দেশকে অগ্নিগর্ভ করে তুলবেন না, মুসলিম নাম বদল প্রসঙ্গে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট
প্রকাশ : ০৭ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
দেশের ইতিহাসবিজড়িত জনপদের নাম ভারতীয় সংস্কৃতির কথা মনে রেখে পরিবর্তন করা হোক। সে জন্য গঠন করা হোক একটি নাম বদল কমিশন। এ আরজি জানিয়ে করা এক জনস্বার্থ মামলা ২৭ ফেব্রুয়ারি খারিজ করে দিয়েছেন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি কে এম জোসেফ ও বিচারপতি এম ভি নাগরত্ন আবেদনকারীকে জানিয়ে দিতে ভোলেননি যে ভারত এক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। সুপ্রিম কোর্টও ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান। এমন দেশে ধর্মান্ধতার আশ্রয় নিয়ে ঐতিহাসিক শহর, নগর, জনপদ বা রাস্তার নাম বদলের জন্য কমিশন গঠনের প্রশ্নই ওঠে না।
আবেদনকারী বিজেপি নেতা অশ্বিনী উপাধ্যায়ের উদ্দেশে বিচারপতিরা বলেন, নির্দিষ্ট কোনো সম্প্রদায়কে নিশানা করে সারাদেশকে অগ্নিগর্ভ করে তুলবেন না। অতীত খুঁড়তে যাবেন না। এমন কিছু করবেন না, যা বৈষম্য সৃষ্টি করবে।
বিচারপতিরা বলেন, ভারত ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। এ ছাড়া হিন্দু কোনো ধর্মবিশেষ নয়। এটা এক জীবনধারা। এই ধর্মে গোঁড়ামির স্থান নেই। বিচারপতিরা বলেন, দেশের ইতিহাস যেন কোনোভাবে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বোঝা না হয়ে ওঠে।
ভারতের একাধিক ঐতিহাসিক শহর, নগর, জনপদ ও সড়কের নাম বদলানো শুরু হয়েছে। কেন্দ্রে ও রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদ শহরের নাম বদলে ‘প্রয়াগরাজ’ রাখা হয়েছে। মোগলসরাই জংশনের নাম পাল্টে হয়েছে ‘দীনদয়াল উপাধ্যায়’। মাত্র তিন দিন আগে মহারাষ্ট্রের দুই ঐতিহাসিক শহর ঔরঙ্গাবাদ ও ওসমানাবাদের নাম বদলে যথাক্রমে ‘ছত্রপতি শম্ভাজিনগর’ ও ‘ধারাশিব’ করার প্রস্তাব অনুমোদন করেছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
রাষ্ট্রপতি ভবনের বিখ্যাত ‘মোগল গার্ডেন’-এর নাম বদলে করা হয়েছে ‘অমৃত উদ্যান’। এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ঠাট্টা-তামাশার বান বয়েছে। কেউ বলেছে, এবার ‘মোগলাই খানা’র নাম বদলে ‘অমৃত খানা’ রাখা হবে। ‘মোগলাই পরোটা’র নাম হবে ‘অমৃত পরোটা’। ‘মুঘল-ই-আজম’ সিনেমার নামকরণ করা হবে ‘অমৃত-ই-আজম’। উত্তর প্রদেশের রাজধানী লক্ষণৌয়ের নাম পাল্টে ‘লক্ষ্মণপুর’ করার চেষ্টা চলছে।
এ পরিস্থিতিতে বিজেপি নেতা অশ্বিনী উপাধ্যায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি নাম বদল কমিশন গড়ার আরজি জানিয়ে জনস্বার্থ মামলাটি করেন। তার আবেদন, আক্রমণকারী মোগলদের নামে যা কিছু রয়েছে, তা বদলানো প্রয়োজন। কারণ, বহু জায়গায় হিন্দুরা সংখ্যালঘু হয়ে গেছে। লোধি, গজনি, ঘোরির নামে রাস্তা আছে অথচ পা-বদের নামে কোনো রাস্তা নেই। এসব আক্রমণকারীর সঙ্গে ভারতের কোনো সম্পর্ক নেই।
আইনজীবী আবেদনকারী অশ্বিনী উপাধ্যায় সর্বোচ্চ আদালতকে যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেন, দেশের সার্বভৌমত্ব বজায় রাখতে, ধর্ম, সংস্কৃতি ও মর্যাদা অক্ষুণ্নœ রাখতে নাম বদলের কমিশন গঠনে সম্মতি দেয়া উচিত।
এর জবাবে বিচারপতিরা বলেন, ‘আমাদের দেশে বারবার বিদেশি শক্তি হানা দিয়েছে। এটা সত্যি। কিন্তু সেটাও ইতিহাসের অঙ্গ। সেই ইতিহাস জনপদ, রাস্তা বা সৌধের নাম পাল্টে মুছে ফেলা যায় না।’ বিচারপতিদের প্রশ্ন, ‘আমাদের দেশে কি আর কোনো সমস্যা নেই?’
বিচারপতি জোসেফ বলেন, ‘আমি কেরালার। আমার রাজ্যে গির্জা তৈরির জন্য হিন্দু রাজা জমি দিয়েছিলেন। আমি খ্রিষ্টান। কিন্তু হিন্দুধর্মের সমান ভক্ত। আমি হিন্দুধর্ম নিয়ে পড়াশোনা করেছি। অধিবিদ্যার বিচারে হিন্দুধর্ম শ্রেষ্ঠ।’
আবেদনকারীকে তিনি ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণনের বই পড়ে দেখার পরামর্শ দেন। সেই সঙ্গে জানিয়ে দেন, এ ধরনের উসকানিমূলক মামলায় দেশের সম্প্রীতি ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা হলে শীর্ষ আদালত চুপ করে থাকবেন না। সুপ্রিম কোর্টের এ পর্যবেক্ষণ সত্ত্বেও বিজেপি-শাসিত বিভিন্ন রাজ্যে মুসলিম নাম বদলানোর উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে। কিছুদিন আগে পদ্মভূষণ পাওয়া বিশিষ্ট অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহ এক সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে কটাক্ষ করে বলেছিলেন, মোগলদের সবকিছুই যখন এত খারাপ, তখন লাল কেল্লা, তাজমহল বা কুতুব মিনার কেন রেখে দেয়া হয়েছে? ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলেই তো হয়! (সূত্র : প্রথম আলো)