যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আগ্রাসনের ২০ বছর পর ইরাক যুদ্ধ মার্কিন প্রশাসন ও অনেক আমেরিকানের কাছে বিবর্ণ স্মৃতিতে পরিণত হয়েছে। এই সংঘাতে নিহত বা বাস্তুচ্যুত হওয়া লাখ লাখ ইরাকির পাশাপাশি, ইরাকে হাজার হাজার আমেরিকান মারা গেছে বা আহত হয়েছিল। ইরাকিদের জন্য এই যুদ্ধের পরিণতি এখনও তাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অনিবার্য অংশ। কিন্তু ক্ষোভ ও পাপবোধ মার্কিন সেনাদের একটি অংশকেও প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়ায়। যতদিন তারা বেঁচে থাকবেন, ততদিন তা ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
টিম ম্যাকলাফলিন ইরাকে মেরিন সেনাদের একটি অংশের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যেটি ইরাকে মার্কিন আক্রমণের প্রথম দিকের কিছু যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। অনেক প্রাক্তন সৈনিকের মতোই এই অভিজ্ঞতা তাকে যুদ্ধের পরের বছরগুলোতে পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (পিটিএসডি) রোগ বা আঘাত পরবর্তী মানসিক সংকট এবং যুদ্ধ সম্পর্কে বিরোধপূর্ণ নীতিগত অনুভূতির সামনে দাঁড় করিয়েছে। ম্যাকলাফলিন ইরাকে তার অভিজ্ঞতা, আক্রমণের প্রথম দিকের সহিংসতা ও সন্ত্রাসের ঘটনাগুলো নথিভুক্ত করে তার ডায়েরি প্রকাশ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্র যে প্রাথমিক দাবিটিতে যুদ্ধ শুরু করেছিল, তা ছিল ইরাক ওয়েপন্স অব ম্যাস ডেস্ট্রাকশন বা মহাবিধ্বংসী অস্ত্র মজুত করেছিল এবং যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের জন্য একটি আসন্ন হুমকি তৈরি করেছিল। সংঘর্ষের শুরুতেই তা অসত্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরাকিদের তখন যে অভিজ্ঞতার বাকি ছিল, তা ছিল একটি ধীর, অপ্রতিরোধ্য সামরিক আগ্রাসন এবং বিদ্রোহ, যা ধীরে ধীরে একটি গৃহযুদ্ধে রূপান্তরিত হয়েছিল এবং লাখ লাখ লোককে হত্যা, আহত বা বাস্তুচ্যুত করেছিল। সহিংসতার শেষে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন এবং তার পরিবার শেষ হয়ে গেছে। এখন ইরাকে জীবন অনেকের জন্য কঠিন হয়ে গেছে, যাদের যুদ্ধের পরের পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়েছে। ম্যাকলাফলিন বলেন, ‘আমি ইরাক আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিইনি। আমার শুধু এটি চাকরি ছিল। আমি হতাশ হই, সেই লোকেদের ওপর, যারা এটি করার পথ বেছে নিয়েছিল। ইরাকের মানুষ শুধু তাদের জীবনযাপন করছিল। যারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তাদের প্রতি আমি হতাশ। অর্থাৎ, আপনারা আমাদের ভুল দেশ আক্রমণ করতে পাঠিয়েছিলেন।’
অনেক আমেরিকান যারা ১১ সেপ্টেম্বরের পর জাতীয় কর্তব্যের অনুভূতি থেকে সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল, তারা নিজেদের এমন লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে হত্যা করতে ও মৃত্যু বরণ করতে দেখেছিল, যাদের ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না। যুদ্ধে কয়েক লাখ ইরাকি নিহত হওয়ার পাশাপাশি, অনুমান করা হয় যে, ইরাকে প্রায় ৪ হাজার ৫০০ মার্কিন সেনা মারা গিয়েছিল এবং হাজার হাজার আহত হয়েছিল। যুদ্ধাহত সেনাদের প্রায়ই দীর্ঘমেয়াদি যত্নের প্রয়োজন হয় এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা অসম্ভব হয়ে পড়ে। মার্কিন সরকারের কাছ থেকে তারা যে সাহায্যই পাক না কেন, ইরাকে তারা যে মানসিকভাবে বিপর্যয়কর যুদ্ধকালীন আঘাতের শিকার হয়েছিল, তা এমনকি সর্বোচ্চ চিকিৎসা সেবা দিয়েও নিরাময় করা সম্ভব নয়। তাই ইরাক যুদ্ধ সাধারণ আমেরিকানদের স্মৃতি থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেও, যারা সরাসরি এটি অবলোকন করেছেন, তাদের কাছে এই মানসিক আঘাত এবং শারীরিক ক্ষতগুলো ইরাক যুদ্ধের উত্তরাধিকার রূপে প্রতিদিনের অনুস্মারক।
মার্কিন বিমান বাহিনীর প্রাক্তন কর্মকর্তা ডেনিস ফ্রিটজ বলেন, ‘আমাদের কাছে এমন লোক রয়েছে, যারা ক্ষত ভোগ করছে, যার অর্থ তাদের জন্য বাকি জীবন নরকে পরিণত হয়েছে। এদিকে, আমরা এখন জানি, ইরাক আমাদের জন্য কোনো হুমকি ছিল না। আমি আজ অবধি এটি নিয়ে বিচলিত, কারণ আমাদের পরিষেবা সদস্যদের খেলার পুতুল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। ইরাক যুদ্ধের জন্য দায়ীদের অনেকেই ওয়াশিংটনে জ্যেষ্ঠ নীতিনির্ধারক হিসেবে পুরস্কৃত ক্যারিয়ার উপভোগ করেছেন বা সরকারে থাকাকালীন তাদের ভূমিকার কল্যাণে বেসরকারি খাতে ভাল বেতনের অর্থ উপার্জন করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি দু’জন লোককে চিনি, যারা যুদ্ধের সময় কর্মকর্তা ছিলেন এবং এই মুহূর্তে পিটিএসডি-তে আক্রান্ত হয়ে কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন এবং তাদের সৈন্যদের প্রাণ হারানোর কারণে তারা অপরাধবোধে ভুগছেন। কিন্তু তাদের কারণে যে তারা মারা গেছে তা তো নয়; এটা সেই রাজনৈতিক নেতাদের কারণে ঘটেছে, যারা তাদের মিথ্যার ওপর ভিত্তি করে যুদ্ধে পাঠিয়েছে। তাদের বরং পিটিএসডি হওয়া উচিত; কিন্তু তাদের হয় না। তারা কেবল বই লিখে এবং লাভজনক চাকরি পেয়ে জীবন কাটায়।
* সূত্র : দ্য ইন্টারসেপ্ট