এক সময় যে ইউরোপকে বলা হতো উদারপন্থি গণতন্ত্রের দুর্গ। সেখানে অনেকদিন ধরেই জাতীয়তাবাদী, উগ্র রক্ষণশীল, অভিবাসনবিরোধী এবং ইসলামবিদ্বেষী রাজনৈতিক দলের উত্থান ঘটছে। দিন দিন ছড়িয়ে পড়েছে ধর্মবিদ্বেষ, বর্ণবিদ্বেষ ও ঘৃণার বিষ। ধীরে ধীরে ইউরোপের ডানপন্থি ও ইসলামবিদ্বেষীরা উগ্র ও হিংস্র হয়ে উঠছে। মুখে বাকস্বাধীনতা, মানবতা, সভ্যতা, মূল্যবোধের কথা বলা হলেও অন্য ধর্মের সংস্কৃতি বা ধর্মীয় প্রতীকগুলোকে অবমূল্যায়ন করা বা তাদের উপহাসের শিকার করা রীতিমতো ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। ইউরোপে রাস্তাঘাট, শপিংমল, মসজিদ, এমনকি বাসাবাড়িতে গিয়েও খ্রিষ্টান উগ্রপন্থিরা মুসলমানদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। ইউরোপের সংশ্লিষ্ট দেশের সরকার উগ্রপন্থিদের এসব অপকর্মকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বলে নিজেদের দায় এড়িয়ে যাচ্ছে। অন্যের ধর্মানুভূতিতে মারাত্মক ধরনের ক্ষতের প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এমন উস্কানিমূলক ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ যদি মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অংশ হতে পারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, তাহলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নতুন করে সর্বজনীন সংজ্ঞা ঠিক করতে হবে।
জার্মানির হিটলার আর ইতালির মুসোলিনির উগ্র জাতীয়বাদ ও সম্প্রসারণবাদ নীতির কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শুধু জার্মানি আর ইতালি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল তা নয়, পুরো ইউরোপই মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছিল। যুদ্ধের পর ইউরোপজুড়ে গড়ে ওঠে নাৎসিবাদ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জনমত। ইউরোপজুড়ে নিষিদ্ধ করা হয় এই দুই মতবাদ। জার্মানি আর ইতালি ফ্যাসিবাদী ও নাৎসিবাদীদের খুঁজে খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনতে থাকে। দশকের পর দশক ধরে চলতে থাকে এই বিচার প্রক্রিয়া। পরপর দুটি বিশ্বযুদ্ধের তিক্ত অভিজ্ঞতার পর মানুষের বাক স্বাধীনতা, মানবাধিকার, আইনের সঠিক প্রয়োগ, নিয়ন্ত্রণমুক্ত বিচারব্যবস্থা, অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ও ধর্মনিরপেক্ষতাসহ নানা বিষয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে ১৯৫৭ সালে ২৭টি দেশের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
মানবতাবাদী শান্তিপূর্ণ জোট হিসেবে পৃথিবীজুড়ে এই জোটের মোটামুটি সুনাম রয়েছে। এতো তিক্ত অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও ইউরোপের বুকে আবার দেখা দিয়েছে ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের উত্থান, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপের উদার গণতান্ত্রিক ও সহনশীল সমাজব্যবস্থার সম্পূর্ণ পরিপন্থি।
অনেকদিন ধরেই জাতীয়তাবাদী, উগ্র রক্ষণশীল, অভিবাসনবিরোধী এবং ইসলামবিদ্বেষী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে ভালো করে আসছে। রক্ষণশীল ডানপন্থিরা একাধিক দেশে সরকারও গঠন করেছে। হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ডের মতো দেশে কট্টর ডানপন্থি সরকার আগে থেকেই ক্ষমতায় রয়েছে। ফ্রান্সের কট্টর ডানপন্থি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ তো অনেক আগেই সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন। এদিকে নাৎসি যুগের পর জার্মানিতে কট্টর ডানপন্থি দল ‘এএফডি’ বর্তমান সরকারে অন্যতম বিরোধী দলের ভূমিকায় থেকে রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের সৃষ্টি করেছে।
সুইডেনে অভিবাসনবিরোধী ‘সুইডেন ডেমোক্র্যাট’ দল নতুন সরকার গড়েছে ২০২২ সালের মে মাসে। মূলধারার রাজনীতিতে প্রবেশ করা এই দলের রয়েছে নব্য নাৎসিবাদী শেকড়। সবশেষ ইতালিতেও জর্জিয়া মেলোনির কট্টর ডানপন্থি ও রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদী দল গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বরের নির্বাচনে ক্ষমতায় বসল। রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, দুটি বিশ্বযুদ্ধের পরে জার্মানি যতটা দক্ষ হাতে হিটলারের নাৎসিবাদের মূল উৎপাটন করেছে, ইতালি ততটা পারেনি। যার ফলে সেখানে মুসোলিনির ডানপন্থি ফ্যাসিস্ট আদর্শের অনুসারী অতি রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদী দলগুলো বেড়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছে।
ইউরোপে অতীতে মুসলমানদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে ব্যঙ্গ করে বই লেখা, কার্টুন আঁকা এবং পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন পোড়ানোর ঘটনা ঘটলেও গত ২১ জানুয়ারি সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে তুরস্কের দূতাবাসের সামনে পবিত্র কোরআন পোড়ানোর ঘৃণ্য দৃশ্যটি ছিল ব্যতিক্রম। উগ্র ডানপন্থি রাজনৈতিক দল হার্ড লাইনের বিতর্কিত নেতা রাসমুস পালুদান পুলিশি নিরাপত্তার মধ্যে কোরআনের একটি কপিতে আগুন ধরিয়ে দেয়ার আগে প্রায় এক ঘণ্টা ইসলাম ধর্ম ও সুইডেনের অভিবাসনব্যবস্থাকে আক্রমণ করে গালিগালাজপূর্ণ বক্তব্য রাখেন।
বলা যায়, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় রাসমুস পালুদান নির্বিঘ্নে কাজটি সেরে ফেলেন। ২০১৯ সালের ১৮ নভেম্বর নরওয়ের ক্রিস্টিয়ানস্যান্ড শহরে অতীতে এভাবে কোরআনে আগুন দিতে গিয়ে উপস্থিত মুসলিম যুবকের হামলার ঘটনার কথা মাথায় রেখে স্টকহোম পুলিশের সতর্ক পাহারা ছিল বলে ধারণা হয়।
শুরু হয় মুসলিম বিশ্বে প্রতিবাদের ঝড়। সুইডেনের এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ডেনমার্কের রাজপথেও পুলিশ পাহারায় এই পবিত্র গ্রন্থটি পোড়ানো হয়েছে। বিশ্বের এক-চতুর্থাংশের বেশি জনগোষ্ঠীর হৃদয়ে আঘাত লাগার মতো ন্যক্কারজনক বিষয়ে জাতিসংঘের পক্ষে নিন্দা জানানো হলেও বিবৃতির ভাষা ছিল একেবারে সাধামাটা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষে কোনো বিবৃতিই দেয়া হয়নি। অথচ তার বিপরীতে কোনো মুসলিম রাষ্ট্রে পুলিশ পাহারায় খ্রিষ্টানদের ধর্মগ্রন্থ পবিত্র ‘বাইবেল’ পোপড়ানো হলো ইউরোপসহ খ্রিষ্টান বিশ্বে প্রতিক্রিয়াটা কেমন হতো তা সহজে অনুমেয়।
এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, পশ্চিমা বিশ্বে ইসলামণ্ডফোবিয়া তৈরির জন্য মুসলিম নামধারী কিছু জঙ্গি সংগঠনও দায়ী। তাদের কারণে মুসলিম সমাজের কেউ কেউ বিভ্রান্ত হয়ে জঙ্গি কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছে এবং এখনও লিপ্ত রয়েছে। তাই মূলধারার মুসলিম সমাজ থেকে বারবার প্রশ্ন উঠছে, ইসলামের নাম ভাঙিয়ে যারা জঙ্গি কর্মকাণ্ডে লিপ্ত, তারা আদৌ মুসলমান কি-না? তারা হয় বিভ্রান্তির পথে আছে, নয়তো জেনে বা না জেনে অন্য কোনো গোষ্ঠীর প্ররোচনায় জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছে। অবশ্যই এমন হতে পারে যে, কোনো পক্ষের হয়ে কাজ করার জন্য তাদের তৈরি করা হয়েছে। তবে একথা বলতে কোনো দ্বিধা নেই যে, গুটি কয়েক জঙ্গিবাদীর জন্য বিশ্বের প্রায় ১৮০ কোটি মুসলমানের সন্ত্রাসী তকমা লাগানো এক প্রকার মূর্খতা কিংবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ইসলামণ্ডফোবিয়ার জন্য অপপ্রচার যেমন দায়ী, তেমনি বিভিন্ন ধর্মের ডানপন্থিরাও দায়ী। তারা সহজেই সাধারণ মানুষকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিভ্রান্ত করছে।
সুতরাং এটা কমাতে হলে উভয় সমাজের মেলবন্ধন জোরদার করতে হবে। মানুষে মানুষে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। আশার কথা হচ্ছে, এ ধরনের উদ্যোগ কিন্তু রয়েছে অনেক রাষ্ট্রে। কোথাও সরকারিভাবে কাজ করা হচ্ছে। কোথাও নাগরিক সমাজ উদ্যোগী হচ্ছে। কোথাও আবার বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন এগিয়ে এসেছে।
ধর্মগ্রন্থ পুড়িয়ে কোনো ধর্মের অগ্রযাত্রা রোধ করা যায় না। এটি নিচু মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। এতে সমাজ ও রাষ্ট্রে শুধু অস্থিরতা সৃষ্টি হয় এবং এটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকে অসম্ভব করে তোলে। এই ধরনের কোরআন পুড়িয়ে দেওয়ার ফলে অতীতে কোরআনের কোন ক্ষতি হয়নি। যদি হতো বাগদাদে হালাকু খান কর্তৃক তদানীন্তন ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের সূতিকাগার বাগদাদে নৃশংস ধ্বংসলীলার পাশাপাশি দারুল হিকমা লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত পবিত্র কোরআনের অমূল্য পা-ুলিপি ও তাফসিরসহ ইসলামের মৌলিক বিভিন্ন ইসলামি গ্রন্থ পুড়িয়ে ফেলার পরও কোরআনের নাম মুছে দেয়া সম্ভব হয়নি। অতীতের দেখা গিয়েছে, এই ধরনের আক্রমণ যতই কোরআনের ওপর এবং ইসলামের নবীর ওপর এসেছে, ততই ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে অমুসলিমদের আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বর্তমান পৃথিবীতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের হার অন্যান্য ধর্মের চেয়ে বেশি। ইসলামের বিকৃত চেহারা তুলে ধরা এবং মুসলমানদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার লক্ষ্যে পাশ্চাত্যে ব্যাপক প্রচারণা সত্ত্বেও দিন দিন এই ধর্মের প্রসার ঘটছে।
মনে রাখতে হবে ঘৃণা ও বর্ণবাদ এক ধরনের বিষ। ধর্মবিদ্বেষ তার চাইতেও মারাত্মক ধরনের বিষ। আর এই বিষদাঁতের ক্ষমতা এতটাই বেশি, যেকোনো সমাজ, রাষ্ট্র ও সভ্যতাকে ধ্বংস করে দিতে মোটেও কালক্ষেপণ করবে না। পরিশেষে বলব, শুধু ইউরোপ নয়, যেখানেই বর্ণবাদ ও ধর্মবিদ্বেষের বিষদাঁত রয়েছে, সেখানে তখনই তা উপড়ে ফেলতে হবে। জয় হোক মানবতার, জয় হোক মানুষের, জয় হোক আদর্শের, জয় হোক শান্তিকামীদের।
লেখক : কলামিস্ট ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক