ঢাকা ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ইরাক যুদ্ধে কলকাঠি নাড়ানো ব্যক্তিরা এখন কে কোথায়

ইরাক যুদ্ধে কলকাঠি নাড়ানো ব্যক্তিরা এখন কে কোথায়

বিশ বছর আগে যখন ইরাক যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তখন বিশ্বের মানুষ হয়তো মার্কিন প্রেসিডেন্ট আর ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের নাম সবচেয়ে বেশি শুনেছেন। কিন্তু সেই যুদ্ধের পেছনে ভূমিকা ছিল আরও অনেক ব্যক্তির।

ইরাক যুদ্ধে সাড়ে চার হাজারের বেশি মার্কিন সেনা আর আনুমানিক ১ লাখ ২০ হাজার ইরাকি বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। ২০ বছর পার হলেও এখনো পুরোপুরি স্থিতিশীলতা আসেনি ইরাকে। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. আলী রিয়াজের মতে, ইরাক যুদ্ধে যারা উস্কানি দিয়েছিলেন, যারা মনে করেছিলেন যে, ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা করা দরকার, তারা ছিলেন ‘নিও কনজারভেটিভ’। ‘তাদের উত্থান হয়েছিল নব্বইয়ের দশক থেকে। তারা খুব জোরেশোরে চেষ্টা করছিলেন বিশ্বে নিজেদের একটা শক্তিমত্তা তুলে ধরার’ বলেন ড. রিয়াজ, যিনি বর্তমানে সুইডেনের ভ্যারাইটিস অব ডেমোক্রেসি ইনস্টিটিউটের ভিজিটিং প্রফেসর।

‘পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিকভাবে তারা এক অর্থে পরাজিত হয়েছে। তাদের আধিপত্য দেখানোর যে চিন্তাভাবনা, পরবর্তী পৃথিবীতে আর সেটা কাজ করেনি- না যুক্তরাষ্ট্রে, না বিশ্বে। পরবর্তী সময়ে তারা নীতিনির্ধারণের অনেক বাইরে চলে গেছেন’ তিনি বলেন।

গণবিধ্বংসী অস্ত্র থিউরি

ইরাক যুদ্ধের মাত্র দুই বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই নাইন-ইলেভেনের মুখোমুখি হতে হয় জর্জ ওয়াকার বুশ বা জর্জ ডব্লিউ বুশকে। সেই সময় মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে মিলে আফগানিস্তানে অভিযান চালিয়ে তালেবান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন বুশ। এর প্রায় দেড় বছরের মাথায় তিনি ইরাকে অভিযান শুরু করেন।

তার আগে ২০০২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বুশ প্রশাসন নতুন জাতীয় নিরাপত্তা নীতি ঘোষণা করে, যেখানে বলা হয় যে, জৈবিক, রাসায়নিক বা পারমাণবিক অস্ত্র, গণবিধ্বংসী অস্ত্রের অধিকারী কোনো সন্ত্রাসবাদী বা দুর্বৃত্ত দেশ দ্বারা যুক্তরাষ্ট্র যদি হুমকির মুখোমুখি হয়, তাহলে সেটা ঠেকানোর জন্য প্রয়োজনে সামরিক শক্তি ব্যবহার করবে। দুই মাস পরেই যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ নতুন একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে, যেখানে অস্ত্র পরিদর্শকদের ইরাকে ফিরে যাওয়ার সুযোগ রাখা হয়। কিছুদিন পরেই যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করে, নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবনা মানছে না ইরাক এবং তাদের ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র আছে। অবশেষে মার্চের ১৭ তারিখে সাদ্দাম হোসেনকে পরিবার নিয়ে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ইরাক ছাড়ার সময়সীমা বেঁধে দেন প্রেসিডেন্ট বুশ। ৪৮ ঘণ্টা পরেই শুরু হয় অপারেশন ইরাকি ফ্রিডম।

জর্জ ডব্লিউ বুশ

পরে ইরাকে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র না পাওয়া এবং ইরাক যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি হয়ে ওঠায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন প্রেসিডেন্ট বুশ।

ইরাক যুদ্ধ নিয়ে নানারকম বিতর্ক এবং সমালোচনা থাকার পরেও ডেমোক্রেটিক প্রার্থী জন কেরিকে হারিয়ে ২০০৪ সালের নির্বাচনে পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন বুশ।

তার মেয়াদ ২০০৯ সালে শেষ হওয়ার পর টেক্সাস অঙ্গরাজ্যে ফিরে যান বুশ। সেখানে তিনি জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রেসিডেন্সিয়াল লাইব্রেরি তৈরি করেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব ছাড়ার পর থেকে প্রকাশ্যে খুব একটা আসেন না বুশ।

টনি ব্লেয়ার

ইরাক যুদ্ধের সময় যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন স্যার অ্যান্টনি চার্লস লিনটন ব্লেয়ার, যিনি টনি ব্লেয়ার নামেই বেশি পরিচিত।

ইরাক যুদ্ধ নিয়ে পরে স্যার জন শিলকটের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘২০০২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর হাউজ অব কমন্সে টনি ব্লেয়ার ইরাকের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র তৈরির সক্ষমতার যে প্রতিবেদন তুলে ধরেন, সেখানে তাদের সম্ভাব্য হুমকি হিসাবে তুলে ধরা হয়। ভবিষ্যতের কোন একপর্যায়ে সেটা সত্যি হয়ে উঠতে পারে।’ শিলকট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শান্তিপূর্ণভাবে ইরাককে নিরস্ত্র করার পদক্ষেপ বিবেচনা না করেই ব্রিটেন ইরাকের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়েছে। তবে ওই প্রতিবেদনের সমালোচনা প্রত্যাখ্যান করে পরে টনি ব্লেয়ার একটি সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, কোনো অজুহাত না দিয়েই ইরাক যুদ্ধের পরিণতি তিনি মেনে নিয়েছেন।

যুদ্ধে কিছু ভুলের জন্য তিনি দুঃখ, অনুশোচনা ও ক্ষমা চাইলেও তিনি মনে করেন, সাদ্দাম হোসেনকে অপসারণ করার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। ইরাক যুদ্ধে সরকারের নীতি নিয়ে নানারকম সমালোচনার পরেও তার নেতৃত্বে ২০০৫ সালের মে মাসের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে লেবার পার্টি।

ডিক চেনি

বুশ প্রশাসনের জ্বালানি নীতি এবং মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণে মূল ভূমিকা রেখেছেন তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি।

আমেরিকান গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর ডিক চেনির সাবেক প্রতিষ্ঠান হ্যারিবার্টন ইরাক পুনর্গঠনের একাধিক লোভনীয় কাজ পায় আমেরিকান সরকারে কাছ থেকে। ড. আলী রিয়াজ বলছেন, ইরাক যুদ্ধের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের বিবেচনার অন্যতম একটা বিষয় ছিল তেল সম্পদের ওপর তাদের আধিপত্য তৈরি করা এবং মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিকভাবে এক ধরনের আধিপত্য তৈরি করা। ‘কিন্তু সেটা তো হয়নি, বরং উল্টোটা হয়েছে,’ তিনি বলছেন। ‘সাদ্দাম হোসেনের পতনের পরে ইরাকে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হলো, শিয়া-সুন্নিদের মধ্যে মতপার্থক্য, ইরানের প্রভাব বেড়ে যাওয়া, এই প্রভাবের বিষয়টি অনেকে ভাবতে পারেননি।’

‘ফলে আর্থিকভাবে যে ক্ষতি যুক্তরাষ্ট্রের হয়েছে, তার চেয়েও রাজনৈতিকভাবে তারা অনেক ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে,’ ড. রিয়াজ বলেন।

ডোনাল্ড হেনরি র‌্যামসফিল্ড

তিনি ছিলেন জর্জ ডব্লিউ বুশের প্রশাসনে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। ফলে পদের কারণেই আফগানিস্তান ও ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযানে তাকে প্রধান ভূমিকা রাখতে হয়েছে।

তার দপ্তর এমন তথ্য উপস্থাপন করেছিল যে, আল কায়দার সঙ্গে সাদ্দাম হোসেনের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। ফ্রান্স ও জার্মানি ইরাক যুদ্ধে বিরোধিতা করায় তাদের ‘ওল্ড ইউরোপ’ বলে বর্ণনা করেছিলেন র‌্যামসফিল্ড।

২০০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও নেটোর আটজন জেনারেল র‌্যামসফিল্ডকে সামরিক পরিকল্পনা ও কৌশলের বিষয়ে অদক্ষ দাবি করে তার পদত্যাগের দাবি জানান। নভেম্বরেই পদত্যাগ করেন র‌্যামসফিল্ড। এরপর হেনরি র‌্যামসফিল্ড বেশ কয়েকটি কোম্পানির প্রধান নির্বাহী ও চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বেশ কয়েকটি বইও লিখেছেন। অবসর জীবন কাটানোর সময় ২০২১ সালে তিনি মারা যান।

পল উলফোভিৎস

ইরাকে অভিযান শুরুর আগে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র সংক্রান্ত দাবি তৈরির পক্ষে জোরালো ভূমিকা রেখেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী পল উলফোভিৎস।

তার নেতৃত্বে আট থেকে নয়জন বিশ্লেষকের সমন্বয়ে ‘অফিস অব স্পেশাল প্ল্যানস’ নামে একটি বিশেষ সেল তৈরি করা হয়, যাদের কাজ ছিল সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে আল কায়দার যোগাযোগের সূত্র খুঁজে বের করা। কয়েক মাস ধরে গবেষণার পর এই সেলটি বিভিন্ন গোয়েন্দা তথ্যের বরাত দিয়ে ইরাকে সম্ভাব্য বিধ্বংসী অস্ত্র থাকার তথ্য নিয়ে হাজির হয়।

আহমেদ শালাবি

আহমেদ আবদেল হাবি শালাবি ইরাকি একজন রাজনীতিক, যিনি সে দেশের ইরাকি ন্যাশনাল কংগ্রেস দল প্রতিষ্ঠা করেছেন।

সাদ্দাম হোসেন ক্ষমতায় থাকার সময় যুক্তরাষ্ট্রে থাকতেন শালাবি। সেই সময় বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়।

যে সূত্রের বরাত দিয়ে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্রের দাবি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য, সেটি শালাবির দলের একজনের কাছ থেকে পাওয়া বলে ধারণা করা হয়। সেই সূত্র দাবি করেছিল যে, তিনি এমন একটি রাসায়নিক ল্যাবে কাজ করতেন, যেখানে অস্ত্র বানানো হতে পারে।

মার্কিন বাহিনী ২০০৩ সালে ইরাকের দখল নেয়ার পর তাদের সঙ্গেই আহমেদ শালাবি ইরাকে প্রবেশ করেন। এরপর ইরাকের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন শালাবি। যদিও পরবর্তী সময়ে পেন্টাগনের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি হয়। পরে তিনি ইরাকের সরকারের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।

* বিবিসি বাংলা অবলম্বনে

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত