ফিলিস্তিনের জেনিনে ইসরাইলের ভয়াবহ সামরিক অভিযানের কয়েকদিনের মধ্যেই শুক্রবার জেরুজালেমে একটি ইহুদি প্রার্থনাস্থলে বন্দুকধারীর গুলিতে অন্তত সাতজন নিহত হয়েছে। আর সাম্প্রতিক সময়ে দু’পক্ষের মধ্যে এমন হামলা ও সহিংসতা তীব্র আকার নেয়ায় প্রশ্ন উঠছে, ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকট সমাধানে যে দ্বি-রাষ্ট্র তত্ত্ব এসেছিল- তার কী কোনো ভবিষ্যৎ আছে? নাকি এটি কার্যত বাতিল হয়ে গেছে?
দীর্ঘদিন ধরে চলমান ইসরাইল-ফিলিস্তিনের সংকট নিরসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্তই ছিল দুই পক্ষের জন্য আলাদা দুটি দেশ। আর এই দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের তত্ত্বটি এসেছিল ১৯৯৩ সালে অসলো শান্তি আলোচনার মাধ্যমে এবং দু’পক্ষই তাতে সম্মত হয়েছিল। কিন্তু পরিস্থিতি এখন অনেকটাই বদলে গেছে এবং এক সময়ে ইসরাইলের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক ছিল- এমন কয়েকটি মুসলিম দেশ এখন ইসরাইলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরি করেছে। আবার অসলো শান্তি আলোচনায় মধ্যস্থতাকারী আমেরিকা সবসময় দ্বি-রাষ্ট্র তত্ত্বের কথা বললেও সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরাইলে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে সরিয়ে আনার পর ওই তত্ত্বের অপমৃত্যুই হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত ফিলিস্তিনিদের মারাত্মকভাবে ক্ষুব্ধ করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র যেদিন জেরুজালেমে তাদের দূতাবাস উদ্বোধন করছিল সেদিন গাজা পরিণত হয়েছিল এক রক্তাক্ত প্রান্তরে। সেদিন গাজায় নিহত হয় ৫৮ জন, আর আহত হয় আরও প্রায় তিন হাজার। ২০১৪ সালের গাজা যুদ্ধের পর এক দিনে এত বেশি ফিলিস্তিনির প্রাণহানির ঘটনা আর ঘটেনি।
ইসরাইল দাবি করে জেরুজালেমের ওপর তাদের সার্বভৌম অধিকার রয়েছে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে তারা পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয় এবং জেরুজালেমকে তাদের রাজধানী বলে গণ্য করে। কিন্তু অনেক দেশই একে স্বীকৃতি দেয়নি। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিরা পূর্ব জেরুজালেমকে তাদের রাজধানী হিসেবে চায়। কিন্তু আমেরিকা জেরুজালেমে দূতাবাস সরিয়ে নেয়ার পর কার্যত ফিলিস্তিনিদের দাবি গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের মূলে একটি বড় আঘাতই করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ইস্তান্বুলভিত্তিক বিশ্লেষক মুরাত আসলান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, মিস্টার ট্রাম্প ও তার জামাতা জ্যারেড কুশনার একটি চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছেন। ‘দ্বি-রাষ্ট্র তত্ত্ব আসলে কোনো সমাধান হয়ে উঠতেই পারেনি। কারণ এখানে এক পক্ষ ডিকটেট করে। এক পক্ষ নিয়ন্ত্রণ করলে সমাধান আসে না। এ তত্ত্বের যেসব শর্ত আছে সেগুলোই কার্যকর হয়নি,’ বলছিলেন মিস্টার আসলান।
তার মতে ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের মধ্যে এখন যে সহিংসতা চলছে, সেটি নিয়ন্ত্রণ এবং দীর্ঘদিনের চলে আসা সংকট নিরসনের জন্য বিশ্বাসযোগ্য কারও মধ্যস্থতায় নতুন করে আলোচনা শুরু হতে পারে।
তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বি-রাষ্ট্র নীতির দরকার নেই বলে মন্তব্য করলেও এখনকার মার্কিন প্রশাসন বলছেন তারা দ্বি-রাষ্ট্র নীতি সমর্থন করেন। এর আগে হিলারি ক্লিনটন পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন বলেছিলেন যে, ইসরাইলের স্বার্থেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন।
কীভাবে এলো দ্বি-রাষ্ট্র নীতি
দীর্ঘদিনের সংঘাত সহিংসতার পর ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বাধীন পিএলও ও ইসরাইল একটি শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে এবং সেই চুক্তি অনুযায়ী তাদের একে অন্যকে স্বীকার করে নেয়ার কথা। পিএলও সহিংসতা এবং সন্ত্রাসবাদের পথ পরিহার করে ইসরাইলের অস্তিত্ব স্বীকার করে এবং শান্তির অঙ্গীকার করে। কিন্তু ইসরাইল এই প্রতিশ্রুতি কখনোই বাস্তবায়ন করেনি। তারা বরং অধিকৃত এলাকায় ইহুদি বসতি গড়ে তোলে। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিদের আরেকটি সংগঠন হামাস কখনও এই চুক্তিকে মেনে নেয়নি। যদিও ইসরাইলি-ফিলিস্তিনি শান্তি চুক্তির অধীনেই গঠিত হয়েছিল ‘প্যালেস্টিনিয়ান ন্যাশনাল অথরিটি’ বা ফিলিস্তিনি জাতীয় কর্তৃপক্ষ। এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ফিলিস্তিনি সরকার। তবে অবাক করার মতো ব্যাপার ছিল যে, ইসরাইলি এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে দ্বন্দ্বের অন্যতম উৎস জেরুজালেম হলেও, এই অসলো শান্তি চুক্তিতে জেরুজালেমের বিষয়টি আসেইনি। শেষ পর্যন্ত ২০১৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭০তম অধিবেশনে ঘোষণা দেন যে, তারা আর এই চুক্তি মেনে চলতে বাধ্য নন, কারণ ইসরাইল এই চুক্তি মেনে চলেনি।
অবশ্য ২০১২ সালের ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে একটি প্রস্তাব ভোটে পাস হয় যাতে ফিলিস্তিনকে ‘নন মেম্বার অবজারভার স্টেট’ বা পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের মর্যাদা দেয়া হয়। এর ফলে ফিলিস্তিনিরা এখন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বিতর্কে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। তারা জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা এবং প্রতিষ্ঠাগুলোর কাজেও অংশ নিতে পারে। অবশ্য ২০১১ সালে একটি পূর্ণ সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিন জাতিসংঘের স্বীকৃতি পাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের আপত্তির কারণে সেই চেষ্টা সফল হয়নি। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সদর দপ্তরের বাইরে ফিলিস্তিনি জাতীয় পতাকা উত্তোলনেরও স্বীকৃতি মেলে। কিন্তু এরপরেও জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস সরিয়ে নেয়াসহ দখলকৃত এলাকাগুলোয় ইহুদি বসতি স্থাপনের প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একতরফা সমর্থনের মাধ্যমে দ্বি-রাষ্ট্রনীতির অপমৃত্যুই ঘটেছে বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক।
ফিলিস্তিনি এবং ইসরাইলিদের মধ্য বিরোধের মূল বিষয়গুলো কী?
একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বিলম্ব, পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি নির্মাণ অব্যাহত রাখা এবং ফিলিস্তিনি ও ইহুদি এলাকার মধ্যে নিরাপত্তা প্রাচীর তৈরি করা- এগুলো শান্তি প্রক্রিয়াকে বেশি জটিল করে ফেলেছে। যদিও দ্য হেগের আন্তর্জাতিক আদালত পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি নির্মাণকে অবৈধ ঘোষণা করেছে।
কিন্তু দুই পক্ষের মধ্যে শান্তির পথে এগুলোই একমাত্র বাধা নয়। বিল ক্লিনটন যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, তখন ক্যাম্প ডেভিডে ২০০০ সালে তিনি যে শান্তি আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেখানে এর ব্যর্থতার আরও অনেক কারণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।
তৎকালীন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী এহুদ বারাক এবং ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত সেই বৈঠকে একমত হতে পারেননি আরও অনেক বিষয়ে। যেসব বিষয়ে মতপার্থক্য-
জেরুজালেম : ইসরাইল দাবি করে জেরুজালেমের ওপর তাদের সার্বভৌম অধিকার রয়েছে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে তারা পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয়। এরপর থেকে তারা জেরুজালেমকে তাদের রাজধানী বলে গণ্য করে। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিরা পূর্ব জেরুজালেমকে তাদের রাজধানী হিসেবে চায়।
সীমান্ত এবং এলাকা নিয়ে বিরোধ : ফিলিস্তিনিরা চায় ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের আগে যে সীমান্ত ছিল, সেই সীমানার ভিত্তিতে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠিত হবে। ইসরাইল এটা মানতে নারাজ।
ইহুদি বসতি : ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরাইল যেসব ফিলিস্তিনি এলাকা দখল করে নিয়েছিল, সেখানে তারা অনেক ইহুদি বসতি গড়ে তুলেছে। আন্তর্জাতিক আইনে এসব বসতি অবৈধ। কেবল পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেমেই এখন বসতি গেড়েছে পাঁচ লাখের বেশি ইহুদি।
ফিলিস্তিনি শরণার্থী : ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেখান থেকে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে এসেছিল লাখ লাখ ফিলিস্তিনি। তারা ইসরাইলের ভেতর তাদের বাড়িঘরে ফিরে যাওয়ার অধিকার দাবি করে আসছে। পিএলওর হিসাবে এই ফিলিস্তিনি এবং তাদের বংশধরদের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৬ লাখ। কিন্তু ইসরাইল এই অধিকারের স্বীকৃতি দিতে চায় না। তাদের আশঙ্কা, এত বিপুলসংখ্যক ফিলিস্তিনি যদি ইসরাইলে ফিরে আসে, তাদের রাষ্ট্রের ইহুদি চরিত্র আর ধরে রাখা যাবে না।
* বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনের আলোকে