ইসরাইলের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইলি কোহেন তার কার্যালয়ের বিশ্রাম কক্ষের চাবি হাতে পাওয়ার আগেই একটি উচ্চ পর্যায়ের কূটনৈতিক সংলাপ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে পড়েছেন। ৪ জানুয়ারি তিনি রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের সঙ্গে টেলিফোনে সংলাপ করেন। এর আগের দিনই টেলিফোনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্টনিও ব্লিংকেনের সঙ্গে টেলিফোন আলাপে অংশ নেন।
সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, লাভরভের দিক থেকে প্রথম কোহেনের কাছে টেলিফোন সংলাপের অনুরোধটি আসে। কোহেন কথা বলার আগে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এ বিষয়ে আলোচনা হয়। অধিকাংশ সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন হলো, যুক্তরাষ্ট্র কোহেনের মাধ্যমে লাভরভের কাছে একটি বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। কিন্তু কোনো পক্ষই এখন পর্যন্ত জানায়নি বার্তাটি কী ছিল।
ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সংলাপের খবরটি প্রকাশিত হলে ইউক্রেন সরকার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায়। তারা দাবি করে ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উচিত ছিল সবার আগে ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্র কুলেবার সঙ্গে কথা বলা।
ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়তো ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলত। কিন্তু লাভরভের কাছ থেকে টেলিফোন পাওয়ার আগ পর্যন্ত তার সঙ্গে কথা বলার পরিকল্পনা যে নেয়নি, সেটা দৃশ্যমান। এ প্রেক্ষাপটে ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরাসরি হুমকি দিয়ে বলেছেন, ইসরাইল যদি এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে সমন্বয় না করে, তাহলে তারা ভবিষ্যতে ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেবে।
এই হুমকির ব্যাপারটি দৃশ্যত এড়িয়ে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নেড প্রাইস মন্তব্য করেছেন, ‘রাশিয়ার সঙ্গে ইসরাইলের একটি সম্পর্ক আছে। রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক যেমন, তার চেয়ে ইসরাইলের সম্পর্ক ভিন্ন। ব্যাপারটা এ পর্যন্তই।’
প্রাইস আরও বলেন, ‘আমরা ধারাবাহিকভাবে একটি বিষয় দেখছি যে, বিশ্বের অনেকগুলো দেশ রাশিয়াকে তাদের অবৈধ, প্ররোচনাহীন ও অন্যায্য যুদ্ধ থেকে সরিয়ে আনার প্রচেষ্টায় যুক্ত রয়েছে।’ প্রাইসের এই বিবৃতি বলছে যে, ইসরাইলের মাধ্যমে লাভরভের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের বার্তা পাঠানোর উদ্দেশ্য হলো, ইউক্রেন সংঘাত সমাধানের একটি যোগাযোগ তৈরি করা।
ইউক্রেন সংকট নিরসনে মধ্যস্থতা করার এটিই প্রথম প্রচেষ্টা নয়। ২০২২ সালের মার্চ মাসে ইসরাইলের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নাফতালি বেনেট মস্কোয় যান রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ইউক্রেন ইস্যু নিয়ে কথা বলতে। মস্কো থেকেই তিনি সরাসরি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে কথা বলেন। এরপর মস্কো থেকে বার্লিন যান জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজের সঙ্গে আলোচনা করতে। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও জার্মানির সঙ্গে সমন্বয় করে বেনেটের ওই প্রচেষ্টা চলেছিল। পুতিনের সঙ্গে তার আলোচনা তিন ঘণ্টা ধরে চললেও শেষ পর্যন্ত কোনো ইতিবাচক ফলাফল আসেনি। পরবর্তী সময়ে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে আলোচনায় মধ্যস্থতা করতে দেখেছি তুরস্ককে। যা হোক, এক পর্যায়ে ইউক্রেন এ প্রক্রিয়া থেকে পিছিয়ে আসে। গত কয়েক মাসে অনেকবার খবরের শিরোনাম হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র চাইছে জেলেনস্কিকে আসন্ন শান্তি আলোচনার ব্যাপারে রাজি করাতে। কিন্তু জেলেনস্কি অনমনীয়ভাবে সেটা প্রত্যাখ্যান করে আসছেন। চাপের মুখে জেলেনস্কি একটি ‘শান্তি পরিকল্পনা’ প্রস্তাবও করেন। জেলেনস্কির প্রস্তাব অনুসারে রাশিয়াকে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করতে হবে এবং যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। যথারীতি সেই প্রস্তাব রাশিয়ার দিক থেকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। নিরাপত্তা কাউন্সিল যেখানে কট্টর অবস্থান নিয়েছে, সেখানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কূটনৈতিক সমাধানের কথা বলছে। ইসরাইল যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়- দুই সংস্থারই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভ্যান জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে ইসরাইল সফরে যাবেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। যা হোক, চলমান উদ্যোগটির সঙ্গে কেবল যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জড়িত।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে সর্বাত্মক হামলা শুরু করলেও মার্চ মাস থেকেই ইউক্রেনে রাশিয়ার অগ্রযাত্রা থমকে যেতে শুরু করে। তখন একটি আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল, রাশিয়া কি যুদ্ধের গতিমুখ নিজেদের দিকে ঘুরাতে ইউক্রেনে আরও সৈন্য সমাবেশ করবে? এ প্রক্রিয়ায় মস্কো কি বেলারুশকে সঙ্গী করে নেবে? রাশিয়া সে পথে পা না বাড়ানোয় ইউক্রেন সরকারের মধ্যে দৃঢ় বিশ্বাস জন্ম হয়েছে যে, তারা যুদ্ধে বিজয়ী হবে এবং রাশিয়াকে তাদের ভূখণ্ড থেকে তাড়িয়ে দিতে পারবে। কিন্তু সেটা করার জন্য ইউক্রেন পশ্চিমাদের কাছ থেকে আরও বেশি ও আরও উন্নত অস্ত্র চাইতে শুরু করে। এতে পশ্চিমাদের অস্ত্রভান্ডারে অনেকটা টান পড়ে। তাইওয়ান ইস্যুতে চীনের সঙ্গে উত্তেজনা সৃষ্টি হলে যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পারে তাদের অস্ত্রভান্ডার অনেকটাই শূন্য হয়ে যায়। রাশিয়া এর মধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছে, ইউক্রেনকে যদি পশ্চিমারা আরও অস্ত্র দেয়, তাহলে অস্ত্র পরিবহনের বহরে বোমা হামলা করতে পিছপা হবে না তারা। এ ছাড়া ইউক্রেন নয়, ন্যাটোর সঙ্গে যুদ্ধ করছে মস্কো- এ কথা রাখঢাক ছাড়াই বলে আসছে মস্কো।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বাইরে চিন্তা করলেও ইসরাইল রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে চায়। ইসরাইল ও আন্তর্জাতিক ইহুদি সম্প্রদায় রাশিয়ার ইহুদিদের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। মস্কোয় ইহুদিদের সাবেক প্রধান ধর্মযাজক এখন নির্বাসিত। দেরি হওয়ার আগেই ইহুদিদের তিনি রাশিয়া ছাড়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
ইরানের সঙ্গে রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান সামরিক সম্পর্ক নিয়েও ইসরাইলের উদ্বেগ রয়েছে। নেতানিয়াহু সরকার এরই মধ্যে সিরিয়ার দামেস্ক বিমানবন্দরে একটি অভিযান চালিয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে তাদের শান্তিচুক্তি কতটা কার্যকর রয়েছে, সেটা পরীক্ষার জন্যই সম্ভবত এই অভিযান।
এই ফাঁকে রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি আরও শোচনীয় ও উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠছে। গত কয়েক দিনে ইউক্রেনের আক্রমণে কয়েকশ সৈন্য হতাহতের ঘটনাসহ বড় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে রাশিয়ার। এসব ঘটনা মস্কোকে সতর্কবার্তা দিচ্ছে। সম্ভবত ইসরাইলের মাধ্যমে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সংলাপ সুড়ঙ্গের শেষে আলোকশিখার মতো একটি সুযোগ। কিন্তু সব পক্ষই যদি এতে সমর্থন দেয় (বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র), তাহলেই কেবল এটি আলোর মুখ দেখতে পাবে।
লেখক : স্টিফেন ব্রায়েন সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসির সিনিয়র ফেলো এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে