যুগে যুগে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ

অধ্যাপক শাব্বির আহমদ

প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ইউরোপে মুসলিম বিদ্বেষিতা নতুন কিছু নয়। মধ্যযুগ থেকে এর সূত্রপাত। মধ্যযুগে খ্রিষ্টানদের কাছে জেরুজালেম শহরটি ছিল তাদের ধর্মীয় প্রেরণার প্রধান কেন্দ্র। তাদের বিশ্বাস, এখানেই যিশু খ্রিষ্টের মৃত্যু হয়েছিল এবং সমাহিত করা হয়েছিল। অন্যদিকে মুসলমানদের কাছে জেরুজালেম তৃতীয় পবিত্র নগরী, যেখান থেকে ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) আরশে আজিমে যাত্রা করেছিলেন বলে ইসলাম ধর্মের বিবরণে উল্লেখ করা আছে। ৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দে হজরত ওমর (রা.)-এর খেলাফত আমলে আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ (রা.)-এর নেতৃত্বে মুসলমানরা জেরুজালেম জয় করেন। এই শহরের ‘ডোম অব দ্য রক’ এবং ‘আল-আকসা মসজিদ’ মুসলমানদের কাছে অন্যতম প্রধান ধর্মীয় স্থান।

১০৯৫ সালে ফ্রান্সের একটি ছোট্ট শহর ক্লেরমন্টে পোপ দ্বিতীয় আরবানের আহ্বানে জেরুজালেম উদ্ধারের নামে প্রথম ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের ডাক দেন। ফ্রান্স, জার্মানি এবং ইতালি থেকে প্রায় ৭৫ হাজার খ্রিষ্টান যোদ্ধা প্রথম ক্রুসেডে অংশ নিয়েছিল। ১০৯৯ সালের ১৫ জুলাই দীর্ঘ অবরোধের পর ক্রুসেডাররা জেরুজালেম দখল করে। এর মধ্য দিয়ে কুদসে মুসলমানদের ৪৬২ বছরের শাসনের বিলুপ্তি ঘটে। তার পর দীর্ঘ ৮২ বছর এটি খ্রিষ্টানদের দখলে থাকে।

তেরশ শতকে ইরাকি ইতিহাসবিদ ইবন আল-আসিরের মতে, সেই সময় জেরুজালেমে ৭০ হাজার মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছিল। জেরুজালেমে অবস্থিত ইহুদিদের ধর্মীয় স্থাপনা ‘সিনাগগ’-এ যেসব ইহুদি ধর্মাবলম্বী লুকিয়ে ছিল তাদেরও হত্যা করেছিল ক্রুসেডাররা। কারণ, তখনকার ইহুদিরা ছিল মুসলমানদের পক্ষে।

জেরুজালেম হাতছাড়া হয়ে যাওয়া মুসলমানদের জন্য ছিল বড় একটি আঘাত। ফলে মুসলমানরাও সংগঠিত হতে শুরু করে। এগারোশ চুয়াল্লিশ খ্রিষ্টাব্দে মসুলের (বর্তমান ইরাকের একটি প্রদেশ) গভর্নর সেলজুক নেতা নুুরুদ্দিন জঙ্গির নেতৃত্বে জেরুজালেম পুনরুদ্ধারের জন্য মুসলমানরা ‘জিহাদ’-এর ডাক দেয়। নূরউদ্দিন আবুল কাসিম মাহমুদ ইবনে ইমাদউদ্দিন জঙ্গি ছিলেন তুর্কি বংশো™ূ¢ত জঙ্গি রাজবংশীয় শাসক। ১১৪৬ থেকে ১১৭৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি সেলজুক সাম্রাজ্যের সিরিয়া প্রদেশ শাসন করেছেন। তাকে দ্বিতীয় ক্রুসেডের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে গণ্য করা হয়। তাঁর বাবা ইমাদ উদ্দিন জঙ্গি সিরিয়ায় ক্রুসেডারদের প্রবল প্রতিপক্ষ ছিলেন এবং আততায়ী এক ক্রুসেডারের হাতে তিনি নিহত হন।

বাবার হত্যাকাণ্ডের পর নূর উদ্দিন ও বড় ভাই সাইফ উদ্দিন নিজেদের মধ্যে সাম্রাজ্য ভাগ করে নেন। মসুলের দায়িত্ব পান বড় ভাই সাইফুদ্দিন জঙ্গি আর আলেপ্পোর (বর্তমানে সিরিয়ার গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ) দায়িত্ব পান নুরুদ্দিন জঙ্গি নিজে। সাইফুদ্দিন ইন্তেকাল করলে সমগ্র সাম্রাজ্যের ভার তার কাঁধে অর্পিত হয়। নুরুদ্দিন জঙ্গি নিজেকে তাঁর বাবার যোগ্য উত্তরসুরি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। তিনি ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে পিতা অপেক্ষা ভয়ংকর হিসেবে আভির্ভূত হয়েছিলেন। তার নেতৃত্বে বায়তুল মোকাদ্দাস পুনর্দখলের তৎপরতার খবরে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ার পর ফ্রান্সের রাজা সপ্তম লুইস এবং জার্মানির রাজা তৃতীয় কনরাডের নেতৃত্বে দুটি খ্রিষ্টান বাহিনী দ্বিতীয় ক্রুসেডের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।

১১৪৭ সালে রাজা লুইস এবং কনরাডের বাহিনী জেরুজালেমে সমবেত হলে নুরুদ্দিন জঙ্গি সহায়তা চান দামেস্কের শাসকের। ‘ব্যাটল অব ইনায়ে’ যৌথ মুসলিম বাহিনী ক্রুসেডার বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে দেয়। জেরুজালেম চত্বরসহ শহরের অলি-গলি ক্রুসেডারদের রক্ত রঞ্জিত হয়। ফোরাত এবং নীল নদের মধ্যবর্তী সব মুসলমানকে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ করে রাখার নিরন্তর প্রয়াস ছিল নূর উদ্দিনের। মিসর জয়ের পর মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে এক করা ও বায়তুল মুকাদ্দাস পুনরায় মুসলমানদের হস্তগত করাই ছিল নূর উদ্দিনের স্বপ্ন, যা অর্জনের জন্য সারা জীবন তিনি জিহাদ করে গেছেন।

পরবর্তী সময়ে তাঁর এই স্বপ্ন প্রিয় সাগরেদ সুলতান সালাহ উদ্দিন আইয়ুবী সমাপন করেছিলেন। ক্রুসেডাররা নুরুদ্দিন জঙ্গিকে সম্মুখ সমরে হটাতে না পেরে গোপনে খাদ্যে বিষাক্ত স্লো-পয়োজন প্রয়োগ করে, যাতে তিনি অসুস্থ হয়ে শাহাদাতবরণ করেন। তিনিই ছিলেন জেরুজালেম বিজেতা ও ক্রুসেডরদের দাম্ভিক মস্তিস্ক চূর্ণকারী সুলতান সালাহ উদ্দিন আইয়ুবীর অভিভাবক, তিনিই আইয়ুবীকে জিহাদের ময়দানে এনেছেন। এছাড়া তিনি নবীজির লাশ মুবারক চুরির ইয়াহুদি চক্রান্তকে দৃঢ়ভাবে নস্যাত করে সেই ইহুদিদের কঠিন শাস্তি দিয়েছিলেন। অবশেষে রাসুল (সা.) এর রওজা মুবারককে অনেক নিচ পর্যন্ত সিসা দ্বারা ঢালাই করে দেন। এছাড়া ইসলামের কল্যাণ ও জনহিতকর অসংখ্য কাজের অমর স্মৃতি রয়েছে তার।

নুরুদ্দিন জঙ্গির নেতৃত্বাধীন মুসলিম যৌথ বাহিনীর কাছে ক্রুসেডারদের করুণ পরিণতি খ্রিষ্টান জগতে মারাত্মক ক্ষোভের সৃষ্টি করে। ১১৮৭ সালে জেরুজালেম পুনরুদ্ধারের জন্য তখনকার পোপ অষ্টম গ্রেগরি তৃতীয় ক্রুসেডের ঘোষণা দেন। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ফ্রান্সের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ এবং ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম রিচার্ড (রিচার্ড দ্যা লায়নহার্ট নামে পরিচিত) নেতৃত্বে ক্রুসেডাররা জেরুজালেমের উদ্দেশ্যে রওনা হন। তৃতীয় ক্রুসেডে মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্ব দেন গাজী সালাহউদ্দিন আইয়ুবী।

ক্রুসেডের ইতিহাসে সালাউদ্দিন আইয়ুবী এক কিংবদন্তি। বীর সালাউদ্দিন আইয়ুবীর কথা শুনেননি এমন মানুষ কমই আছেন। শুধু মুসলিম ইতিহাস নয়, শত্রুর কাছেও তিনি ছিলেন সম্মানিত এক বীর। সালাহউদ্দিন আইয়ুবী মেসোপটেমিয়ার তিকরিতে (বর্তমান ইরাকের প্রদেশ) জন্মগ্রহণ করেন। মুসলিম আরব, তুর্কি ও কুর্দি সংস্কৃতিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। ইতিহাস যেখানেই সুলতান সালাহউদ্দিনের নাম উচ্চারণ করেছে, সঙ্গে আবশ্যিকভাবে আলোচিত হয়েছে প্রতিপক্ষের সেনাপতি রিচার্ড লায়নহার্টের নাম। তৃতীয় ক্রুসেড যুদ্ধের ছত্রে ছত্রে এ দুটি নাম লেপ্টে আছে বীর বিক্রমে। ক্রুসেডের ময়দানগুলোতে এই দুই বীর পুরুষের মধ্যকার পৌরুষদীপ্ত ভূমিকার কথা আরব-অনারবের সব সচেতন ঐতিহাসিক গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন।

সময়টা ১১৮৯ খ্রিস্টাব্দ; হিজরি ৫৮৫ সাল। হিত্তিনের যুদ্ধে সালাহুদ্দিন আইয়ুবী ক্রুসেডারদের সম্মিলিত শক্তিকে পরাজিত করে কুদসকে শত্রুমুক্ত করেন। ইংরেজদের প্রাসাদে তখন প্রতিশোধের আগুন। রিচার্ড লায়নহার্টের বৈঠকে শরিক হয়েছে ফরাসি সম্রাট ফিলিপ অগাস্ট, এসেছে জার্মানপতি ফ্রেডরিক বার্বারোস। সিদ্ধান্তে উঠে এসেছে যুদ্ধের বারুদ। জেরুজালেম ফেরাতে প্রয়োজনে জল-স্থলে একযোগে লড়বে তারা। ইতিহাস যাকে চিনবে তৃতীয় ক্রুসেড হিসেবে। ১১৯১ খ্রিষ্টাব্দ। সুলতান সালাহউদ্দিন বুঝতে পারলেন স্থল ও অথৈ জলরাশি পাড়ি দিয়ে তার রাজ্য অভ্যন্তরে লড়তে আসা এবারের প্রতিপক্ষ অন্য সাধারণ শত্রুর মতো নয়। অতীতের কারনামা ঘাঁটলে লায়নহার্টের বীরত্বের উপাধী তাকে আসলেই মানায় দারুণভাবে। সালাহউদ্দিন মনে হলো, এবারের প্রতিপক্ষের বাহু জোরালো। আত্মশক্তি প্রবল এবং প্রতিরোধে সে দুর্বার। অতীতের হিসাব না কষে, অন্ত-পরিণামের ভয় না করে লড়াই সে করতে জানে। সুলতান চাইলেন এই দুর্দমনীয় সম্রাটের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় সমাধান টানতে। কিন্তু রিচার্ড লায়নহার্টের পণ ছিল অনতিবিলম্বে কুদস ছিনিয়ে আনা পর্যন্ত আমরা পিছপা হবো না কিছুতেই। এরই মধ্যেই বেশ কিছু খণ্ড যুদ্ধ হয়ে গেছে।

১১৯১ সালের খ্রিষ্টীয় উৎসবের রাত। তখন বায়তুল মোকাদ্দিস থেকে বিশ কিলোমিটার দূরত্বে লায়নহার্ট বাহিনীর অবস্থান। সুলতানের কোনো সেনা এখনও তাদের চোখে পড়েনি। শঙ্কিত মনে তার বাহিনী কদম ফেলছে হিসাব করে করে। লায়নহার্টের মনে প্রথমবারের মতো ভয় জমেছে। তার কেবলই মনে হচ্ছে, শত্রুপক্ষ এখানে কোনো ফাঁদ এঁকেছে। অনতিবিলম্বে সে অন্য সেনাপতিদের জমা করে বলল, চলো এবার আমরা পথ পাল্টে বরং সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় ফিরে যাই। তারা ফিরছিল।

পথে সুলতানের দূত তাদের সামনে পড়ল। দূত বলল, আমরা যুদ্ধ স্থগিতকরণ এবং সমঝোতার জন্য প্রস্তুত। তোমরা প্রথমবার বায়তুল মোকাদ্দিস দখল করেছ ঠিক; কিন্তু তখন আমাদের রাজা-সম্রাট, আমির-ওমারারা অলস, উদাস এবং মতবিরোধে মত্ত ছিল। আজ আমরা হাতে হাত রেখে কাতারবদ্ধ; দ্বিতীয়বার কুদস দখলের চিন্তা করাও তোমাদের জন্য পাপ হবে।

সার্বিক পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা করে রিচার্ড সম্মতি জানাল সুলতানের প্রস্তাবে। সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় দিন। রিচার্ড আর সুলতানের মধ্যে সন্ধিপত্র স্বাক্ষরিত হলো। সিদ্ধান্ত হলো, প্রাচ্য-প্রতীচ্যের যে কেউ বায়তুল মোকাদ্দিসের তীর্থযাত্রী হিসেবে এলে তাদের জন্য প্রবেশদ্বার উন্মুক্ত থাকবে। রিচার্ড প্রতিজ্ঞা করল, সে সন্ধিচুক্তির সম্মান রাখবে। এটাকে ভঙ্গ করবে না। তার বাহিনী নিয়ে ফিলিস্তিন ত্যাগ করবে। তার অধীনে থাকা কতিপয় এলাকা ফিরিয়ে দেবে। এই সন্ধিপত্রে চূড়ান্ত সিল মারার মধ্য দিয়ে তৃতীয় ক্রুসেড যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। যে যুদ্ধ শুরু করেছিল তিন ক্ষমতাধর সম্রাট; কিন্তু শেষে নাকানি চুবানি জুটলো লায়নহার্টের কপালে।

শান্তিচুক্তির মাধ্যমে খ্রিষ্টশক্তি বায়তুল মোকাদ্দাসের ওপর অধিকার ত্যাগ করলেও ইউরোপের ক্রুসেডাররা পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে ফিরে প্রথম প্রতিশোধটি নিয়েছিল ইউরোপের স্পেনের নিরীহ মুসলমানদের ওপর। ৭১১ খ্রিষ্টাব্দে সেনাপতি তারিক ইবনে জিয়াদের নেতৃত্বে স্পেন জয়ের পর সাতশো বছরের বেশি সময় মুসলমান এই ভূখণ্ড শাসন করে। খ্রিষ্টীয় নবম শতকে আন্দালুস হয়ে ওঠে ইউরোপের সবচেয়ে অগ্রসর অঞ্চল। এই ভূখণ্ডের জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ লোকই ইসলাম ছায়াতলে আশ্রয় নেয়। এর রাজধানী কর্ডোভা ছিল মুসলিম বিশ্ব ও ইউরোপের জ্ঞানপিপাসুদের তীর্থস্থান। পরাজিত ক্রুসেডাররা ইউরোপকে মুসলিমশূন্য করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে স্পেনকে টার্গেট করে। সম্মিলিত খ্রিষ্টশক্তির আক্রমণে ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে স্পেন সম্পূর্ণরূপে মুসলিমশূন্য হয়ে পড়ে। রাজা তৃতীয় ফিলিপের নেতৃত্বে খ্রিষ্টান বাহিনীর হাতে প্রায় ৩০ লাখ মুসলিম আফ্রিকাণ্ডএশিয়ায় নির্বাসিত অথবা নিহত হন।

এখানে অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, স্পেনের মুসলিমদের পতনের সময় অটোমানরা কোনো সাহায্য করেনি কেন? তার প্রতি উত্তরে আমরা ইতিহাসে দুটি কারণ খুঁজে পাই। প্রথমত, স্পেন অটোমানদের রাজধানী থেকে ছিল বহু দূরে। তারপরও আক্রমণ করতে গেলে দরকার ছিল মরক্কো দখলে থাকা। তারিক বিন জিয়াদ মরক্কোর ভঙ্গুর ভিসিগোথিক স্পেন আক্রমণ করেছিলেন। কিন্তু মরোক্কোর কুরাইশ বংশীয় সাদী সুলতানরা অটোমানদের কর্তৃত্ব তো মেনে নেয়নি, উল্টো পর্তুগিজদের সঙ্গে নিয়ে কোনো কোনো সময় অটোমানদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছে। সাদীরা সুন্নি এবং সেই সঙ্গে শক্তিশালী হওয়ায় অটোমানরা তাদের সঙ্গে খুব একটা রক্তপাতে যায়নি। যার ফলে স্পেনের মুসলিমদের পতনের সময় অটোমানরা কোনো সাহায্য করেনি। দ্বিতীয়ত, গ্রানাডার যখন পতন হয়, মানে ১৪৯২ সালে, তখন অটোমান সাম্রাজ্য কেবল আনাতোলিয়া আর রুমেলিয়ায় সীমাবদ্ধ ছিল। আন্দালুসীয়দের সাহায্য করার মূল দায়িত্ব কাঁধে বর্তায় কাছাকাছি থাকা তৎকালীন মরক্কোর সাদী সুলতানদের আর মিশরের মামলুকদের। কিন্তু তারা তেমন কিছু করেনি।

দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের রোমানিয়া, আর্মেনিয়া, যুগোসøাভিয়া, গ্রিসসহ বলকান অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলো তুরস্কের শক্তিশালী ওসমানীয় খেলাফতের অধীনে থাকায় ইউরোপীয় ক্রুসেডাররা এসব অঞ্চল থেকে মুসলমানদের নামণ্ডনিশানা মুছে ফেলার দুঃসাহস দেখায়নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ওসমানীয়দের শোচনীয় পরাজয়ের পর তাদের মোক্ষম সুযোগটি হাতে এসে যায় এবং যথাযথ ব্যবহার করে। খ্রিষ্টান অধ্যুষিত রাষ্ট্রগুলো বাদে মুসলিম অধ্যুষিত সব ক’টি রাষ্ট্র লেলিনের নেতৃত্বাধীন বলশেভিকরা সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত করে নেয়া হয়। ৭০ বছর ধরে কমিউনিস্ট জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে মুসলিম ঐতিহ্যের সমরখন্দ, বোখারা, তাসখন্দ, আলমাআতাসহ মধ্য এশিয়াসহ ইউরোপের ককেশাস অঞ্চলের মুসলিম জনপদ হারিয়ে বসে নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাস আর ইতিহাস-ঐতিহ্য।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পূর্ব ইউরোপে খ্রিষ্টান অধ্যুষিত অনেক রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটলেও মুসলিম অধ্যুষিত বসনিয়ার স্বাধীনতা ক্রুসেডারদের উত্তরসূরিরা সেইদিন মেনে নিতে পারেনি। সেই সময়ে ইউরোপের অনেক বুদ্ধিজীবীকে প্রকাশ্যে বলতে দেখা গেছে, ইউরোপের বুকে কোনো মুসলিম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটুক সেটি তারা চায় না। ১৯৯৪ সালে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপে যুক্তরাষ্ট্র এক প্রকার বাধ্য হয়েই ‘ডেটন চুক্তি’র মাধ্যমে তিন ব্যক্তির প্রেসিডেন্সি, আন্তর্জাতিক দূত এবং একটি কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা সার্ব প্রজাতন্ত্র এবং বসনিয়া ও ক্রোয়েটকে একত্রিত করে ‘বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা’ রাষ্ট্রটি গঠন করে দেয়। বিশ্লেষকদের মতে, ডেটন শান্তি চুক্তির মাধ্যমে বসনিয়ায় মুসলমানদের রক্তগঙ্গা বন্ধ হয়েছে ঠিকই, তবে দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের হাত-পা একেবারে বেঁধে ফেলা হয়েছে। এই হলো যুগে যুগে ইউরোপীয় ক্রুসেডারদের মুসলিম বিদ্বেষিতার নমুনা।

লেখক : কলামিস্ট ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক