মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইসরাইলের অস্তিত্ব মুছে ফেলার হুমকি প্রদানকারী দেশ ইরানের দুর্দমনীয় সামরিক সক্ষমতা দেখে ঘুম হারাম ইসরাইলি যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর। তিনি এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, ইসরাইলকে ‘ডু অর ডাই’- এই দুটি থেকে যেকোনো একটি বেছে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। তিনি ইরানে হামলার বিষয়ে মার্কিন গ্রিন সিগন্যালের কথাও অবলীলায় স্বীকার করেছেন। তবে ইসরাইল একা নয়, হামলায় অংশ নিতে পারে আমেরিকা, ফ্রান্সও। নেতানিয়াহু সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স সফর করে সব ঠিকটাক করে ফেলেছেন বলে জানিয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যম। এরই মধ্যে ইরানের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে থাকা আমেরিকা এবং ব্রিটেনের সামরিক ঘাঁটিগুলো এবং তাদের সমর্থিত কুর্দি দলগুলোর সঙ্গে মার্কিন সামরিক কর্মকর্তাদের বৈঠক ও অস্বাভাবিক তৎপরতা বেড়ে গিয়েছে। ফলে যেকোনো সময় ইরানে হামলা হতে পারে- এমন ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ইরানে হামলা হলে তার পরিণতি কি হতে পারে তা নিয়ে আজকের প্রয়াস।
আন্তর্জাতিক সমর বিশ্লেষকদের মতে, ইরানে হামলা সহজ কোন বিষয় নয়। অবিবেচনাপ্রসূত এরকম কিছু হলে বদলে যেতে পারে মধ্যপ্রাচ্যের দৃশ্যপট। যৌথ হামলায় ইরান যেমন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা, তেমনি মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র থেকে ২০ হাজার বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ছোট্ট ইসরাইল রাষ্ট্রের অস্তিত্বও মুছে যেতে পারে চিরতরে। মধ্যপ্রাচ্যে থাকা আমেরিকার ঘাঁটিগুলোতে হাজার হাজার সৈন্যের প্রাণহানি হতে পারে। আক্রান্ত হতে পারে ইউরোপও। সমর বিশ্লেষকদের মতে, ইরান কোনোভাবে আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়ার মতো দুর্বল প্রতিপক্ষ নয়। সেই সঙ্গে অসহায়ও নয়। ইরানের পাশে রয়েছে রাশিয়া, চীনের মতো পরাশক্তি আর তুরস্কের মতো আঞ্চলিক শক্তি। ১৪ মার্চ কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার সুখোই-৩৫ জঙ্গি বিমান কর্তৃক মার্কিন ড্রোন ভূপাতিতের ঘটনায় সৃষ্ট উত্তেজনা ইরানের জন্য ‘শাপেবর’ হয়ে দেখা দিয়েছে। ইসরাইল-ইরান চরম উত্তেজনার মাঝে ১৯ মার্চ রাশিয়া ও চীন ইরানকে সঙ্গে নিয়ে ওমান সাগরে বহুজাতিক নৌ মহড়ার ঘোষণা দিয়ে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রকে।
ইরানের রয়েছে বিশাল ক্ষেপণাস্ত্র ও মিসাইল ভান্ডার। ইরানে কোনো প্রকার হামলা মানেই হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে যাওয়া, যেটা দিয়ে বিশ্বের ৩০% তেল ও গ্যাস রপ্তানি হয়। ওই অঞ্চলে তেল ও গ্যাস উত্তোলন ও বিক্রি বন্ধ হয়ে গেলে পুরো বিশ্বে শিল্পকারখানাগুলোতে উৎপাদন ও বাণিজ্য ব্যাহত হবে মারাত্মকভাবে। না খেয়ে মারা যাবে অসংখ্য বনি আদম।
আক্রান্ত হবে আমেরিকার মিত্র আরব দেশগুলো। এককথায়, গোটা মধ্যপ্রাচ্যে জ্বলে উঠবে আগুনের লেলিহান শিখা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিষয়ক গবেষণা বিভাগের প্রধান হ্যারিজে ক্যাথিয়ানিস এ বিষয়ে মার্কিন কর্মকর্তাদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ইরানের সঙ্গে যুদ্ধের চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত আমেরিকাণ্ডইসরাইলের। তার মতে, ইরানের সঙ্গে যুদ্ধের পরিণতি অতীতের কোনো যুদ্ধের মতো হবে না। কারণ, ইরানে থাকতে পারে ধারণার চাইতেও যতসব ভয়ানক মারণাস্ত্র। অতীত বলতে তিনি ভিয়েতনাম, যুগোশ্লাভিয়া; পরে আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়ার কথাই বলেছেন।
বলার অপেক্ষা রাখে না, ইসরাইলের বিমানবাহিনী শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, বিশ্বেরও অন্যতম শক্তিশালী। আমেরিকা কিংবা মার্কিন-ইসরাইল যৌথ নির্মিত এফ-১৬, এফ-১৫ই এক্স, লকহিড মার্টিন এফ-৩৫বি এবং এফ-৩৫সি এর মতো সর্বাধুনিক শক্তিশালী বিমান রয়েছে ইসরাইলের হাতে। তার সঙ্গে ফরাসি রাফায়েল যুদ্ধ বিমান হামলায় অংশ নিলে হামলা মোকাবিলায় ইরানের সক্ষমতা কতটুকু সেটা বলা মুশকিল। অনেক সমর বিশ্লেষকের মতে, রুশ প্রযুক্তিতে গড়ে তোলা ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বর্তমানে যথেষ্ট শক্তিশালী। এক সময় ইরানের রাডার নেটওয়ার্ক সিস্টেম যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইলের কোনো যুদ্ধবিমান শনাক্ত এবং অনুসরণে সক্ষম ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইলসহ বিভিন্ন দেশের ড্রোন বিমান ইরানের অভ্যন্তরে অহরহ প্রবেশ করত এবং দীর্ঘ সময় অবস্থান করতে পারত। ইরানের সেদিন এখন আর নেই। ইরানের কাছে বর্তমানে রয়েছে রাশিয়ার শক্তিশালী ‘এস-৩০০’ ও ‘এস-৪০০’ মিসাইল সিস্টেম। এছাড়া ইরান নিজেও এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম উদ্ভাবন করেছে। ইরানের বর্তমান এয়ার ডিফেন্স মিসাইল সিস্টেম ইসরাইলের এফ-১৬ অথবা এফ-১৫ বিমানের জন্য বড় ধরনের হুমকি। এসব বিমান ইরানে প্রবেশ করলে তা ইরানের রাডারে ধরা পড়বে এবং ইরানের শক্তিশালী মিসাইল আঘাতের শিকার হবে। তাই ইরানে হামলা করতে হলে এখন ইসরাইলের সেটি করতে হবে শুধুমাত্র এফ-৩৫ এর সাহায্যে। এফ-৩৫ এর মোকাবিলায় ইরানের হাতে চলতি মার্চ মাসের মধ্যেই চুক্তি মোতাবেক ‘সুখোই সু-৩৫ ফ্ল্যাঙ্কার’ পৌঁছে গেলে বাধাগ্রস্ত হবে এফ-৩৫ এর একক আধিপত্য। ইরান রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম স্টিলথ জঙ্গি বিমান তৈরি করে ফেলেছে। এ ছাড়া নিজস্ব প্রযুক্তিতে ‘অযারাখশ’ নামে সুপারসনিক জঙ্গি বিমানও তৈরি করেছে। এটি শব্দের চেয়েও দ্রুত গতিতে চলে। ইরানে সম্ভাব্য হামলায় তেহরানের দক্ষিণের নাতাঞ্জ এবং কোম শহরের ‘ফোর্দো’ পরমাণু এবং ইস্পাহান নগরের পারমাণবিক স্থাপনার মতো কতেক স্থাপনা ধ্বংস করে দেয়া সম্ভব হলেও বিশাল আয়তনের দেশটির আনাচে কানাচে পর্বতময় ও ভূগর্ভস্থ এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ডজনখানেকের বেশি পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা ইরানের শক্তির মূল স্তম্ভ। ইরানের অপ্রতিরোধ্য ক্ষেপণাস্ত্র শক্তি মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বড়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগ স্বীকার করেছে, ইরানের স্বল্প বা মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের আওতায় আছে পুরো ইসরাইল। শাহাব, আশুরা, ক্বদর, সেজ্জিল- এসব ক্ষেপণাস্ত্র এক হাজার থেকে তিন হাজার কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে গিয়ে আঘাত হানতে পারে। ছয় ধরনের শাহাব মিসাইল আছে ইরানের হাতে। মিশকাত নামের ইরানি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের দৌঁড় দুই হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত। এসব মিসাইলের অধিকাংশ ইসরাইলের দিকে তাক করা। বোতামে টিপ দিলেই সোজা ইসরাইল। ক্বদর-১১ মিসাইল ইউরোপের জন্যও হুমকি। সম্প্রতি ইরানি সামরিক বাহিনীর এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ইরান এরই মধ্যে ক্বদর-১১ মিসাইলকে সুপারসনিকে অর্থাৎ শব্দের চেয়ে চারগুণ দ্রুত গতিতে রূপান্তর করেছে। তার মানে ফ্রান্স ইরান আক্রমণে ইসরাইল-যুক্তরাষ্ট্রের সারথি হলে প্যারিসের মতো জনবহুল নগরীও ইরানের সুপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের নিশানা হবে। বিশ্বের অল্প কয়েকটি দেশের কাছে এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি রয়েছে।
মহাশূন্য প্রেরিত স্যাটালাইটের সঙ্গে মিসাইল প্রযুক্তি যুক্ত হওয়ায় ইরানের এ শিল্প অগ্রগতির শীর্ষ পর্যায়ে উঠে এসেছে। সিরিয়া, লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইরাকের শিয়া মিলিশিয়া, ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহী, গাজা উপত্যকার হামাস, ইসলামি জিহাদকে হাজার হাজার রকেট, ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইরান একপ্রকার ঘেরাও করে রেখেছে ইসরাইলকে। ইরান সমর্থিত লেবাননের হিজবুল্লাহকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অরাষ্ট্রীয় আর্মি বিবেচনা করা হয়। হিজবুল্লাহর কাছে ৫০ হাজার থেকে দেড় লাখ রকেট মজুত রয়েছে বলে ধারণা করা হয়, যা বিশ্বের অনেক দেশের আর্মির কাছেও নেই। এসব রকেটের মূল লক্ষ্য ইসরাইল। তাদের রয়েছে হাজার হাজার এন্টি এয়ারক্রাফট, এন্টি শিপ এবং এন্টি ট্যাঙ্ক মিসাইল। সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, প্রচলিত যুদ্ধে আরব দেশের কোনো আর্মি হিজবুল্লাহর মত শক্তিশালী নয়। ২০০৬ সালে লেবাননের হিজবুল্লাহ প্রথমবারের মতো ইসরাইলের ভেতরে যুদ্ধ স্থানান্তরিত করতে সক্ষম হয়। ইসরাইলি দখলদার নাগরিকরা সেবারই প্রথম যুদ্ধের স্বাদ আস্বাদন করে। আগের যুদ্ধগুলোতে কোনো আরব দেশই ইসরাইলের ভেতরে যুদ্ধ স্থানান্তরিত করতে সক্ষম হয়নি। সে সময় ইসরাইলের ইচ্ছায় যুদ্ধ সমাপ্ত হতো। এরপর ইসরাইল হিজবুল্লাককে খুব একটা ক্ষ্যাপায়নি। ইরান আক্রান্ত হলে হিজবুল্লাহ সর্বশক্তি নিয়োগ করবে- সেটা বলাই বাহুল্য। ইসরাইল তার পুরো সীমানা আয়রন ডোমের মতো এন্টি প্লাস্টিক মিসাইল দিয়ে সুরক্ষিত এবং শত্রুর যেকোনো মিসাইল/ক্ষেপণাস্ত্র আকাশেই ধ্বংস করতে সক্ষম দাবি করলেও একই সময়ে একাধিক ফ্রন্টে যুদ্ধ পরিচালনা এবং প্রতিরোধ ব্যূহ গড়ে তোলা আদৌ সম্ভব কি-না সেই সন্দেহ জোরালো করে তুলেছে হামাসের শতভাগ রকেট হামলা ঠেকাতে ব্যর্থতার পর। ইরান আক্রান্ত হলে ইরান সমর্থিত দেশ ও মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলো যে ইসরাইলে একযোগে হামলা চালাবে- তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। এ অবস্থায় ছোট্ট আয়তনের ইসরাইল নামক রাষ্ট্র নিমিষেই নিশ্চিহ্ন হতে পারে বিশ্বমানচিত্র থেকে। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন ঘাঁটিগুলোও ব্যাপক হামলার শিকার হবে। ইরান নৌ-প্রতিরক্ষা শিল্পে ইরানের অসাধারণ অগ্রগতির বড় প্রমাণ হলো, ‘গাদির সাবমেরিন’ ও ‘ব্লিড রানার-৫১’ নামক দ্রুত গতিসম্পন্ন হাজার হাজার ছোট নৌযান। আক্রান্ত হলে পারস্য উপসাগরে মার্কিন যুদ্ধ ও বাণিজ্য জাহাজকে অসহায় করে তুলবে ইরানের এসব নৌযান। বড় কোনো জাহাজকে এক আঘাতেই ধ্বংস করা সম্ভব। কিন্তু, হাজার হাজার নৌযানকে একসঙ্গে ধ্বংস করা সম্ভব নয়। এসব নৌযান মুহূর্তেই গতিপথ বদলাতে পারে। ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল ইজহাক ব্রিক সম্প্রতি গণমাধ্যমে দেয়া এক বিবৃতিতে বলেছেন, ইরানে ইসরাইলি হামলা সুবিবেচনার কাজ হবে না। তাঁর ধারণা, সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হলে প্রতিদিন ইসরাইলে তিন হাজার ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানবে। এ ধরনের যুদ্ধ মোকাবিলার জন্য ইসরাইলের সামরিক বাহিনী প্রস্তুত নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন। জেনারেল ব্রিক বলেন, সবচেয়ে ভয়ংকর দৃশ্যপট তৈরি হবে সিরিয়া, ইয়েমেন ও ইরাকে তৎপর ইরানপন্থি গেরিলা গোষ্ঠীগুলোর হামলা। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকদের মাঝে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, এর পরও কি ইসরাইল ইরানে হামলার সাহস পাবে? নাকি বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে ইসরাইলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ বারাক ভবিষ্যদ্বাণী! ২০২১ সালের ৮ এপ্রিল ইসরাইলের হিব্রু ভাষার পত্রিকা ‘ইয়েদিয়েত অহরোনথ’কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর সাবেক জেনারেল এহুদ বারাক বলেছিলেন, বাইবেল বর্ণানা অনুযায়ী ডেভিড ও হাসমোনিয়া রাজত্বকাল ছাড়া ইহুদিরা কখনো ৮০ বছরের বেশি শাসন পরিচালনা করতে পারেনি। এই দুই রাজত্বকালেও ৮০ বছর পর বিভেদণ্ডবিভ্রান্তি শুরু হয়। বর্তমান ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরাইলের বয়স ৮০’র কাছাকাছি (৭৬ বছর)।
লেখক : কলামিস্ট ও আন্তর্জাতিক
রাজনীতি বিশ্লেষক