সৌদি-ইরান সমঝোতা ও নানা প্রাসঙ্গিকতা

অধ্যাপক শাব্বির আহমদ

প্রকাশ : ১১ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মঞ্চে চীন কতটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারছে, সে প্রশ্ন সব সময় ছিল। কিন্তু সৌদি-ইরানের বৈরিতা দূর করে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের লক্ষ্যে চীনের মধ্যস্থাতায় গত ১০ মার্চ তেহরান-রিয়াদের মধ্যে ঐতিহাসিক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের পর চীনের গঠনমূলক ভূমিকা নজর কেড়েছে সারা বিশ্বের। চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয় বেইজিংয়ে। সৌদি আরবের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মুসাইদ আল আইবান ও ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সচিব আলি শামকাহনির মধ্যে এ সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তাদের মাঝে বসে মধ্যস্থতা করেন চীনের শীর্ষ কূটনৈতিক ওয়াং ই। এ সমঝোতায় মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘদিনের ‘বড় ভাই’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা ছিল না। পুরো আলোচনা হয়েছে আরবি, ফারসি ও চীনা ভাষায়; ইংরেজির স্থান ছিল না সেখানে। এ আশাতীত কাজটা হয়েছে এমন এক সময়, যখন সারা বিশ্ব একটা উত্তেজনাপূর্ণ সময় পার করছে।

সৌদি আরব ও ইরান প্রতিবেশী হলেও তাদের মধ্যে সদ্ভাব নেই। আছে নানান বিরোধ। এ বিরোধের মূলে আছে ধর্ম, রাজনীতি, আঞ্চলিক আধিপত্য, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের মতো বিষয়। এসব বিষয় নিয়ে দেশ দুটির মধ্যে দশকের পর দশক ধরে চলছে টানাপোড়েন। বিরোধ এতটাই প্রকট যে, তা শুধু সৌদি আরব ও ইরানের গণ্ডির মধ্যে আটকে না থেকে মধ্যপ্রাচ্য ছাপিয়ে বিরোধের ছায়া পড়েছে পুরো মুসলিম বিশ্বে। ফলে মুসলিম বিশ্বে তৈরি হয় রিয়াদপন্থি ও তেহরানপন্থি ধারা। ইরানের সঙ্গে সৌদি আরবের বৈরিতা শুরু হয় ১৯৭৯ সালে খোমেনির নেতৃত্বে পশ্চিমাবিরোধী ইসলামি বিপ্লবের পর। সৌদি আরব ইরানের এই বিপ্লবকে শিয়া মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন হিসেবে আখ্যায়িত করে। ইরান উপসাগরীয় অঞ্চলে সৌদি আরবকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘চর’ হিসেবে অভিহিত করে। আর এ বৈরিতা শত্রুতায় রূপ নেয় ১৯৮০-১৯৮৮ সালে, ইরাক-ইরান যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। ২০১৬ সালে শিয়া মুসলিম ধর্মগুরু নিমর আল নিমরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করলে বিক্ষুব্ধ ইরানিরা তেহরানে সৌদি আরবের দূতাবাসে হামলা চালায়। তারপর সৌদি আরব ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয় সম্পূর্ণভাবে। সেই থেকে সুন্নি ও শিয়া নেতৃত্বাধীন দুই প্রতিবেশীর মধ্যে উত্তেজনা নিত্যদিনকার ব্যাপার হয়ে ওঠে। ইয়েমেন এবং লেবাননের বিভিন্ন উপদলকে ইরান ও সৌদি আরব সমর্থন করায় দেশ দু’টিতে রাজনৈতিক সংকট তীব্র হয়ে ওঠে। সম্পর্কটা আরও খারাপ হয় ২০১৯ সালে, যখন সৌদির প্রধান তেল স্থাপনা আরামকোতে ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়। সৌদি আরব এবং তার মার্কিন মিত্ররা হামলার জন্য ইরানকেই দায়ী করে। যদিও ইরান তা অস্বীকার করে।

ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে ইসরাইলের মতো সৌদি আরবও নিজের জন্য চরম হুমকি বিবেচনা করে। এই ইস্যুতে ইরানকে চরমভাবে শায়েস্তা করতে রিয়াদ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে। ২০১৮ সালের মে মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত পরমাণু চুক্তি থেকে সরে দাঁড়ানোর পেছনে ইসরাইলের পাশাপাশি সৌদি আরবও পর্দার অন্তরালে ভূমিকা রেখেছিল বলে মনে করা হয়। ওই সময়ে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে অকস্মাৎ হামলা চালিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছিল ইহুদিবাদী ইসরাইলের তৎকালীন এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ইরানকে শায়েস্তা করার বিনিময়ে ট্রাম্প ইসরাইলের সঙ্গে সৌদি আরব ও তার আরব মিত্রদের কূটনীতিক সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আরব-আমিরাত, বাহরাইন ওই পথে পা দিলেও রিয়াদ আগপাছ ভেবে পিছুটান দেয়। ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর একদিকে সৌদি আরবের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শীতল সম্পর্ক তৈরি হয়, অন্যদিকে আঞ্চলিক লড়াইয়ে নানান ফ্রন্টে ইরানের সাফল্য দেখে বিচলিত হয়ে ওঠে সৌদি আরব। যে ইরাক একসময় ইরানের শক্ত প্রতিপক্ষ ছিল, সে ইরাক বর্তমানে তেহরানের দলে ভিড়েছে। লেবাননে ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহ সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী। ইরান সমর্থিত সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ অনেকটাই টিকে গেছেন। ইয়েমেন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ইরান সমর্থিত শিয়াপন্থি হুতি বিদ্রোহীরা। সৌদি আরব মরিয়া হয়েও ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে হন্য হয়ে শান্তির পথ খুঁজতে থাকে। অন্যদিকে ইরানও মধ্যপ্রাচ্য থেকে মার্কিন-ইসরায়েলি আধিপত্যের অবসান ঘটাতে সৌদি আরবের সঙ্গে বিরোধ মেটাতে উদগ্রীব হয়ে ওঠে। এমন সময়ে চীন মধ্যপ্রাচ্যের চির বৈরী দেশ দুটির মাঝে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে এগিয়ে আসে। এ ক্ষেত্রে চীন দেখিয়েছে দারুণ সফলতা। এতে অবশ্য চীনের অন্য একটা লাভও আছে। কারণ, চীন তেল সংগ্রহ করে দু’দেশ থেকে। চীন ২০১০ সাল থেকে ইরানের শীর্ষ বাণিজ্যক অংশীদার। এটা ছিল এমন একটা সময়, যখন ইরান তার পারমাণবিক কর্মকাণ্ডের কারণে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বহুপক্ষীয় অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা নিয়ে টিকে থাকার লড়াই করছিল। অন্যদিকে সৌদি-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক এখন চলছে খুবই ধীরগতিতে। আগের সে ঊষ্ণতা আর নেই। পক্ষান্তরে বর্তমানে গোটা মধ্যপ্রাচ্যেই চীনের প্রভাব আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। এ অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে বেইজিং দারুণ কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। বর্তমানে চীন সৌদি আরব থেকে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল আমদানি করছে। বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছে সৌদি আরবের বিভিন্ন খাতে।

সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যকার কূটনীতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বাগত জানালেও আন্তর্জাতিক কূটনীতির বরপুত্র হেনরি কিসিঞ্জারের মতে, ‘ইরান-সৌদি সমঝোতা চুক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের জন্য অনেক কিছু জটিল করে দিয়েছে। কারণ, চুক্তিটি বিশ্ব ব্যবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের মধ্যস্থতায় হয়েছে।’ কিসিঞ্জারের মতে, ‘চুক্তি সইয়ের আগে ইসরাইল যেভাবে ইরানের ওপর চাপ সৃষ্টি আরম্ভ করত, এখন তা আর পারবে না। তেল আবিব যদি ইরানের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চায়, তাহলে এখন থেকে ইসরাইলকে মধ্যপ্রাচ্যে চীনের স্বার্থ বিবেচনায় রাখতে হবে।’

আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকের মতে, চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি-ইরান চুক্তি, সর্বোপরি চীনের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের দহরম-মহরম সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়ার জন্যও কিছু বার্তা বহন করে। পাকিস্তান চীনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সৌদি আরবের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক বহুমাত্রিক। চীনের প্রভাব মধ্যপ্রাচ্যে বাড়লে পাকিস্তান কিছু সুবিধা অবশ্যই ভোগ করবে।

সুতরাং ভারতের শঙ্কিত হওয়া স্বাভাবিক। কারণ, জ্বালানি আমদানির জন্য ইরানের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল ভারত। অবশ্য দিল্লিতে নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূত এরই মধ্যে বিবৃতি দিয়ে ভারতকে আশ্বস্ত করেছেন, চীনের মধ্যস্থতায় চুক্তি হওয়া মানেই সেটা ভারতের জন্য কোনো দুঃসংবাদ নয়। তবে বাংলাদেশের জন্য এ চুক্তির প্রকৃত বাস্তবায়ন অনেক সুবিধা বয়ে আনবে বলে মনে করা হচ্ছে। সৌদি-ইরানের মধ্যে এ মধ্যস্থতায় সহায়ক ভূমিকার জন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এরই মধ্যে চীন, ইরাক এবং ওমানের প্রশংসা করেছেন। সৌদি আরব, ইরান ও চীন- এ তিন দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের সুসম্পর্ক বিদ্যমান। মধ্যপ্রাচ্য বাংলাদেশের প্রবাসী কর্মচারীদের আবাসস্থল। এ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হলে বাংলাদেশের অনেক সুবিধা। যেসব দেশে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কারণে কর্মসংস্থান বিঘিœত, সেসব দেশেও শান্তি বিরাজ করলে পুনরায় কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা দেখা দেবে।

লেখক : আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক ও গবেষক