রাশিয়ার পারমাণবিক বোমারু বিমান ন্যাটোর দোরগোড়ায় মোতায়েনের পর এবার মার্কিন বিমান বাহিনীর বিশেষায়িত বিমান ‘মার্কারি ডুমস ডে’ (প্রলয়ের দিন) পূর্ব ইউরোপে অবতরণ করলো। মার্কিন এ বিমানকে বলা হয় হারবিঞ্জার অব নিউক্লিয়ার ওয়ার বা পারমাণবিক যুদ্ধের অগ্রদূত।
নরওয়ে সীমান্তের কাছাকাছি একটি বিমানঘাঁটিতে বিমানগুলো মোতায়েন করা হয়েছে। ‘মার্কারি ডুমস ডে’ উড়োজাহাজ দুই সপ্তাহ পর্যন্ত একটানা আকাশে অবস্থান করতে পারে। এসব উড়োজাহাজের অবকাঠামো পারমাণবিক বিস্ফোরণের ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভের সামনে অটল থাকতে ও আরোহীদের সুরক্ষা দিতে সক্ষম।
বোয়িং ই-সিক্স মডেলের উড়োজাহজটিকে ‘ডুমস ডে’ নাম দেওয়া হয়েছে। কারণ এতে রয়েছে মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর কৌশলগত কমান্ড সেন্টার, যাতে পারমাণবিক যুদ্ধ অথবা বিপর্যয়কর তেজস্ক্রিয় বিচ্ছুরণের মুহূর্তে আকাশ থেকে মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর কৌশলগত ইউনিটগুলোকে পরিচালনা করা যায়। পারমাণবিক হামলা হলে প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রিপরিষদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানগণ এসব বিমানে বসে যুদ্ধ পরিচালনা করতে পারবেন। এই বিমানে বসেই বোতাম টিপে প্রতিপক্ষের লক্ষ্য বস্তুতে পাল্টা পারমাণবিক হামলা চালানো যাবে। পৃথিবীতে এই ধরনের বিমানের মালিক শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর রাশিয়া। গত ২ ফেব্রুয়ারি ইতালিয়ান গণমাধ্যম লা রিপাবলিকা ও ব্রিটিশ গণমাধ্যম দৈনিক এক্সপ্রেস এ খবর ছেপেছে।
একই সঙ্গে পারমাণবিক প্রলয়ের ঘোড়সওয়ার আখ্যা পাওয়া পারমাণবিক মিসাইলবাহী সাবমেরিন ‘ইউএসএস রোড আইল্যান্ড’ও হঠাৎ ভূমধ্যসাগরে প্রবেশ করেছে। বিশেষ এ সাবমেরিন ২৪টি ট্রাইডেন্ট-টু আন্তঃমহাদেশীয় পারমাণবিক মিসাইল বহন করছে। এসব মিসাইল ১২ হাজার থেকে ১৮ হাজার কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে নির্ভুলভাবে আঘাত হানতে সক্ষম। আর এসব সাবমেরিনই শত্রুপক্ষের নজরদারি এড়িয়ে মাসের পর মাস সমুদ্রের তলদেশে ভ্রমণ করতে পারে।
ইতিপূর্বে রাশিয়া ‘পুজেইদন’ নামে এক ভয়ানক সাবমেরিন মোতায়েন করে আমেরিকাসহ পশ্চিমাদের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। এই সাবমেরিন সাগরের তলদেশে বিস্ফোরিত হলে প্রায় ৩২৮ ফুট উঁচু সুনামি তৈরি করতে পারে, যার বিধ্বংসী ক্ষমতা আর তেজস্ক্রিয়তা শুধু একটি দেশ নয়, পুরো বিশ্বের জন্যই মারাত্মক বিপর্যয় বয়ে আনতে পারে। পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ডসন বলেন, এই সুনামি তৈরি হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস এবং সান দিয়াগোর মতো সমুদ্র উপকূলীয় শহর হুমকির মুখে পড়বে। ঘণ্টায় ৫৬ নটিক্যাল মাইল গতিসম্পন্ন পুতিনের এই সাবমেরিনটি ৬ হাজার ২০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতে সক্ষম।
পৃথিবী এ পর্যন্ত দুটি বিশ্বযুদ্ধ দেখেছে। এছাড়া ছোট ছোট দীর্ঘমেয়াদি অনেক যুদ্ধ হয়েছে বিশ্বে। সম্প্রতি ইউক্রেন-রুশ যুদ্ধকে ঘিরে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা করা হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বের মাত্র নয়টি দেশের কাছে রয়েছে মোট ১৬ হাজার ৩০০টি পারমাণবিক বোমা। তন্মধ্যে রাশিয়ার কাছেই রয়েছে সবচেয়ে বেশি এ ধ্বংসাত্মক অস্ত্র। স্টকহোম আন্তর্জাতিক শান্তি গবেষণা ইন্সটিটিউট সিপ্রি-র তথ্য মতে, রাশিয়ার কাছে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি পারমাণবিক বোমা রয়েছে। দেশটিতে পারমাণবিক বোমার সংখ্যা ৭ হাজার ৫০০টির বেশি। ১৯৪৯ সালে প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষা করেছিল দেশটি। এ অস্ত্রে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম পারমাণবিক বোমা বানিয়ে এটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসিকায় ব্যবহারও করেছে। দেশটির এখন ৭০০০ এর মতো পারমাণবিক বোমা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার দখলেই রয়েছে প্রায় ১৫, ০০০ এর কাছাকাছি ধ্বংসাত্মক এ বোমা।
পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়াবহতা
পারমাণবিক অস্ত্র নিক্ষেপিত ও বিস্ফোরিত হলে তা থেকে ‘নিউক্লীয় হেমন্ত’ সৃষ্টি হয়ে গড়াবে ‘নিউক্লীয় শীতলতা’। এর ফলে পারমাণবিক বিস্ফোরণ থেকে সৃষ্ট রাসায়নিক ধোঁয়া সূর্যের আলোকে পৃথিবীপৃষ্ঠে পৌঁছতে বাধা দেয়ার কারণে বৈশ্বিক তাপমাত্রা কমে যাবে। এতে করে অতিবেগুনি রশ্মির তেজস্ক্রিয়তা বৃদ্ধির ফলে ওজোন স্তরের ক্ষতি হয়ে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাবে। বর্তমানে পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রটি হচ্ছে বি-৮৩, যার রয়েছে হিরোশিমা ধ্বংসকারী বোমা ‘লিটল বয়’ থেকেও ২০০ গুণ বেশি ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা। আর সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত এলাকাটির ব্যাপ্তি হবে ১৪.৯ বর্গ কিলোমিটার। চারদিকে অন্ধকার হয়ে দৃষ্টিসীমার মধ্যে থাকা সব কিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে, আঁধারে ছেয়ে দৃষ্টিসীমার সবকিছুই আড়াল হয়ে যাবে। টেলিগ্রাফের করা এক গবেষণানুসারে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার অস্ত্রভান্ডারে থাকা অস্ত্রগুলোর মিলিত শক্তি প্রায় ৬ হাজার ৬০০ মেগাটনের সমান, যা প্রতি মিনিটে সূর্য থেকে পৃথিবীতে আগত সৌরশক্তির দশ ভাগের এক ভাগের সমতুল্য!
পৃথিবী ধ্বংস হতে যতো বোমার প্রয়োজন
পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার শহরাঞ্চল রয়েছে। প্রতিটি শহরকে ধ্বংস্তূপে পরিণত করতে গড়ে ২-৩টি পারমাণবিক বোমাই যথেষ্ট। কিন্তু এরপরও ১ হাজার ৫০০টি পারমাণবিক বোমার কোনো ব্যবহারই দরকার পড়বে না। এ অবস্থায় ১৬ হাজার ৩০০ পারমাণবিক বোমা এক জায়গায় রেখে একই সঙ্গে বিস্ফোরণ ঘটানো হলে পৃথিবীর অবস্থা সহজেই অনুমানযোগ্য। একটি ছোটখাটো বিস্ফোরণ বোমার শক্তি হচ্ছে ১ টন টিএনটির সমতুল্য। আর গড়ে একটি পারমাণবিক বোমার শক্তি থাকে ২ লাখ টন টিএনটির সমান। ২ লাখকে ১৬ হাজার ৩০০ দিয়ে গুণ করলে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ৩২৬০,০০০,০০০ টন টিএনটি। পারমাণবিক বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গেই চারপাশে ৫০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে একটি অগ্নিগোলক তৈরি হবে এবং এর সামনে যা পড়বে সব বাষ্পীভূত করে ফেলবে। কোনোকিছুই এই অগ্নিবলয়ের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। সেই সঙ্গে ৩ হাজার বর্গ কিলোমিটারজুড়ে যা কিছু পাবে সব আগুনে পুড়িয়ে দেবে।
বিস্ফোরণ-কেন্দ্রের ২৫০ কিলোমিটারের মধ্যে যা কিছু আছে, সব আগুনে পুড়তে থাকবে। আর বিস্ফোরণটি শোনা যাবে পুরো পৃথিবীজুড়ে! ‘জার বম্বা’- রাশিয়ায় তৈরি এখন পর্যন্ত সর্ববৃহৎ এ পারমাণবিক বোমাটি ডেকে আনতে পারে পৃথিবীর প্রাণীকূলের অন্তিম দিবস। মাত্র ১৬ হাজারটি জার বম্বা পুরো পৃথিবীকে ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট।
এ অবস্থায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি প্রায় ৮০০ কোটি মানুষের এই প্রিয় ধরাকে নরকে পরিণত করে ফেলবে কি-না তা-ই এখন চিন্তাশীলরা আতঙ্কের কারণ হিসেবে দেখছেন। সাধারণ বিবেকবানদের প্রশ্ন, সত্যিই কি আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধ লেগে যাবে? বিবদমান দেশগুলোর নেতৃবর্গ কেন এতটাই অবিবেচক ও বেপরোয়া? যুদ্ধ বাঁধলে তারা নিজেরাও যে ধ্বংস হয়ে যাবেন- এটি কি তারা বিবেচনায় রাখছেন না?
লেখক : কলামিস্ট ও আন্তর্জাতিক
রাজনীতি বিশ্লেষক