ইসলামি দেশগুলো মতভেদ ভুলে নতুন করে শুরু করছে

প্রকাশ : ১৪ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

গত কয়েক বছরের প্রবণতা দেখলে মনে হয়, পশ্চিম এশিয়ার ইসলামি দেশগুলো তাদের পারস্পরিক ভেদাভেদ ভুলে যাচ্ছে।

এর একটি উদাহরণ ছিল ২০২১ সালে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন এবং মিশর কাতারের বিরুদ্ধে অবরোধ শেষ করে। ইরাকে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে কয়েক বছর ধরে আলোচনার পর ইয়েমেনের প্রতি সৌদি আরবের মনোভাবও বদলে যাচ্ছে। তুরস্ক এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতও তাদের পার্থক্য ভুলে গেছে এবং দুই দেশের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের সফর হয়েছে।

এর বাইরে তুরস্ক স্পষ্টতই সৌদি আরবের সঙ্গে তার মতপার্থক্যকে দূরে সরিয়ে রেখেছে এবং প্রেসিডেন্ট এরদোগান গত এপ্রিলে সৌদি আরব সফর করেছিলেন। গত বছরের জুনে সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানও তুরস্ক সফর করেন।

সৌদি আরব ঘোষণা করেছে যে, তারা তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঁচ বিলিয়ন ডলার জমা করবে। এমনিতে ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত তুরস্কের জন্য সৌদি আরব তার কোষাগারের মুখ খুলে দিয়েছে।

এসব ঘটছে এমন এক সময়ে যখন পশ্চিমাদের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক ভালো নয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পকে টানাপড়েন চলছে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন জাগে যে, যেসব ইসলামি দেশ আগে পরস্পরের বিরোধিতায় ছিল, তারা কি আসলেই এখন ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছে?

উপসাগরীয় দেশগুলোতে প্রাক্তন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত তালমিজ আহমেদ এরদোগানের সৌদি আরব সফরের সময় বিবিসিকে বলেছিলেন যে, ‘আফগানিস্তান পরিস্থিতির পর দুশ্চিন্তা বেড়েছে এবং এটি মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অবিশ্বাসের ব্যবধানকে আরও গভীর করেছে। উপসাগরীয় দেশগুলো মনে করে যে, এই ক্ষেত্রে তাদের নিজেদেই কূটনৈতিক ভূমিকা পালন করতে হবে। সৌদি আরব নিজেই ইরানের সঙ্গে কথা বলছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত নিজেই যাচ্ছে তুরস্কে। এভাবে সৃষ্টি হয়েছে নতুন পরিবেশ।

তালমিজ আহমদের মতে, আমেরিকা যেভাবে আফগানিস্তানকে তালেবানের হাতে তুলে দিয়েছিল এবং আফগানিস্তান থেকে বিছানাপত্র গুটিয়ে চলে গিয়েছিল তা এই বার্তাও দেয় যে আমেরিকা কোনো কাজকে তার যৌক্তিক পরিণতিতে নিয়ে যায় না। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে এখন অবিশ্বাসের পরিবেশ বিরাজ করছে। জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর ওয়েস্ট এশিয়ান স্টাডিজের অধ্যাপক এ কে মহাপাত্র বলেন যে, প্রেসিডেন্ট এরদোগান ইসলামিক বিশ্বের নেতা হতে চান কারণ তিনি বিশ্বাস করেন যে, তিনি তুরস্ক অটোমান সাম্রাজ্যের প্রকৃত উত্তরাধিকারী এবং মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দেওয়া তার অধিকার।

অন্যদিকে সৌদি আরব মক্কা ও মদিনার কারণে ইসলামি বিশ্বের নেতৃত্ব দেওয়াকে তার স্বাভাবিক অধিকার বলে মনে করে। সৌদি আরবের প্রতি এরদোগানের স্নিগ্ধতা তার রাজনীতির একটি রূপ মাত্র। আমি মনে করি না এটাকে পারস্পরিক মতপার্থক্য দূরীকরণ হিসেবে দেখা উচিত।

তার মতে, ‘পশ্চিম এশিয়া হলো সেই অঞ্চল যেখানে কাতার একটি ধনী রাষ্ট্র, অন্যদিকে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতও সমৃদ্ধ।’ তিনটি দেশই সম্পদের ভিত্তিতে তাদের অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে।

আমাদের মনে রাখতে হবে যে, সৌদি আরব উগ্র ইসলাম থেকে উদার ইসলামে চলে যাচ্ছে যখন তুরস্ক ধর্মনিরপেক্ষ ও আধুনিক ইসলাম থেকে উগ্র রাজনৈতিক ইসলামে চলে যাচ্ছে। এভাবে দুই দেশের রাজনৈতিক ইসলামে বড় পার্থক্য রয়েছে।

জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ওয়েস্ট এশিয়ান স্টাডিজের আরেক অধ্যাপক আফতাব কামাল পাশা বিশ্বাস করেন যে, এরদোগান তুরস্ককে কয়েক বছর ধরে কূটনৈতিক ও কৌশলগত স্বাধীন অবস্থানে নিয়ে এসেছেন এবং পশ্চিমারা এটি পছন্দ করেনি।

অধ্যাপক পাশা বলেছেন যে, ২০০৩ সালের আগে তুরস্কে সেনাবাহিনীর আধিপত্য ছিল। তুরস্কের অর্থনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপও ছিল বেশি; কিন্তু এরদোগান এই দীর্ঘ ঐতিহ্যের অবসান ঘটান। তাদের আগমনের পর থেকে তুরস্কে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের আবির্ভাব হয়েছে। তুর্কি সরকারে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের অবসান ঘটেছে। এই অর্থে, এরদোয়ান তুরস্কের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে বদলে দিয়েছেন। আমি মনে করি এটা তার সাফল্য। ২০১৮ সাল থেকে তুরস্ক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাসের সম্মুখীন হচ্ছে এবং যখন রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করেছিল, তখন তুরস্কেও জ্বালানি এবং খাদ্যের দাম আকাশচুম্বী হয়েছিল। এ ছাড়া তুরস্ক তার জ্বালানি আমদানির ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল।

ইস্তানবুলের একজন অর্থনীতিবিদ আনোয়ার আরাকান সৌদি আরবের ৫ বিলিয়ন ডলারের আমানত সম্পর্কে আরব নিউজকে বলেছেন যে ‘সৌদি আরব খুব কঠিন সময়ে তুরস্ককে সাহায্য করেছে।’ তুরস্কের অর্থনীতি আগে থেকেই সংকটে থাকলেও ভূমিকম্পের পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। প্রাথমিক অনুমান অনুযায়ী, ভূমিকম্পের কারণে তুরস্কের ৩৪ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে। ভূমিকম্প-পরবর্তী পুনর্গঠনে অর্থ ও সম্পদেরও প্রয়োজন হবে।

গত বছর ডলারের বিপরীতে তুর্কি লিরার মূল্য ৩০ শতাংশ কমেছে। ২০২১ সালে ডলারের বিপরীতে লিরা ৪৪ শতাংশ দুর্বল হয়েছে। উপরন্তু, গত পাঁচ বছরে তুরস্কের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উল্লেখযোগ্যভাবে দুর্বল হয়েছে এবং এখন তুরস্কের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারেরও কম হয়ে গেছে। এমন সময়ে সৌদি আরবের সাহায্য খুবই জরুরি ছিল।

এরদোগানের আগেকার সরকারগুলোকে পশ্চিমের বন্ধু মনে করা হতো এবং তুরস্কের মধ্যপ্রাচ্যে তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। তবে এরদোগান ক্ষমতায় আসার পর উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। আরব বিশ্বের বিভিন্ন সরকারের বিরুদ্ধে ‘আরব বসন্ত’ শুরু হলে তুরস্ক ও সৌদি আরবের অবস্থান ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।

আরব বসন্তে, শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের কণ্ঠস্বর সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক রাজতন্ত্র এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় আশঙ্কা জাগিয়েছিল যে তাদের সিংহাসন বিপদে পড়তে পারে।

শুরুতে আরব বসন্তের ব্যাপারে এরদোগানের স্পষ্ট অবস্থান না থাকলেও পরে তিনি একে সমর্থন করতে শুরু করেন।

যেহেতু তুরস্কেরও সামরিক স্বৈরশাসকদের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের ইতিহাস রয়েছে, তাই আরব বসন্তের প্রতি এরদোগানের সমর্থন এই প্রেক্ষাপটে খুব বেশি আশ্চর্যজনক ছিল না, তবে তুরস্কের অবস্থান সৌদি আরবকে ক্ষুব্ধ করেছিল এবং দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক লাইনচ্যুত হয়েছিল।

২০১৭ সালের জুন মাসে, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন এবং মিশর কাতারের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করে, তখন তুরস্ক এর বিরোধিতা করে। তুরস্ক সবদিক দিয়ে কাতারের অবরোধের বিরোধিতা করেছিল এবং তাদের সমর্থনে সেনাবাহিনী পাঠিয়েছিল। চারটি দেশই তুরস্কের এই পদক্ষেপকে তাদের প্রতি শত্রুতা বলে মনে করেছিল।

এরপর ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক জামাল খাসোগির হত্যাকাণ্ড দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটায়। জামাল খাসোগি সৌদি আরবের বাসিন্দা এবং তিনি রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে লিখতেন। তার হত্যার জন্য সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে দায়ী করা হয়।

তুরস্ক খাসোগি হত্যার অডিও প্রকাশ করে এবং সরাসরি সৌদি আরবের যুবরাজকে দায়ী করে। সে সময় সৌদি যুবরাজের ভাবমূর্তি পশ্চিমা বিশ্বে একজন সংস্কারপন্থি নেতার রূপ নিচ্ছিল; কিন্তু খাসোগি হত্যাকাণ্ডে সবকিছু উল্টে যায়।

২০২১ সালের জানুয়ারিতে, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন এবং মিশর কাতারের বিরুদ্ধে অবরোধ শেষ করার ঘোষণা দেয়। এরপর থেকে উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ নেয় তুরস্ক।

বলা হয়, তুরস্ক যখন পশ্চিমে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তখন উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন শুরু করে। তুরস্ক এমনকি ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করেছে এবং কয়েক বছর পরে দুই দেশ একে অপরের কাছে দূত পাঠায়।

গত বছরের এপ্রিলে তুরস্ক খাসোগি হত্যার মামলা বন্ধ করে সৌদি আরবের কাছে হস্তান্তর করে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো তুরস্কের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করলেও তুরস্ক বলেছে যে তারা নিজেদের স্বার্থে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইরানের সঙ্গে উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর সম্পর্কের টানাপড়েনের মধ্যেও তুরস্ক ইরানের সঙ্গে সবসময় সদ্ভাব বজায় রেখেছে। ইয়েমেনে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে প্রক্সি যুদ্ধ চলছে। অন্যদিকে তুরস্কের সঙ্গে ইরানের সুসম্পর্ক রয়েছে। প্রয়োজনে তুরস্ক দুই দেশের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করতে পারে। এই লড়াইয়ে তুরস্ক সৌদি আরবকে সাহায্য করতে চাইলে সামরিক সহায়তাও দিতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সৌদি আরবে ইরানি ড্রোনের হুমকি বেড়েছে। সে ক্ষেত্রে সৌদি আরবকে ড্রোনের মাধ্যমে সাহায্য করতে পারে তুরস্ক।

ওয়াশিংটন ডিসি-ভিত্তিক আরব সেন্টারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সৌদি আরব এবং তুরস্কের মধ্যে উত্তেজনা হয়েছে অনেকটা ব্যক্তিগত পর্যায়ের, অন্যদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং তুরস্কের মধ্যে উত্তেজনা ছিল আদর্শিক। রাজনৈতিক ইসলাম ও মুসলিম ব্রাদারহুড নিয়ে উভয় দেশেরই ভিন্ন মত রয়েছে। আঙ্কারায় অনেকেই অভিযোগ করেন যে, ইউএইও ২০১৬ সালে এরদোগানের বিরুদ্ধে ব্যর্থ অভ্যুত্থানে জড়িত ছিল। সংযুক্ত আরব আমিরাতও লিবিয়ায় তুরস্কের সামরিক হস্তক্ষেপে রাজি হয়নি। এদিকে সৌদি আরব ২০১৪ সালে মুসলিম ব্রাদারহুডকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করে। কাতারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে সৌদি আরব এই পদক্ষেপ নেয়।

তালমিজ আহমেদ বলেছেন, ‘আমেরিকার প্রতি অবিশ্বাস বেড়েছে।’ তুরস্কেও দৃষ্টিভঙ্গি কৌশলগত সার্বভৌমত্ব। তুরস্ক কারও সঙ্গে স্থায়ীভাবে জোটবদ্ধ নয়। কাজেই তুরস্কের সঙ্গে অন্যান্য ইসলামি দেশের যে সম্পর্ক স্থাপিত হচ্ছে, তাকে ইস্যুভিত্তিক বলা ভুল হবে না। এটি কোনো দীর্ঘস্থায়ী জোটবদ্ধতা নয়। তাতে কোনো বাধ্যবাধকতার ব্যাপার নেই। কারণ যেখানে সহযোগিতা আছে, সেখানে প্রতিযোগিতাও আছে। সম্প্রতি চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের যে চুক্তি হয়েছে, তাকে ইসলামি দেশগুলো অতীতের দূরত্বকে পায়ে মাড়িয়ে পরস্পর ঘনিষ্ঠ হওয়ার কৌশলগত অবস্থানের দিকে এগিয়ে যাওয়ার মাইলফলক বলে তথ্যাভিজ্ঞ মহল মনে করছেন।

* বিবিসি উর্দু অবলম্বনে