এক সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী সাম্রাজ্য ওসমানীয় খেলাফতের অধীন ছিল মধ্যপ্রাচ্যসহ এশিয়া ও আফ্রিকার বর্তমান ৩৫টি দেশ। শৌর্য-বীর্য, অর্থ-সম্পদ, যুদ্ধকৌশল এর দিক দিয়ে অটোমানদের টেক্কা দেওয়ার মতো অন্য রাজবংশ ছিল না তখনকার সময়ে। কিন্তু পৃথিবীর কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়। অটোমান সাম্রাজ্যের গৌরবময় উত্থানের সঙ্গে রয়েছে হতাশাময় পতন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তদানীন্তন পরাশক্তি ব্রিটেনের নেতৃত্বে মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে জার্মানির পক্ষে অটোমানদের অংশ নেওয়া ছিল ঐতিহাসিক ভুল সিদ্ধান্ত। মিত্রশক্তির জয়ের ফলে চরম দুর্যোগ নেমে আসে তুর্কি জাতির ওপর। ১৯২০ সালে অটোমান শাসক ষষ্ঠ মেহমেদ মিত্রবাহিনীর সঙ্গে অপমানজনক ‘সেভরেস’ চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। এই চুক্তির মাধ্যমে অটোমান সাম্রাজ্যের অধিকাংশ অঞ্চল ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও গ্রিস ভাগ করে নিলে বিশাল অটোমান সাম্রাজ্য ছোট্ট একটা ভূখণ্ডে পরিণত হয়। সাইপ্রাসসহ ভূমধ্যসাগর ও এজিয়ান সাগরের দ্বীপপুঞ্জগুলো গ্রিসের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হয়, যা আজকের গ্রিস-তুরস্ক সংকটের মূল কারণ।
এজিয়ান সাগর এবং কৃষ্ণসাগরের মধ্যবর্তী তুর্কি প্রণালিকে সব ধরনের শিপিং ও বেসামরিক যাতায়াতের জন্য উন্মুক্ত ঘোষণা করা হয়। তুরস্কের এক প্রান্তে ইস্তান্বুলকেন্দ্রিক অটোমান শাসক যখন মিত্রশক্তির সঙ্গে ‘সেভরেস’ চুক্তি করতে বাধ্য হন, তখন অপর প্রান্ত আঙ্কারায় সেনা কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল পাশা ওসমানীয় সামরিক অফিসারদের তার অধীনে একত্রিত করে গ্রিক, ব্রিটিশ এবং ফ্রেঞ্চ দখলদার বাহিনীকে তুর্কি ভূমি থেকে বিতাড়িত করে আঙ্কারা-ভিত্তিক ‘গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি’ নামে অস্থায়ী সরকার গঠন করেন। যার ফলশ্রুতিতে মিত্রশক্তি আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য হয়। অবশেষে ‘লুজান চুক্তি’ নামে অপেক্ষাকৃত কম মন্দ আরেকটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এর মধ্য দিয়ে আধুনিক তুরস্কের সীমানা নির্ধারিত হয়। তবে তুর্কি রাষ্ট্রের ঐতিহ্যবাহী অনেক শহর ও ভূখণ্ড যুক্ত করে দেয়া হয় অন্য দেশের সঙ্গে। নানা বিধিনিষেধ প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে চেপে বসে তুর্কি জাতির ওপর।
এ সত্ত্বেও অসীম সাহস আর অসাধারণ রণনৈপুণ্য দেখিয়ে বিলুপ্ত প্রায় একটি ঐতিহ্যমণ্ডিত জাতিকে পুনর্জীবন দান করায় ওই সময়ে শুধু তুর্কি জাতিদের নয়, গোটা মুসলিম জাহানের হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান করে নেন মোস্তফা কামাল পাশা। ওই সময়ে মুসলিম নবজাতকের নাম মোস্তফা কামাল পাশা রাখার হিড়িক পড়ে গিয়েছিল বিশ্বব্যাপী। কামাল পাশা উপাধি পান ‘গাজী’ এবং ‘আতাতুর্ক’ বা তুর্কি জাতির জনক হিসেবে। তুরস্কে এখনও কামাল পাশার বিরুদ্ধাচরণ আইনের দৃষ্টিতে দেশদ্রোহীতার শামিল মনে করা হয়।
সেভরেসে চুক্তির পর আঙ্কারায় মোস্তফা কামাল পাশার নেতৃত্বে গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি (জিএনএ) সরকার শুরুতেই ইস্তান্বুলকেন্দ্রিক অটোমান সুলতান ষষ্ঠ মেহমেদের সঙ্গে কোনো সংঘাতে জড়ায়নি। ওই সময়ে জিএনএ সরকার একে একে হানাদারদের তুরস্কের মাটি থেকে উৎখাত করতে থাকলে দ্বৈত শাসনাধীন তুরস্কের জনগণ অটোমান শাসকের পরিবর্তে মোস্তফা কামাল ও তার রাজনৈতিক দলের প্রতি আস্থাশীল হয়ে ওঠে।
প্রথম দিকে মনে হচ্ছিল কামাল পাশার নেতৃত্বাধীন নতুন তুর্কি সরকার বোধহয় ওসমানীয় সালতানাতের পরিবর্তে ইসলামের নতুন বাহক হিসেবেই কাজ করছে। গ্র্যান্ড জিএনএ সরকার একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে, যাতে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হয় এবং এটাও বলা হয় যে, প্রতিটি আইনই ইসলামিক আইন বিশারদদের সমন্বয়ে গঠিত একটি প্যানেল কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে, যাতে কোনো আইন শরিয়াহর সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়।
রাতারাতি বিলুপ্ত সাধন করলে ওসমানীয় খেলাফতের প্রতি সংবেদনশীল বিশ্বের আপামর মুসলমানদের সেন্টিমেন্ট এবং বৃহত্তর তুর্কি জনগণের মাঝে অসন্তোষ সৃষ্টি করবে, তা বুঝতে পেরে আতাতুর্ক এই বলে সাফাই গাইতে থাকেন যে, তিনি আসলে চিরাচরিত ইসলামিক সরকার ব্যবস্থাতেই ফিরে যাচ্ছেন! কিন্তু কট্টর জাতীয়তাবাদী ও ইসলাম বিদ্বেষী কামাল আস্তে আস্তে স্বরূপে আবির্ভূত হতে থাকেন। শেষ ওসমানীয় খলিফা আব্দুল মজিদের (১৯২২-২৪) সময় খেলাফতের পক্ষে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুসলমানদের সমর্থনকে কামাল পাশা তুরস্কের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বহির্বিশ্বের হস্তক্ষেপ হিসেবে বর্ণনা করে ১৯২৪ সালের ৩ মার্চ খেলাফতকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে ওসমানীয় পরিবারের সদস্যদের লন্ডনে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেন।
এসময় মুস্তাফা কামাল প্রচার করতে শুরু করেন ‘ইসলাম গ্রহণ করার আগেও তুর্কিরা একটি মহান’ জাতি ছিল। ইসলাম ধর্ম আরব, পারসিক এবং মিশরীয়দের সঙ্গে তুর্কিদের সমন্বয় তো করেইনি বরং তুর্কি জাতির ঐক্যে ফাটল ধরিয়ে তুর্কি জাতীয়তাবোধকে অসার করে দিয়েছে। সুতরাং তুর্কি জাতীয়তাবোধ পুনঃ প্রতিষ্ঠাই তার উদ্দেশ্য। তার এই মতবাদ তুরস্কের নতুন প্রজন্মকে কট্টর জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করে। এসময় খেলাফত বিলুপ্ত করে কামাল পাশা তুরস্ককে একটি পশ্চিমা ভাবধারার ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিণত করেন। ইসলামবিরোধী বিভিন্ন নীতি গ্রহণ এবং বিভিন্ন ধর্মীয় অবকাঠামো ধ্বংসের পাশাপাশি শরিয়া আদালত অবৈধ ঘোষণা করে দেশের সকল কাযীকে বরখাস্ত করেন। তিনি সব রাষ্ট্রীয় কার্যকে ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত করেন।
এদিকে লুজানের চুক্তির অনেক সীমাবদ্ধতার পরও এটিকে একটি কূটনৈতিক বিজয় হিসেবে দেখেছিলেন কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বাধীন তুর্কি সেকুলাররা।
