রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর পূর্তি হতে চলেছে। এখন পর্যন্ত যুদ্ধের যা গতিপ্রকৃতি, তাতে দুই পক্ষের মূল মনোযোগ স্থলযুদ্ধেই কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে। আর আকাশযুদ্ধে রাশিয়া না ইউক্রেন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে, সেটি এখনই বলা যাচ্ছে না।
ইউক্রেনের প্রেক্ষাপট থেকে বিবেচনা করলে প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ তারা যত দীর্ঘ সময় চালিয়ে যেতে পারবে ততই মঙ্গল। জয়-পরাজয় নির্ধারক আক্রমণাত্মক যুদ্ধে যাওয়ার জন্য পশ্চিমাদের সামরিক সহায়তা পাওয়ার অপেক্ষা তাদের করতে হবে। এখন পর্যন্ত পশ্চিমা সামরিক সহায়তা ইউক্রেনের প্রতিরোধ গড়ে তোলার পেছনে মূল ভরসা। পশ্চিমা মিত্ররা সর্বশেষ ইউক্রেনকে অগ্রসর প্রযুক্তির মেইন ব্যাটল ট্যাংক দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। জার্মানি তাদের লেপার্ড-২ ও যুক্তরাষ্ট্র তাদের আব্রাহামস ট্যাংক দিতে চেয়েছে। কিন্তু ইদানীং বেশ জোরালোভাবে যে আলোচনা শুরু হয়েছে, তা হলো সোভিয়েত জামানার ইউক্রেনীয় বিমানবাহিনীকে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অত্যাধুনিক এফ-১৬ বিমান দিয়ে যুগোপযোগী বাহিনীতে রূপান্তরিত করবে কি না।
যদিও এ বিষয়ে ওয়াশিংটনের তরফ থেকে প্রবল আপত্তি রয়েছে। তা সত্ত্বেও পোল্যান্ডের মতো আরও কয়েকটি দেশ ইউক্রেনকে সানন্দে এফ-১৬ বিমান দিতে চায় বলে জানিয়েছে। ফ্রান্সও কিয়েভকে যুদ্ধবিমান দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে। যুদ্ধের দ্বিতীয় বছরে এসে ইউক্রেন যদি এসব অগ্রসর প্রযুক্তির যুদ্ধবিমান পায়, যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে সেগুলো কী ভূমিকা রাখবে?
এক বছর আগে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যুদ্ধ যখন শুরু হলো, তখন প্রায় সবাই অনুমান করেছিলেন রাশিয়ান বিমানবাহিনী (ভিকেএস) খুব দ্রুত আকাশযুদ্ধে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করবে। ইউক্রেনের স্থলবাহিনী ও দেশটির সামরিক ও বেসামরিক স্থাপনায় স্বাধীনভাবে হামলা করার মতো নিয়ন্ত্রণ আকাশে তারা প্রতিষ্ঠা করে ফেলবে।
রাশিয়ার বিমানবাহিনী বা ভিকেএস আগের মতো এখনও বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিমানবাহিনীর একটি। ইউক্রেনের বিমানবাহিনীর তুলনায় রাশিয়ার বিমানবাহিনীর বহরে কয়েক গুণ বেশি বিমান রয়েছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিককালে সিরিয়ায় বিমান হামলা ও দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সরকারকে সুরক্ষিত করার অভিজ্ঞতাও রয়েছে ভিকেএসের। আবার রাশিয়ার তরফে বেশ জোরেশোরে বলা হচ্ছে, তারা তাদের বিমানবাহিনী ব্যাপক আধুনিকায়ন করেছে। এর ফলে তারা ইউক্রেনের ওপর কারিগরি আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে।
পশ্চিমা সামরিক তত্ত্ব অনুযায়ী স্থল ও বিমানবাহিনী রক্ষার পূর্বশর্ত হলো আকাশযুদ্ধে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। শত্রুর যুদ্ধবিমান, কমান্ড ব্যবস্থা ও ভূমিতে অবস্থিত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গুঁড়িয়ে দিয়ে আকাশে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যায়। এই তত্ত্বের সফল প্রয়োগ ন্যাটো প্রথম করেছিল প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়। ৩৮ দিন ধরে টানা বিমান হামলা চালিয়ে ইরাকের বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে প্রথমেই গুঁড়িয়ে দিয়েছিল, এরপর চকিত ও দ্রুত স্থল অভিযান চালিয়ে তারা সাফল্য পেয়েছিল। ১৯৯০-এর দশকে সাবেক যুগোসøাভিয়াতে একই কৌশলের প্রয়োগ করে সাফল্য এসেছিল।
একটা বিষয় হলো, রাশিয়ার বিমানবাহিনীর সিরিয়া অভিযানের অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও জটিল ও বড় যুদ্ধ করার মতো বস্তুগত সম্পদের ঘাটতি রয়েছে। তত্ত্বগত সীমাবদ্ধতাও আছে। ফলে, পশ্চিমাদের বিমানশক্তিতে বলীয়ান কোনো দেশের সঙ্গে আকাশযুদ্ধে রাশিয়ার বিমানবাহিনী কয়েক সপ্তাহের বেশি টেকার সম্ভাবনা কম। সে ক্ষেত্রে বিমান হামলা করা ও স্থল স্থাপনায় বোমা ফেলার সক্ষমতা রাশিয়ার এমনিতেই কমে যাবে।
সাম্প্রতিককালে ভূমি থেকে আকাশে উৎক্ষেপণযোগ্য নানা ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের সমন্বয়ে ইউক্রেন তাদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থার সমূহ উন্নয়ন ঘটিয়েছে। পশ্চিমা মিত্রদের দেওয়া ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে এ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে ইউক্রেন। এ কারণে রাশিয়ার বিমান নিচু উচ্চতায় উড়তে বাধ্য হচ্ছে, না হলে ভূপতিত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে সেগুলোর। নিচু উচ্চতায় উড়তে বাধ্য বিমান অল্প খরচে তৈরি ও সহজে বহনযোগ্য আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দিয়েই প্রতিরোধ করা সম্ভব।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, রাশিয়ার বিমানবাহিনীও ইউক্রেনের মতো একই ধরনের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনা করে। এর ফলে আকাশযুদ্ধে জয়-পরাজয়ের ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে একটা অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। স্থলযুদ্ধে জয়-পরাজয়ের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা বাখমুত যুদ্ধ এর বড় দৃষ্টান্ত। এ বাস্তবতায় ইউক্রেনের হাতে অগ্রসর প্রযুক্তির সামরিক সরঞ্জাম এলে আক্রমণের ক্ষেত্রে আগ্রাসনকারী বাহিনীর চেয়ে তারা বেশি সুবিধা পাবে।
এ প্রেক্ষাপটে ইউক্রেনে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান পেলে কী হতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। লড়াকু বাজপাখি নামে পরিচিত এফ-১৬ যুদ্ধবিমান যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীতে যুক্ত হয় ১৯৭৮ সালে। এর পর থেকে নিয়মিত এর আধুনিকায়ন হয়েছে। ন্যাটোর সদস্যদেশ এবং অন্য অনেক মিত্রদেশে যুক্তরাষ্ট্র এফ-১৬ বিমান বিক্রি করেছে। অনেক দেশ এখন এফ-৩৫এস বিমান দিয়ে তাদের বহর পূর্ণ করায় আগের এফ-১৬ বিমানগুলো ইউক্রেনকে দিতে আগ্রহী।
লড়াইয়ের সক্ষমতার বিচারে রাশিয়ার মিগ-২৯ ও সুখোই এসইউ-২৭-এর চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এফ-১৬ অনেক ভালো। রাশিয়া ও ইউক্রেন দুই পক্ষের কাছেই একই ধরনের যুদ্ধবিমান রয়েছে। কিন্তু রাশিয়া তাদের যুদ্ধবিমান আধুনিকায়ন করায় যুদ্ধক্ষেত্রে কারিগরি দিক থেকে ইউক্রেনের চেয়ে এগিয়ে। কিন্তু ন্যাটো ইউক্রেনকে যদি আধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাসহ এফ-১৬ বিমান দেয়, তাহলে দেশটির বিমানবাহিনীর সক্ষমতা নাটকীয় পরিবর্তন হবে। তবে শুধু এফ-১৬ বিমান দিলে সেটি জয়-পরাজয় নির্ধারণে ভূমিকা রাখতে পারবে না।
* জেমস আর প্রিচেট যুক্তরাজ্যের হাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার স্টাডিজের প্রভাষক