মার্ভ! ইরেম! মার্ভ! ইরেম! উদ্ধারকর্মী মুস্তাফা ওজতুর্ক চিৎকার করেই যাচ্ছেন। আমাদের চারপাশের সবাইকে বলা হলো নিশ্চুপ থাকতে। উদ্ধারকর্মীদের এই দলটি দুই বোনকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। বেঁচে যাওয়া অন্য মানুষরা বলছে, দুই বোন ধ্বংসস্তূপের নিচে জীবিত অবস্থায় চাপা পড়ে আছে। খুবই সংবেদনশীল কিছু যন্ত্র দিয়ে উদ্ধারকর্মীরা শোনার চেষ্টা করছে কোনো সাড়া পাওয়া যায় কি-না। কোনো একটা কিছুর আশায় সবাই যেন স্থির হয়ে আছে। তারপরই যেন একটা কিছু ঘটল। ‘ইরেম, প্রিয় ইরেম, আমি তোমার খুব কাছে, তুমি আমাকে শুনতে পাচ্ছ’ চিৎকার করে জানতে চাইলেন মুস্তাফা।
আমরা যারা দেখছিলাম, তারা কিছু শুনতে পেলাম না। কিন্তু মনে হচ্ছে, ইরেম এখন সাড়া দিচ্ছে। মেয়েটির এক দল বন্ধু আমাদের সঙ্গে চুপচাপ বসে আছে। ‘তুমি খুবই দারুণ! এখন দয়া করে শান্ত থাকো, আমার কথার জবাব দাও। আচ্ছা, ও তাহলে মার্ভ। প্রিয় মার্ভ, আমার প্রশ্নের উত্তর দাও’, বলছিলেন মুস্তাফা।
মার্ভ এবং ইরেম এক সঙ্গে কৌতুক আর হাসাহাসি শুরু করল। মুস্তাফার মুখে যেন আমি বিরাট হাসি দেখলাম : ‘যদি ভেতরে ওরা জায়গা পেত, ওরা হয়তো নাচানাচি করত,’ বলছিলেন তিনি। উদ্ধারকর্মীদের হিসাব অনুযায়ী, দুই বোনের কাছে পৌঁছতে আরও দুই মিটার খুঁড়তে হবে। কিন্তু উদ্ধারকর্মী দলের অধিনায়ক হাসান বিনায় বললেন, কংক্রিটের মধ্যে সুড়ঙ্গ খোঁড়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। একটা ভুল পদক্ষেপে বিরাট বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। যখন তারা খোঁড়া শুরু করলো, তখন একটা পুরো কংক্রিট তুলে ধরে রাখার জন্য বুলডোজার আনা হলো। ‘মেয়েরা, আমরা শীঘ্রই তোমাদের কম্বল দেব’, মুস্তাফা তাদের জানালেন। ‘না না, আমাদের নিয়ে চিন্তা করো না। আমরা ক্লান্তও নই, আমাদের শীতও লাগছে না।’
মুস্তাফা বললেন, মার্ভ চিন্তা করছে উদ্ধারকর্মীদের অবস্থা নিয়ে। স্থানীয় সময় এখন রাত সাড়ে আটটা। বেশ ঠান্ডা। এই এলাকায় স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ শীত পড়েছে। উদ্ধার কর্মীরা আবার ধ্বংসস্তূপের ভেতর তাদের খালি হাত দিয়ে বেশ দ্রুত খনন শুরু করল। কয়েক ঘণ্টা পর আমরা অনুভব করলাম, আমাদের পায়ের নিচের মাটি কাঁপছে। বেশ শক্তিশালী আফটারশক। এখন উদ্ধার অভিযান বন্ধ রাখতে হবে। এখান থেকে আমাদের সরে যেতে হবে। এখানে এটা একটা নির্মম বাস্তবতা। ‘আমাদের উদ্ধারকারী দলের নিরাপত্তা আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার’, বলছিলেন হাসান।
তিরিশ মিনিট পর মুস্তাফা এবং আর তিনজন উদ্ধারকর্মী আবার খনন কাজে ফিরে গেলেন। ‘ভয় পেয়ো না। বিশ্বাস করো, আমরা তোমাদের ফেলে চলে যাব না। আমি তোমাদের বের করে আনব। এরপর তোমরা দুইজন আমাদের লাঞ্চ খাওয়াতে নিয়ে যাবে’, চিৎকার করে বলছিলেন মুস্তাফা। মেয়ে দুটি ভেবেছিল, তাদের ফেলে সবই চলে গেছে, তাদের বুঝি ওখানেই মরতে হবে। এখন মধ্যরাত, আবার খনন কাজ শুরু হয়েছে। উদ্ধারকারী দল কয়েক রাত ধরে ঘুমায় না। আমরা ধসে পড়া ভবনের কাছে একটা অগ্নিকুন্ডলি ঘিরে জড়ো হয়েছি। একটু পর পর হাঁক শোনা যাচ্ছে : ‘সেসিজলিক।’ এর মানে হচ্ছে ‘চুপ’। আলো নিভে গেল, চারিদিকে অন্ধকার। কংক্রিটের মধ্যে ওরা একটা ছোট্ট ছিদ্র করেছে, মেয়ে দুটি মুস্তাফার টর্চের আলো দেখতে পারছে কি-না, সেটা জানার জন্য।
‘মার্ভ! ইরেম! তোমরা কি আলো দেখতে পাচ্ছ? পাচ্ছ? বেশ ভালো। আমি এখন একটা ছোট্ট ক্যামেরা পাঠাচ্ছি। যখন তোমরা এটা দেখতে পাবে, আমাকে জানাবে। এরপর আমি তোমাদের জানাব কী করতে হবে।’
সবার জন্য এটি এক আনন্দের মুহূর্ত। নাইট ভিশন ক্যামেরাটি একটা ছোট্ট পর্দার সঙ্গে যুক্ত। হাসান ওর দলের সঙ্গে যোগ দিল দুই বোনের ছবি দেখার জন্য। তারা এখন ইরেম এবং মার্ভ, দুজনকেই দেখতে পাচ্ছে।
‘তোমরা কী সুন্দর। বেশি নড়াচড়া করো না। ইরেম ক্যামেরাটা একটু ওপরে তোল, যাতে আমরা মার্ভকে আরেকটু ভালোভাবে দেখতে পারি।’
পর্দায় দেখলাম, ইরেম হাসছে। সৌভাগ্যবশত কংক্রিটের যে জায়গায় তারা আটকে পড়েছে, সেখানে তাদের দু’জনের জন্য যথেষ্ট জায়গা আছে।
সবার মুখে এখন স্বস্তির ছায়া। মেয়ে দুটি ভালোই আছে। যদি ফুটোটা আরেকটু বড় করা যায়, ইরেম সেদিক দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারবে। কিন্তু এরপরই উদ্ধারকর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা গেল। মার্ভ জানাল, তার হঠাৎ ঠান্ডা লাগতে শুরু করেছে। তার পায়ের ওপর ভারী কিছু পড়েছে। ডাক্তাররাও চিন্তিত। ‘মার্ভের পায়ে কি গ্যাংগ্রিন হয়েছে? নাকি ও হাইপোথার্মিয়ায় আক্রান্ত?
‘আমার মায়ের হাত থেকে গন্ধ বেরুচ্ছে, আমরা ঠিকমতো নিঃশ্বাস নিতে পারছি না’, ইরেম উদ্ধারকর্মীদের জানাল। দুই বোন আসলে তাদের মৃত মায়ের লাশের পাশেই পড়ে আছে গত ক’দিন ধরে। ব্যাপারটা খুবই ভয়ংকর। আমরা চিন্তা করছিলাম, জীবনে এমন মুহূর্তও আসতে পারে, যখন কেউ তার মা পাশে থাক এটা চাইবে না। মার্ভের বন্ধুরা কাছেই চুপচাপ অপেক্ষা করছিল। হাসান তাদের একজনের কাছে দুই বোনের ছবি দেখতে চাইল। ওরা অনুমান করার চেষ্টা করছিল, ওদের বের করে আনার জন্য গর্তটা কত বড় করতে হবে। ছবিতে দুই বোন পার্টি ড্রেস পরে হাসছে। ‘একদম ঠিক আছে। আমরা ওদের বের করে আনতে পারি।’
থার্মাল ব্ল্যাংকেট আর স্ট্রেচার নিয়ে মেডিকেল টিম প্রস্তুত। সবাই উত্তেজিত। এখন সকাল সাড়ে ৬টা। ইরেম প্রথম বাইরে এলো। ও একই সঙ্গে হাসছে এবং কাঁদছে। আল্লাহ তোমাদের দয়া করুক। এখন মার্ভকে বের করে আনো, ও উদ্ধারকর্মীদের অনুনয় করছিল।
হাসান তাকে আশ্বাস দিল, মার্ভকেও বের করে আনা হবে। কিন্তু মার্ভকে বের করতে আরও আধা ঘণ্টা সময় লাগলো। কংক্রিটের নিচ থেকে তার পা মুক্ত করার দরকার ছিল। অপারেশন সফল হলো।
মার্ভ বেরিয়ে আসার পর সবাই উল্লাস করছিল, হাততালি দিচ্ছিল। আমি শুনলাম, মার্ভ বেদনায় চিৎকার করছে, কিন্তু আবার জানতে চাইছে, ‘আমি কি বেঁচে আছি?’ ‘তুমি বেঁচে আছো’, বলল মুস্তাফা।
যে বন্ধুরা সারারাত এখানে জেগে বসেছিল, তারা চিৎকার করে কাঁদছিল। ‘মার্ভ, ইরেম, আমরা তোমাদের পাশে আছি। ভয় পেয়ো না।’
দুই বোনকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হলো, নিয়ে যাওয়া হলো একটি ফিল্ড হাসপাতালে। এই আনন্দময় মুহূর্তের পর এলো একটি আতংকজনক মুহূর্ত। উদ্ধারকর্মীরা সবাইকে চুপ হতে বলল। এবার তারা শেষবারের মতো ডাক দিয়ে দেখবে কেউ বেঁচে আছে কি-না। ‘কেউ যদি আমাকে শুনতে পাও, সাড়া দাও। যদি সাড়া দিতে না পার, মাটি স্পর্শ করার চেষ্টা করো।’
হাসান বারবার চিৎকার করে একই কথা বলে যেতে থাকেন। বিভিন্ন দিক থেকে। তারপর বেশ বিষাদের সঙ্গে তিনি কংক্রিটের ওপর লাল রং স্প্রে করে একটা চিহ্ণ দেন। এর মানে হচ্ছে উদ্ধারকর্মীরা এই ধসে পড়া ভবনে আর জীবিত কারও সন্ধান করবে না।
‘একজন মানুষকে জীবিত উদ্ধার করতে পারার অনুভূতিটা অসম্ভব সুন্দর। কিন্তু আমরা চাই, কেউই যেন মারা না যায়’, হাসানের মুখে আমি বিষাদের ছায়া দেখি।
তুমি কি মার্ভ আর ইরেমের সঙ্গে লাঞ্চ খাবে? আমি জিজ্ঞেস করি। হাসান হাসে। ‘নিশ্চয় একদিন যাবে, সেটাই আশা করি। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে ওরা বেঁচে আছে, ভালো আছে।’
* সূত্র : বিবিসি ফারসি