শুরু থেকেই তারা পররাষ্ট্রনীতিতে ইউরোপ এবং আমেরিকাকে প্রাধান্য দেন। কিন্তু, লুজান চুক্তি দ্বারা শৃঙ্খলিত তুরস্কের অর্থনীতিকে দুর্বল করে রাখার ফলে ইউরোপের রুগ্ণ দেশের তকমা লেগে যায় তুরস্কের গায়ে। ১৯৫২ সালে দেশটি ন্যাটোতে অংশগ্রহণ করে। এরদোগানের নেতৃত্বে তুর্কি নেতৃত্ব প্রকাশ্যে লুজান চুক্তির গুরুত্বকে প্রত্যাখ্যান করে বক্তৃতা বিবৃতি শুরু হয়। ২০১৬ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট এরদোগান লুজান চুক্তিকে ‘সেভরেস’ চুক্তির একটি সামান্য আপগ্রেড হিসেবে চিত্রিত করে একে পরাজয় বলে অভিহিত করেন।
তিনি বারবার বলে আসছেন, লুজান চুক্তি ভূমধ্যসাগর ও কৃঞ্চসাগরে তুর্কি উপকূলের কাছাকাছি অবস্থিত দ্বীপপুঞ্জের নিয়ন্ত্রণ ও স্বার্থ সুরক্ষিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ২০১৮ সালে জাতিসংঘে ভাষণদানকালে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা দেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তুরস্কের ন্যায্য অধিকারের প্রতি সম্মান না দেখালে ১৯২৩ সালে লুজান চুক্তির মাধ্যমে যে মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে, আঙ্কারা প্রয়োজনে তা ছিঁড়ে ফেলে দেবে। তবে অনেকের মতে, নিও-অটোমানিজমের উত্থান প্রাথমিকভাবে তুরস্কের সাবেক রাষ্ট্রপতি তুরগুত ওজালের (১৯৮৯-৯৩) সময় থেকেই শুরু হয়। নাজমুদ্দিন আরবাকানের আমলে তা আরও শানিত হয়।
এরদোয়ান ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তুরস্কের সামরিক শক্তিকে সংহত করার চেষ্টা শুরু করেন। গত এক দশকে তুরস্কের সামরিক ব্যয় ৮৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাঁর ইস্পাত-দৃঢ় নেতৃত্বে তুরস্ক বর্তমান বিশ্বে শীর্ষস্থানীয় ১০টি সমরাস্ত্র বিক্রেতা দেশের অন্যতম। তুরস্কের সমরাস্ত্র ভান্ডারে তৈরি হচ্ছে অত্যাধুনিক যতোসব অস্ত্র। এসব অস্ত্রের সফল প্রয়োগ ও অপারেশন কৌশল দেখে তাবৎ বিশ্ব আজ বিস্ময়ান্বিত। ২০২৩ সালে তুরস্ক প্রজাতন্ত্র উদযাপন করবে ১০০তম বার্ষিকী। এই উপলক্ষে তুরস্কের প্রতিরক্ষা বাহিনীর অস্ত্রাগারে বহুল প্রতীক্ষিত নতুন বেশ কিছু প্ল্যাটফর্ম যুক্ত হতে যাচ্ছে।
তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পের এই প্ল্যাটফর্মগুলো সশস্ত্র বাহিনীতে যুক্ত হলে তার একটা ঝলক বিশ্ববাসী দেখতে পাবে।
দেশটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি প্রকল্প হলো ন্যাশনাল কমব্যাট এয়্যারক্র্যাফট বা এমএমইউ। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে টার্কিশ অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ বা টিএআই। ২০২৩ সালের ১৮ মার্চ এই প্রকল্পের অধীনে তৈরি বিমানগুলো হ্যাঙ্গার থেকে অবমুক্ত করা হবে। টিএফ-এক্স এমএমইউ হলো পঞ্চম প্রজন্মের জেট বিমান, যেগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের লকহিড মার্টিনের এফ-৩৫ লাইটনিং টু বিমানের মতো একই ধরণের বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তুর্কি বিমান বহরের এফ-১৬ জেট বিমানগুলোর বদলে আরও আপগ্রেড করা হবে। তুর্কি বিমান বাহিনীর বহরের আপগ্রেড করা সবগুলো এফ-১৬ বিমান। বিমানগুলো ২০২৫ সালে প্রথম আকাশে ওড়ানো হবে। আর ২০২৮ সালে এগুলো সরাসরি অভিযানে ব্যবহার করা শুরু হবে। এই বিমান তৈরির মাধ্যমে তুরস্ক সেই সব দেশের তালিকায় চলে যাবে, যাদের কাছে পঞ্চম প্রজন্মের বিমান তৈরির অবকাঠামো ও প্রযুক্তি রয়েছে।
সাম্প্রতিক সময় বেশ কিছু যুদ্ধের গতিপথ বদলে দেয়া বায়রাক্তার টিবি-টু ড্রোনের পর তুরস্ক এবার আবিষ্কার করেছে ‘বায়রাক্তার কিজিলেলমা’ নামে মনুষ্যবিহীন জঙ্গি বিমান, সেটিও প্রথমবারের মতো আকাশে উড়বে ২০২৩ সালে। বিস্ময়ে ভরা এই বিমানগুলো পাঁচ ঘণ্টা পর্যন্ত আকাশে থাকতে পারবে এবং ৩৫-৪০ হাজার ফুট উচ্চতার মধ্যে অভিযানে অংশ নিতে পারবে। ঘণ্টায় ৯০০ কিলোমিটার বেগে চলা বিমানটি শব্দের গতি (সুপারসনিক) ছাড়িয়ে যাবে। সব ঠিকঠাক থাকলে কিজিলেলমা ঘণ্টায় কমপক্ষে ১১০০ কিমি. ভ্রমণ করবে। এর অর্থ দীর্ঘ দূরত্বে কাজ করার ক্ষমতা। এগুলো দেড় টন ওজনের সমরাস্ত্র বহন করতে পারবে।
পাইলট হারানোর অর্থ কখনও কখনও যুদ্ধ হারানো। কিন্তু মনুষ্যবিহীন কিজিলেলমা যুদ্ধে অনেক বেশি বিপজ্জনক মিশন করতে পারে। তুরস্ক টিসিজি আনাদোলু নামে যে রণতরী তৈরি করছে, সেখান থেকে ‘কিজিলেলমা’ উড়তে ও অবতরণ করতে পারবে। তুরস্ক যে ‘ফ্ল্যাগশিপ’ জাহাজ তৈরি করছে, সেটি হবে দেশের তৈরি বিশ্বের অন্যতম বড় যুদ্ধজাহাজ। ২০২৩ সাল শেষ হওয়ার আগেই এটা নৌবাহিনীর বহরে যুক্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এজিয়ান সাগর, কৃষ্ণ সাগর ও ভূমধ্যসাগরে এবং প্রয়োজনে ভারত ও আটলান্টিক মহাসাগরের জলসীমায় অভিযানের ক্ষেত্রে এই জাহাজকে কাজে লাগাতে পারবে তুরস্কের নৌবাহিনী।
২০০৩ সাল থেকে দেশটির নেতৃত্বদানকারী এরদোগানকে বেশিরভাগ তুর্কি আতাতুর্কের পর সবচেয়ে ক্যারিশম্যাটিক নেতা বলে গণ্য করেন। তুরস্কের পল্লীর মানুষ, সুন্নি মুসলমান ও জাতীয়তাবাদীরা হলেন তার মূল সমর্থক। তিনি তুরস্ককে সেক্যুলারিজমের নিগড় থেকে তুলে নতুন করে ইসলামি ধারায় নিয়ে এসেছেন। তিনি তুরস্ককে আধুনিক ও শিল্পোন্নত দেশে পরিণত করে বিশ্বের মানচিত্রে একটি নেতৃস্থানীয় ও মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে এনে দাঁড় করিয়েছেন। এরদোগান শুধু তুরস্ক সংক্রান্ত বিষয়েই না, বরং মুসলিম বিশ্বের একজন প্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে বারবার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে গিয়েছেন।
কাশ্মীর ইস্যু, ফিলিস্তিন ইস্যু এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে তিনি সব সময়েই ছিলেন অন্য যেকোন মুসলিম নেতার চেয়ে বেশি সোচ্চার। বিভিন্ন সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের প্রতি সরাসরি করা বিরোধিতা এরদোগানকে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুকে সরাসরি একটি সন্ত্রাসী দেশের নেতা এবং গাজা অঞ্চলকে ‘উন্মুক্ত কারাগার’ হিসেবে উল্লেখ করে ইসরাইলি আগ্রাসনের নিন্দা জানানোর বিষয়গুলো এরদোগানের প্রতি সাধারণ মুসলমান সমাজের ঝুঁকে পড়ার অন্যতম কারণ।
সমকালীন মুসলিম বিশ্বে এরদোয়ানকে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা হিসেবে মনে করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকা, রাশিয়া, ফ্রান্সের মতো দেশের নাকের ডগায় তিনি সিরিয়া, লিবিয়া এবং আজারবাইজানে যে দুঃসাহসিকতা দেখিয়েছেন ওসমানীয় খেলাফতের পতনের মুসলিম বিশ্ব আর দেখেনি। তাদের হয় অসহায় আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে, নয়তো পরাশক্তিগুলোর দয়াদাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়েছে। সুতরাং, আজ ককেশাসের পাহাড়ে, সাহারার মরুভূমিতে, আফ্রিকার জঙ্গলে, উপসাগরীয় অট্টালিকায়, দক্ষিণ এশিয়ার মাটির ঘরে প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলোতে যদি তুরস্কের জন্য মানুষের মন কাঁদে; তাহলে ধরে নিতে হবে তুরস্ক ওই অঞ্চলের মানুষের মন জয় করে নিয়েছে।
আজ তুরস্ক যদি পরাশক্তির বিরুদ্ধে পায়ে খামি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, তাহলে বুঝতে হবে তুরস্কের সামরিক শক্তি ফেলে দেয়ার মতো নয়। আজ তুরস্ক যদি শত চাপের পরেও তার অর্থনীতি নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে, তাহলে বুঝতে হবে তুরস্ক এত ভঙ্গুর নয়। আজ তুরস্ক যদি তার বন্ধুরাষ্ট্রের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের বিজয় এনে দিতে পারে (যেমন আজারবাইজান, কাতার, লিবিয়া, সোমালিয়া) তাহলে বুঝতে হবে এরদোয়ান তথা তুরস্কের সঙ্গে বন্ধুত্ব শুধু তাসের ঘর নয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়নকে কেন্দ্র করে দুই কেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। নব্বইয়ের দশকের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এককেন্দ্রিক বিশ্ব গড়ে উঠেছিল। কিন্তু, তিন দশকে নদণ্ডনদী দিয়ে বহু পানি সাগর-মহাসাগরে বয়ে গেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন শক্তি এখন বিশ্ব শাসনে তৎপর। চীন অপ্রতিরুদ্ধ অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে গেছে। আফগানিস্তানে লজ্জাজনক পরাজয় বিশ্বব্যাপী মার্কিন সামরিক সক্ষমতা প্রশ্নের সম্মুখীন। ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক দুর্বলতা স্পষ্ট হয়েছে। বিপরীতে তুরস্ক-ইরানের মতো দেশের বিস্ময়কর সামরিক উত্থান ঘটেছে। চীন-রাশিয়ার যুগলবন্দি আর সঙ্গে ইরান, ভেনিজুয়েলা, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনাসহ অজস্র তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশের অংশগ্রহণ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এতদিন চলমান বিশ্ব ব্যবস্থাকে একটি কার্যকরী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করেছে। ২০২৩ সাল তুরস্কে অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় নির্বাচন। যদি দৈবিক কোনো ঘটনা না ঘটে, তবে ধারণা করা হয়, খুব শিগগির এরদোয়ানের তুরস্ক হয়ে উঠবে মুসলিম বিশ্বের সত্যিকার নতুন নেতা ও পরাশক্তি।
লেখক : কলামিস্ট ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক