপদকে বিরাণভূমিতে পরিণত করার দিন এখন আর নেই বললেই চলে। ইসরাইল অতীতে ফিলিস্তিনে নির্বিচারে গণহত্যা ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিরা ও আরব দেশগুলো কার্যকর কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলেও ২০০৬ সালে হিজবুল্লাহর সঙ্গে, ২০০৮ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত হামাসের সঙ্গে তিনটি যুদ্ধে ব্যর্থতা ইসরাইলের অপরাজেয় থাকার রূপকথাতুল্য খ্যাতি ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। আগের যুদ্ধগুলোতে কোনো আরব দেশই ইসরাইলের ভেতরে যুদ্ধ স্থানান্তরিত করতে সক্ষম হয়নি। সে সময় ইসরাইলের ইচ্ছায় যুদ্ধ সমাপ্ত হতো। অত্যাধুনিক আয়রন ডোন গাজা থেকে হামাসের নিক্ষিপ্ত ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর ধ্বংসযজ্ঞ থেকে অক্ষত রাখতে পারেনি ইসরাইলি জনগণকে। লেবাননের হিজবুল্লাহ মিলিশিয়াকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অরাষ্ট্রীয় আর্মি বিবেচনা করা হয়। ইরানের যতসব অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র ভান্ডারে সজ্জিত হিজুল্লাহ। সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, প্রচলিত যুদ্ধে আরব দেশের কোনো আর্মি হিজবুল্লাহর মতো শক্তিশালী নয়। ইরান হিজবুল্লাহর মতো বাশার আল আসাদ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় সিরিয়ায় গড়ে তুলছে অনুরূপ শক্তিশালী মিলিশিয়া বাহিনী, যাদের প্রধান লক্ষ্য ইসরাইল।

রাজনীতি, ধর্ম, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিভিন্ন ইস্যুতে অনেক ইসরাইলি নিজেরা চরমভাবে বিভক্ত। আরব-ইসরাইলি দ্বন্দ্ব ছাড়াও তাদের কেউ উদারপন্থি, কেউ কট্টরপন্থি, কেউ গণতন্ত্রী, কেউ সমাজতন্ত্রী, কেউ সংস্কারপন্থি, কেউ লিবারেল, কেউ ধার্মিক, কেউ সেক্যুলার। এর সঙ্গে আছে জাতি ও গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব। প্রায় চার বছরের ব্যবধানে পাঁচটি পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় (এপ্রিল ২০১৯, সেপ্টেম্বর ২০১৯, মার্চ ২০২০, মার্চ ২০২১ এবং নভেম্বর ২০২২) দেশটিতে। এক কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত ইসরাইলের ২২ শতাংশ আরব, যাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে গণ্য করে। এসব আরবের মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক খ্রিষ্টানও রয়েছে, যারা বরাবরই ইসরাইলবিরোধী। অধিকন্তু, বিশ্বজনমত আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ইসরাইলবিরোধী। ইসরাইলকে অন্ধ সমর্থন দেয়া মার্কিন সিনেটরদের একসময় রেওয়াজ থাকলেও, সময়ের ব্যবধানে তাতেও চিড় ধরেছে। ২০১৬ সালে জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণার ব্যাপারটি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ৪৭৮ নম্বর প্রস্তাব দ্বারা বাতিল করা হয়। অন্যদিকে আল-আকসায় ইহুদিদের ‘পবিত্র স্থান’ ঘোষণাকে নাকচ করে মুসলমানদের নিরঙ্কুশ মালিকানার কথা ঘোষণা করে। ২০১৬ সালের ১৩ অক্টোবর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো তাদের ভোটাভুটির মাধ্যমে ঘোষণা করে যে, মসজিদে আকসা শুধুই মুসলমানদের।

লেখক : শিক্ষক, কলামিস্ট ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত