ঢাকা ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ক্রিমিয়া

বিস্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া সমৃদ্ধ এক মুসলিম জনপদ

অধ্যাপক শাব্বির আহমদ
বিস্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া সমৃদ্ধ এক মুসলিম জনপদ

কৃষ্ণসাগরের উত্তর উপকূল ঘেঁষে অবস্থিত অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি ক্রিমিয়া উপদ্বীপ প্রাচীন এক মুসলিম জনপদ, যা ছিল একসময় অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ। ক্রিমিয়া বিশ্ব পরিমণ্ডলে পরিচিত ও আলোচিত ছোট্ট একটি প্রজাতন্ত্র। ৬০ বছর আগে ক্রিমিয়া ছিল রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত একটি অঞ্চল। ১৯৫৪ সালে সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ ক্রিমিয়া উপদ্বীপটি উপহার হিসেবে লিখে দিয়েছিলেন ইউক্রেনকে। ২০১৪ সালে এটি ইউক্রেনের থেকে দখল করে নিয়েছে রাশিয়া। এর রাজধানী সিমফারোপোল। ক্রিমিয়ার চারপাশে ঘিরে রয়েছে কৃষ্ণসাগর ও আজোভ সাগরের অথৈ জলরাশির প্রবল তরঙ্গ-উচ্ছ্বাস। সে হিসেবে ক্রিমিয়াকে একটি উপদ্বীপও বলা যেতে পারে।

দক্ষিণে প্রায় আট কিলোমিটারজুড়ে ইউক্রেনের সীমানা-রেখা। পশ্চিমে রাশিয়ার কুবান অঞ্চল ও ক্রিমিয়ার মাঝে ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রণালির অবস্থান। ক্রিমিয়ার বর্তমান আয়তন প্রায় ২৭ হাজার বর্গকিলোমিটার। ইউক্রেনের অংশ থাকার সময় ক্রিমিয়া ১৯৯১ সালে স্বায়ত্তশাসিত রিপাবলিকের মর্যাদা অর্জন করেছিল। বর্তমানে অঞ্চলটির জনসংখ্যা ৩০ লাখের কাছাকছি। যার সিংহভাগই রুশ ভাষাভাষী সম্প্রদায়। ২০ শতাংশের মতো রয়েছে তাতার মুসলিম নাগরিক। অথচ একসময়ে ক্রিমিয়া ছিল ইতিহাসে বীরের জাতি হিসেবে খ্যাত তাতার মুসলিম জনপদ। এই তাতার মুসলিমরা এক সময় সোভিয়েত সরকারের রোষানলে পড়ে ক্রিমিয়া ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। গত বছরের ৮ অক্টোবর রাশিয়ার তৈরি ক্রিমিয়ার কার্চ সেতুতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনার পর ক্রিমিয়া নতুন করে বিশ্ব মিডিয়ায় বিশেষ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে ক্রিমিয়ার সংযোগকারী এই সেতু দিয়ে রুশ অধিকৃত দক্ষিণ ইউক্রেনে সেনা ও রসদ সরবরাহ করা হতো। সেতুটি ছিল ইউরোপের দীর্ঘতম সেতু এবং রুশ সামরিক বাহিনীর শক্তির একটি প্রতীক। ২০১৮ সালে পুতিন নিজে এই সেতুর উদ্বোধন করেছিলেন।

দ্বাদশ শতাব্দীতে আরব ও মুসলিম বণিক-পর্যটকদের মাধ্যমে ক্রিমিয় অঞ্চলে ইসলামের আগমন ঘটে। ১৩১৩-১৩৪১ সালে উজবেক শাসনামলে ক্রিমিয়া ইসলামি শাসনাভুক্ত হয়ে পড়ে। ১৪৪১ খ্রিষ্টাব্দে ক্রিমিয়ারাজ্য ওসমানি খেলাফতের মিত্ররাষ্ট্রে পরিণত হয়। রাশিয়া, পোল্যান্ড ও মলদোভার বিরুদ্ধে প্রতিটি যুদ্ধে তুর্কিরা তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা করে। ১৭৭৪ খ্র্রিষ্টাব্দে ক্রিমিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের দখলাক্রান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের এ মৈত্রী সম্পর্ক টিকে ছিল প্রায় সাড়ে তিনশ’ বছর। ককেশাস, বলকান ও বর্তমান তুরস্কের বিভিন্ন অঞ্চলে রুশ সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক যুদ্ধে ওসমানি খেলাফতের প্রতিরক্ষাসীমান্ত ছিল ক্রিমিয়া। মুসলিম শাসনামলে ক্রিমিয়া হয়ে ওঠে বিপুল ঐশ্বর্যমণ্ডিত ও সভ্যতাণ্ডসংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল। ক্রিমিয়ার তাতারি মুসলমানদেন বীরত্ব ও সাহসিকতার খ্যাতি ছিল জগৎজুড়ে। ইসলামের জন্য তাদের আত্মনিবেদন লেখা আছে ইতিহাসের স্বর্ণাক্ষরে। ক্রিমিয়ার তাতারি মুসলিমরা রাশিয়ার বিস্তৃৃত ভূমিতে ইসলামের বাণী পৌঁছে দেয়। ভলগার তীরবর্তী বিশাল ভূমি ইসলামি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে। ভূমির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রাশিয়ার জারের সঙ্গে সংঘাত লেগে থাকত ক্রিমীয় খানদের। ক্রিমিয়ার মুসলিম শাসকদের শক্তির উৎস ছিল তুরস্কের উসমানীয় খিলাফত। উসমানীয় শাসকরা দুর্বল হয়ে গেলে খানরাও রুশ বাহিনীর আক্রমণে বিপর্যস্ত হন। ক্রিমিয়ার মুসলিমরা ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ও নির্বাসনের শিকার হয়। মসজিদণ্ডমাদ্রাসাসহ মুসলিম স্থাপত্য ধ্বংস করে দেওয়া হয়।

১৬৮০ সালে রুশ বাহিনী ক্রিমিয়া দখল অভিযান পরিচালনা করলে দুর্বল হয়ে পড়া ওসমানীয় খলিফারা ক্রিমিয়া রক্ষায় এগিয়ে আসেনি। কারণ ইউরোপের বিভিন্ন রণক্ষেত্রে তুর্কি বাহিনী তখন ক্রমেই পিছু হটছিল। রুশ সম্রাজ্ঞী দ্বিতীয় ক্যাথরিন ১৭৮৩ সালের ১৮ এপ্রিল ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অঙ্গরাজ্য হিসেবে ঘোষণা দেন। ক্রিমিয়ার মুসলিমরা প্রতিরোধের চেষ্টা করলেও রাশিয়ার বিপুল সামরিক শক্তির সামনে সামান্য সময় টিকে থাকতে পেরেছিল। এ সময় লক্ষাধিক মুসলিম নিহত হয় এবং লাখ লাখ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করা হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে মুসলিম বাড়িঘর, সহায়-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছিল যে নিহত মুসলিমদের দাফন করার মতো লোকও পাওয়া যাচ্ছিল না।

১৯১৭ সালে রাশিয়ায় কমিউনিস্ট বিপ্লব হলে ক্রিমিয়ার মুসলিমরা জারের বিরুদ্ধে বিপ্লবীদের সমর্থন দেয়। বিপ্লবীরা ক্রিমিয়ার মুসলিমদের স্বাধীনতার অঙ্গীকার করে। সে অনুযায়ী বিপ্লব সম্পন্ন ক্রিমিয়ার মুসলিমরা স্বাধীনতা ঘোষণা করে। কিন্তু বিপ্লবীদের চেহারা জারদের চেয়ে কোনোভাবেই ভিন্ন ছিল না। তারা ১৯২১ সালের ১৮ অক্টোবর ক্রিমিয়াকে গণপ্রজাতন্ত্রী সোভিয়েত ইউনিয়নের অঙ্গরাজ্য হিসেবে ঘোষণা করে। স্বাভাবিকভাবেই মুসলিমরা এই অন্যায় সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায় এবং রুশ বিপ্লবীদের নির্যাতনের শিকার হয়। সোভিয়েত নেতারা তাতারি মুসলিমদের কৃষিজমি বাজেয়াপ্ত করে। ফলে ক্রিমিয়ায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ (১৯২১-২৩) দেখা দেয়। এই দুর্ভিক্ষে ১ লাখ ৫০ হাজার মুসলিম অনাহারে মারা যায়।

১৯২৩ সালে জোসেফ স্টালিন ক্রিমিয়ায় ইহুদি আবাসনের উদ্যোগ নিলে মুসলিম নেতারা এর প্রতিবাদ করেন। এতে স্টালিন ক্ষুব্ধ হয়ে বহু মুসলিম নেতাকে বন্দি করেন ও নির্বাসনে পাঠান। তার লক্ষ্য ছিল ইহুদি জাতির সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা, তাদের সম্পদ ও প্রজ্ঞার দ্বারা উপকৃত হওয়া। স্টালিন রাশিয়ার একেবারে পূর্বাঞ্চলীয় শহর এফ্রিসকিয়ায় ইহুদিদের স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিলেন, যা এখনও টিকে আছে। কিন্তু ব্রিটেন যখন কাঙ্ক্ষিত পবিত্র ভূমি জেরুজালেমে ইহুদিদের আবাসনের ব্যবস্থা করে, তখন তারা রাশিয়াকে ছেড়ে ব্রিটেন-আমেরিকার প্রতি ঝুঁকে যায়। ফলে জোসেফ স্টালিনের স্বপ্নভঙ্গ হয়। ক্ষুব্ধ হয়ে কিছু ইহুদি নেতাকে সাইবেরিয়ায় নির্বাসনেও পাঠান।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান বাহিনীকে সহায়তা করার অভিযোগে সোভিয়েত লাল ফৌজ ক্রিমিয়ার তাতার মুসলমানদের বিরুদ্ধে আবারও দমন অভিযান শুরু করে। স্টালিন নির্বাসনের নির্দেশে অনেককে উজবেকিস্তান ও সাইবেরিয়ায় নির্বাসন দেওয়া হয়। সাইবেরিয়ায় দেশান্তরের জন্য মুসলিমদের মালবাহী রেলের বগিতে গাদাগাদি করে ঠাসা হয়েছিল। ফলে রেল সাইবেরিয়ায় পৌঁছানোর পর দেখা যায়, বেশির ভাগ বগিতে জীবিতদের চেয়ে মৃতের সংখ্যাই বেশি। সুদীর্ঘ এই বিরামহীন যাত্রায় ক্ষুধা, তৃষ্ণা আর অসহ্য গরমে তারা মারা যায়। ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত এই নির্মূল প্রক্রিয়া অব্যাহত ছিল। ১৯৫৪ সালে ইউক্রেনের হাতে তুলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে হারিয়ে যায় মুসলিম বিশ্বের মানচিত্র থেকে ক্রিমিয়া।

লেখক : শিক্ষক, কলামিস্ট ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত