চ্যালেঞ্জের মুখে মানবতার শত্রু ইসরাইল

অধ্যাপক শাব্বির আহমদ

প্রকাশ : ০৭ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইসরাইল তার অবৈধ বসতি বিস্তার এক মুহূর্তের জন্যও থামায়নি। ইসরাইল তার সীমান্তকে এদিকে নীলনদ, ওদিকে জর্ডান নদী, আরেক দিকে ফোরাত নদী পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার মহাপরিকল্পনাও কখনও লুকায়নি। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ হিসেবে জায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরাইল বিশ্বে বসবাসকারী সব ইহুদিকে ইসরাইলের নাগরিকত্ব প্রদান করে। বিশ্বের যেকোনো দেশের ইহুদি নাগরিক ইসরাইলে বসবাস করতে চাইলে অনায়াসে তাকে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ করে দেয়ার রেওয়াজ বিদ্যমান, যা পৃথিবীতে বিরল।

১৯৪৮ সালে প্যালেস্টাইনের বুকে গায়ের জোরে ইসরাইল রাষ্ট্র কায়েম করার সময় জায়নবাদী নেতা ও ইসরাইলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বেন গুরিয়ন বলেছিলেন, ফিলিস্তিনের আরব বৃদ্ধরা মরে যাবে, আর তরুণরা ভুলে যাবে। কিন্তু, তা হয়নি। ফিলিস্তিনিরা ৭৩ বছর ধরে রক্ত দিয়ে জেরুজালেম ও আরব ভূমির সম্পূর্ণ বেহাত হওয়া ঠেকিয়ে যাচ্ছে। প্রখ্যাত ফিলিস্তিনি কবি মাহমুদ দারবিশ লিখেছিলেন, ‘প্রতিটি প্রত্যুষই হলো নবজাত বিদ্রোহীর জন্মদিন। ফিলিস্তিনে প্রতিদিনই নতুন নতুন মুক্তিযোদ্ধার জন্ম হচ্ছে’। ফিলিস্তিনিদের গণহত্যা করেও যে থামানো যাবে না- প্রতিরোধ সংগ্রামীরা এরই মধ্যে তা বুঝিয়ে দিয়েছে। ২০০৬ সালে হিজবুল্লাহর সঙ্গে, ২০০৮ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত হামাসের সঙ্গে তিনটি যুদ্ধে ব্যর্থতায় ইসরাইলের অপরাজেয় থাকার রূপকথাতুল্য খ্যাতি ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। আগের যুদ্ধগুলোতে কোনো আরব দেশই ইসরাইলের ভেতরে যুদ্ধ স্থানান্তরিত করতে সক্ষম হয়নি। সে সময় ইসরাইলের ইচ্ছায় যুদ্ধ সমাপ্ত হতো। ২০০৬ সালে লেবাননের হিজবুল্লাহ প্রথমবারের মতো ইসরাইলের ভেতরে যুদ্ধ স্থানান্তরিত করতে সক্ষম হয়।

২০ হাজার বর্গকিলোমিটারের ছোট্ট আয়তনের পূর্ব-পশ্চিম সরু দেশটির এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে গাড়ি দিয়ে মাত্র ৯০ মিনিটে পৌঁছানো যায়। প্লেনে পৌঁছানো যায় মাত্র কয়েক মিনিটে। সামরিক ও কৌশলগত দিক দিয়ে এটি ইসরাইলের সবচেয়ে দুর্বল দিক। যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সমর্থন ছাড়া চতুর্দিক শত্রুরাষ্ট্র বেষ্টিত ইসরাইলের অস্তিত্ব বিপন্ন। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী উপস্থিতি না থাকলে যে কোনো সময় বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে ইসরাইলের। সে হিসেবে অনেকে ইসরাইলকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে মানতে নারাজ। সুতরাং ইসরাইলের অস্তিত্বের প্রশ্নে মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতার পালাবদলও যে জড়িত- তা বলাবাহুল্য। যার লক্ষণ এরই মধ্যে ফুটে উঠেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আরব জাহানে মার্কিনিদের একচ্ছত্র আধিপত্য এখন তলানিতে। তাদের জন্য দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে আরবের মাটি। এক সময়ের সমৃদ্ধ জনপদ ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া আজ বিরান ভূমি মার্কিনিদের কারণে। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে আমেরিকার শূন্যস্থান পূরণে এরমধ্যেই জায়গা করে নিয়েছে রাশিয়া-চীন। চীন-রাশিয়া-ইরান-তুরস্কের মধ্যে গড়ে উঠেছে প্রতিরক্ষা ও অর্থনৈতিক ঐক্য, সঙ্গে যোগ দিয়েছে পাকিস্তানও। তুরস্ক ও ইরানের সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে ফেলতে চাইছে সৌদি-মিশর জোট।

আমেরিকার প্রধান অস্ত্র আমদানিকারক সৌদি আরব ইয়েমেন আগ্রাসন সামলাতে এখন শান্তির খুঁজে হন্য। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি এলে মার্কিন অস্ত্রের বাজার চুপসে যাবে। তা ছাড়া রাশিয়া-চীন-তুরস্ক ভাগ বসাচ্ছে আমেরিকার সমরাস্ত্রের বাজারে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াবিরোধী পদক্ষেপগুলোতে মুসলিম বিশ্ব, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের ঘনিষ্ঠ মিত্রদের কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পায়নি আমেরিকা। এদিকে তুরস্ক-ইরানের বিস্ময়কর সামরিক উত্থানের ফলে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের একক আধিপত্য এখন আর নেই বললেই চলে। ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ সংগ্রামীরা বহুদিন ধরে বলে আসছেন- অবৈধ ইহুদিবাদী ইসরাইলের ধ্বংস অনিবার্য। ইরান তো বারবার বিশ্ব মানচিত্র থেকে ইসরাইলের মানচিত্র মুছে ফেলার কথা বলে থাকে।

এটা তো গেল ভূরাজনীতির সম্ভাব্য সমীকরণ। নৈতিক অঙ্কেও ইসরাইল দেউলিয়া। ইহুদিদের একটি বড় গোষ্ঠীর মতে, বাইবেল বর্ণিত ‘প্রমিজড ল্যান্ড’ বলতে ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা বোঝায় না, বোঝায় ইহুদিদের আধ্যাত্মিক কেন্দ্রকে। অধিকাংশ নৃবিজ্ঞানীদের মতে, খ্রিষ্টজন্মের আগে ও পরে মাত্র কয়েকশ’ বছর জেরুজালেমে ইহুদি রাজত্ব থাকলেও প্রাচীন এ নগরীর সঙ্গে ৩ হাজার বছরের ইতিহাস ও বর্তমান জবরদখলকারী ইসরাইলের কোনো সম্পর্ক নেই। বর্তমানে যারা ইসরাইল শাসন করে তারা মূলত ইউরোপীয় ইহুদি। এদের বলা হয় আশকেনাজি জুইশ। কিছু আরব ইহুদি আছে, যারা আগে থেকেই ফিলিস্তিনে ছিল। এদের বলা হয় মিজরাহি জুউশ। হিস্পানিক নামে কিছু ইহুদি আছে। তবে ইসরাইলে এলিট শ্রেণি হচ্ছে- আশকেনাজি জুইশ। এরাই মূলত জার্মান আর ফ্রান্স থেকে বিতাড়িত হয়ে ফিলিস্তিনিদের জমি দখল করেছে। এরা অসম্ভব উগ্র, জেনোফোবিক এবং ধনী। এদের কালচারের সঙ্গে আরব ইহুদিদের কালচার কোনোভাবেই মিলে না।

আরব ইহুদিরা ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে আগ্রহী। কারণ, মুসলিম শাসনামলে তারা নিরাপদেই ছিল। অনিরাপদ ছিল খ্রিষ্টান ক্রুসেডারদের কাছে। বায়তুল মোকাদ্দাস দখল-বেদখল চলাকালে ক্রুসেডারদের হাতে মুসলমানদের পাশাপাশি জেরুজালেমের অনেক ইহুদিও গণহত্যার শিকার হয়েছিল। ফিলিস্তিনি হত্যা বন্ধের দাবিতে ইসরাইলে যেসব ইহুদি মাঝেমধ্যে প্লেকার্ড হাতে বিক্ষোভ করে, তারা মূলত ওইসব ইহুদিদের বংশধর। এসব ইহুদিরা মনে করে, তাদের ধর্মগ্রন্থ মতে মেসিয়াহ (মুসলমানদের কাছে দাজ্জাল) না আসা পর্যন্ত ইহুদিদের জন্য আলাদা দেশ গঠন করা পুরোপুরিভাবে নিষিদ্ধ। এ কারণেই অন্যান্য দেশের অর্থোডক্স ইহুদি এবং ইহুদি ধর্মগুরুরা ইসরাইলের বিরোধী। এদের বড় একটি অংশের বসবাস আমেরিকাতে। নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটন ডিসিতে ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে এরা কিছুদিন আগেও ইসরাইলবিরোধী বিক্ষোভ করেছে।

ইসরাইলিরা অভ্যন্তরীণভাবেও এক ডজনেরও বেশি বিষয়ে নিজেদের মধ্যে চরমভাবে বিভক্ত। রাজনীতি, ধর্ম, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিভিন্ন ইস্যুতে অনেক ইসরাইলি একে অপরের ঘোরতর শত্রু। আরব-ইসরাইলি দ্বন্দ্ব ছাড়াও তাদের কেউ উদারপন্থি, কেউ কট্টরপন্থি, কেউ গণতন্ত্রী, কেউ সমাজতন্ত্রী, কেউ সংস্কারপন্থি, কেউ লিবারেল, কেউ ধার্মিক, কেউ সেক্যুলার। এর সঙ্গে আছে জাতি ও গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব। ১ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত ইসরাইলের ২২ শতাংশ আরব, যাদের বর্তমান ইসরাইলি নেতৃত্ব দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে গণ্য করে। এসব আরবের মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক খ্রিষ্টানও রয়েছে, যারা বরাবরই ইসরাইলবিরোধী। অধিকন্তু, বিশ্ব জনমত আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ইসরাইলবিরোধী। ইসরাইলকে অন্ধ সমর্থন দেয়া মার্কিন সিনেটেরদের একসময় রেওয়াজ থাকলে সময়ের ব্যবধানে তাতেও ছিড় ধরেছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তবুও কেন জায়নবাদ বেপরোয়া? সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, এসবই দুর্বলতার লক্ষণ। সুতরাং যারা বলেন, হামাসের উস্কানিতে ইসরাইল বেপরোয়া; তারা খাদের তল মাপতে ভুল করছেন। কারণ, জায়নবাদ তার পূর্বঘোষিত লক্ষ্য হাসিলে সহিংসতা চালাতে বাধ্য। আর এই সহিংসতা চালাতে গিয়ে সময়ের ব্যবধানে ইসরাইল নামক ক্ষুদ্র রাষ্ট্র আজ অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত। ইসরাইলি জনগণের মাঝেও ইসরাইলের ভবিষ্যৎ নিয়ে মারাত্মক আতঙ্ক এবং অনিশ্চয়তাবোধ তৈরি হয়েছে, যা অতীতে আর কখনও দেখা যায়নি। ফলে অনেক ইসরাইলি প্রাণভয়ে ইউরোপ-আমেরিকাতে আবাস গড়তে চেয়েছে। ভেতর থেকেই ইসরাইলের ধসেপড়া ও বিলীন হওয়ার সম্ভাবনার কথা যে ইসরাইলের পৃষ্ঠপোষকদের কণ্ঠেও ধ্বনিত হচ্ছে- সে কথা শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে।

২০১৩ সালের ১২ মার্চ ‘নিউইয়র্ক পোস্ট’ এ মার্কিন কূটনীতির প্রবাদ পুরুষ হেনরি কিসিঞ্জারের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছিল : অদূর ভবিষ্যতে ইসরাইলের অস্তিত্ব নাও থাকতে পারে। সাবেক ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেটও একই আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করেছিলেন। ইসরাইলের অপর সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ বারাকও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছিলেন- ইতিহাসের নিরিখে দেখা যায় যে, ইহুদিরা কখনও ৮০ বছরের বেশি শাসনকাজ পরিচালনা করতে পারেনি। ইসরাইলের হিব্রু ভাষার পত্রিকা ইয়েদিয়েত ‘অহরোনথ’কে দেয়া সাক্ষাৎকারে ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর সাবেক জেনারেল এহুদ বারাক ২০২১ সালের ৮ তারিখ এপ্রিল এ কথা বলেছিলেন। এহুদ বারাক আরও বলেছিলেন, বাইবেল বর্ণনা অনুযায়ী ডেভিড ও হাসমোনিয়া রাজত্বকাল ছাড়া ইহুদিরা কখনও ৮০ বছরের বেশি শাসন পরিচালনা করতে পারেনি। এই দুই রাজত্বকালেও ৮০ বছর পর বিভেদণ্ডবিভ্রান্তি শুরু হয়।

লেখক : কলামিস্ট ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক