পশ্চিমাদের মাথা ব্যথার কারণ ইমরান-এরদোয়ান

মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ পাকিস্তান ও তুরস্ক। দেশ দুটির শক্তিশালী সেনাবাহিনী ও রাজনীতির ময়দানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। ১৯৫০-এর দশক থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং পাকিস্তান ঘনিষ্ঠ মিত্র। সেনা নিয়ন্ত্রিত পাকিস্তানের অর্থনীতি এবং নিরাপত্তায় দু’হাতে টাকা দিয়েছে আমেরিকা। পাকিস্তানও প্রতিদান দিয়েছে। তুরস্ক মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোরও গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। ন্যাটো বাহিনীতে সংখ্যাধিক্যের দিক দিয়ে আমেরিকার পর তুরস্কের স্থান। তুর্কি সেনাবাহিনী মার্কিন সেনাবাহিনীর আদলে গড়া এবং সুপ্রশিক্ষিত। তুরস্ক ও পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেব এরদোয়ান এবং পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী (বর্তমানে প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা) ইমরান খান আমেরিকার প্রধান প্রতিপক্ষ। তাদের থামিয়ে দিতে আমেরিকাসহ পশ্চিমা দুনিয়া ও তাদের তাঁবেদার দেশীয় সামরিক- বেসামরিক শক্তি দীর্ঘদিনের ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতা নিয়েই আজকের প্রয়াস। লিখেছেন- অধ্যাপক শাব্বির আহমদ

প্রকাশ : ২৩ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

পাকিস্তান ও ইমরান খান

বেশ কিছুদিন ধরে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে মঞ্চস্থ হচ্ছে জমজমাট নাটক। কখনও সেনা সমর্থিত পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট ‘পিডিএম’-এর সরকারের দাপট, কখনও বিরোধী নেতা ইমরান খানের; আবার কখনও সুপ্রিম কোর্টের। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক মঞ্চে আবার সেনাবাহিনী এসে পড়ে কি-না, সেই গুজবও। প্রচলিত আছে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর নেতা। সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর নেতা হচ্ছেন সেনাপ্রধান। বলা হয়ে থাকে, পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি আর প্রতিরক্ষানীতি ঠিক হয় সেনা সদরদপ্তরে। সেখানে বেসামরিক প্রধানমন্ত্রীর কোনো এখতিয়ার নেই। যখনই পাকিস্তানে কোনো বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় থেকেছে, সেটা যে রাজনৈতিক দলেরই হোক, তাদের একটা আপস বা সমঝোতা করতে হয়েছে সেনাবাহিনীর সঙ্গে। রাজনীতিতে দেশটির সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের অভিযোগ বলতে গেলে এর জন্মলগ্ন থেকেই। ৭৫ বছরের ইতিহাসে দেশটির ক্ষমতা ৩৪ বছরই কুক্ষিগত করে রাখেন সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্তারা। যখন তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল না, তখনও তাদের প্রাধান্য ছিল সব কিছুতে। পাকিস্তান রাষ্ট্রে সেনাবাহিনীর অবস্থান এমনই শক্তিশালী, কোনো রাজনৈতিক দলই তাদের সঙ্গে আপস না করে টিকে থাকতে পারে না। তাদের কারণে এ পর্যন্ত দেশটির কোনো প্রধানমন্ত্রী পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। ২০১৮ সালে তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)-এর চেয়ারম্যান ইমরান খানের বিজয়ের পেছনে সেনাবাহিনী পর্দার অন্তরালে কলকাঠি নেড়েছিল বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু ক্ষমতায় এসে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন, মার্কিননীতিতে পরিবর্তন, রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা যুক্তরাষ্ট্রকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব সুদূরপ্রসারীর কথা। ১৯৫০-এর দশক থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং পাকিস্তান ঘনিষ্ঠ মিত্র। সেনা নিয়ন্ত্রিত পাকিস্তানের অর্থনীতি এবং নিরাপত্তায় দু’হাতে টাকা দিয়েছে আমেরিকা। পাকিস্তান সেনারা প্রতিদানও দিয়েছে প্রচুর। ইমরান আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর পাকিস্তানে মার্কিন সেনা ঘাঁটি গাড়তে দিতে রাজি হননি, আফগানিস্তানে ন্যাটোর সাপ্লাই লাইন ব্লক করে দিয়েছিলেন, তালেবানরা ক্ষমতা গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে ইরমান বলেছিলেন, তালেবানরা দাসত্বের শিকল ভেঙে দিয়েছে। ইমরান পাকিস্তানের বাইরেও মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম বিশ্বে আমেরিকার দ্বিচারিতা, অযাচিত হস্তক্ষেপের কট্টর সমালোচক ছিলেন। ইমরান পাকিস্তানের ইতিহাসে দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী, যিনি পাকিস্তানের রাজনীতিতে মার্কিন হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে চেয়েছেন। সত্তরের দশকে জুলফিকার আলী ভুট্টো একই কাজ করেছিলেন, ইসলামাবাদে আমেরিকার এক বার্তা জনতার সমাবেশে ছিঁড়ে ফেলেছিলেন। ২০২২ সালের ১০ এপ্রিল অনাস্থা ভোটে প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে ইমরান খান অপসারিত হলে প্রধানমন্ত্রী হন পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম)-এর প্রধান শাহবাজ শরিফ।

গত বছর ২৮ অক্টোবর লাহোরের লিবার্টি চক থেকে রাজধানী ইসলামাবাদের অভিমুখে লংমার্চ চলাকালীন গুলিবিদ্ধ হন ইমরান। এ হত্যা প্রচেষ্টার জন্য সেনা নিয়ন্ত্রিত গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স ‘আইএসআই’কে দায়ী করলে প্রকাশ্য রূপ নেয় ইমরান সেনা বিরোধ। গত ৬ মে লাহোরে একটি সমাবেশে ভাষণ দেয়ার সময় কিছুটা দুঃসাহসী কাজ করে বসেন ইমরান। ভাষণে তিনি ‘আইএসআই’-এর কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল ফয়সাল নাসিরের বিরুদ্ধে তাকে দু’বার হত্যা চেষ্টার অভিযোগ তোলেন। এর আগেও তিনি বিভিন্ন বক্তৃতায় জেনারেলকে ইঙ্গিত করে অভিযোগ তুলেছিলেন; কিন্তু এবারই প্রথম প্রকাশ্যে নাম উল্লেখ করেন। এর পরই তার বিরুদ্ধে বিবৃতি দেয় দেশটির সেনাবাহিনী। বিবৃতিতে সামরিক বাহিনী ইমরান খানকে এসব অভিযোগের বিষয়ে আইনি উপায়ে আশ্রয় নিতে এবং মিথ্যা অভিযোগ বন্ধ করার আহ্বানের পাশাপাশি ‘মিথ্যা এবং অপপ্রচার’-এর বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী আইনি ব্যবস্থা নেয়ার অধিকারও সংরক্ষণ করে বলে উল্লেখ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ সেনাবাহিনী এবং আইএসআইকে ‘অপমান’ করা হয়েছে উল্লেখ করে নিন্দা জানিয়ে প্রকারান্তে সেনাবাহিনীকে আরও উস্কে দেন। সেনাবাহিনীর বিবৃতির পর গত ৫ মে তাকে হত্যা করা হতে পারে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করে বিবৃতি দেন। তার তিন দিন পর আল কাদির ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় হাজিরা দিতে গেলে ইসলামাবাদ হাইকোর্ট ইমরানকে জেলে প্রেরণ এবং ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। সামরিক বাহিনীর বিবৃতি ও শাহবাজ শরিফের উস্কানির পর রেঞ্জার্স বাহিনীর হাতে কমান্ডো স্টাইলে ইমরান খান গ্রেপ্তারের ঘটনায় সামরিক বাহিনীর সরাসরি যোগসাজশ খুঁজে পায় সমর্থকরা। ইমরান খানের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ৯ মে ২০২৩ পাকিস্তানজুড়ে এক নজিরবিহীন তাণ্ডব দেখল বিশ্ববাসী। ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের পরপরই রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের সেনা সদর দপ্তর, লাহোরে সেনাবাহিনীর কর্পস কমান্ডারের বাসভবনসহ দেশব্যাপী ক্যান্টনমেন্টগুলো এবং রেডিও পাকিস্তান ভবনের মতো স্পর্শকাতর স্থানেও নজিরবিহীন হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। অতীতে যতবারই কোনো না কোনো সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত কিংবা বন্দি করা হয়েছে, ততবারই সেনাবাহিনীর সমর্থনে জনগণের একটি অংশকে রাজপথে আনন্দণ্ডউল্লাস করতে দেখা গেছে। কিন্তু ইমরানের বেলায় দেখা গেল সম্পূর্ণ ভিন্নচিত্র। সেনাবাহিনীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে জনগণ। জনতার তীব্র রোষের শিকার হয় পাক আর্মি। অনেকেই ধারণা করছেন, এবার হয়তো দফারফা হতে পারে পাকিস্তান রাজনীতিতে বারবার সেনা হস্তক্ষেপের বিষয়টি। নতুবা আবার সেনা কবলে পড়তে পারে দেশটি।

২৩ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত পারমাণবিক শক্তিধর পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের ২০২৩ সালের তথ্যমতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর অবস্থান বিশ্বে দশম। এমন প্রতাপশালী সেনাবাহিনীর মুখোমুখি ইমরান খানের রাজনৈতিক গন্তব্য ঠিক কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে, এ মুহূর্তে বলা মুশকিল। টালমাটাল পরিস্থিতিতে দেশটিতে ফের সেনাশাসনের গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। যদিও পাকিস্তান সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির এরই মধ্যে সেনা হস্তক্ষেপের বিষয়টি উড়িয়ে দিয়েছেন। তবে এটা ঠিক, অতীতে অনেক পাকিস্তান সেনাপ্রধান এমন বিবৃতি দিয়েও ঠিকই কুৎসা রটিয়েছে। অনেক বিশ্লেষক আশঙ্কা করছেন, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ইমরান খান কোনো প্রকার রাখঢাক না রেখে আমেরিকা, বিশেষ করে সামরিক কর্মকর্তাদের উদ্দেশে যেভাবে একের পর এক বক্তব্য-বিবৃতি দিচ্ছেন, তাতে মনে হচ্ছে ইমরান খানেরও পরিণতি হতে পারে ভুট্টোর মতো।

তুরস্ক ও এরদোয়ান

হাজার দ্বীপে ঘেরা সুসজ্জিত ওসমানি খেলাফতের উত্তরাধিকার তুরস্ক ভূখণ্ড। ২০০৩ সাল থেকে দেশটির নেতৃত্বদানকারী এরদোয়ানকে বেশিরভাগ তুর্কি আতাতুর্কের পর সবচেয়ে ক্যারিশম্যাটিক নেতা বলে গণ্য করেন। তুরস্কের পল্লীর মানুষ, সুন্নি মুসলমান ও জাতীয়তাবাদীরা হলেন তার মূল সমর্থক। তিনি তুরস্ককে সেক্যুলারিজমের নিগঢ় থেকে তুলে নতুন করে ইসলামি ধারায় নিয়ে এসেছেন। এরদোয়ান ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তুরস্কের সামরিক শক্তিকে সংহত করার চেষ্টা শুরু করেন। গত এক দশকে তুরস্কের সামরিক ব্যয় ৮৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তার ইস্পাত-দৃঢ় নেতৃত্বে তুরস্ক বর্তমান বিশ্বে শীর্ষস্থানীয় ১০টি সমরাস্ত্র বিক্রেতা দেশের অন্যতম। তুরস্কের সমরাস্ত্র ভান্ডারে তৈরি হচ্ছে অত্যাধুনিক যত অস্ত্র। এসব অস্ত্রের সফল প্রয়োগ ও অপারেশন কৌশল দেখে তাবৎ বিশ্ব আজ বিস্ময়ান্বিত। তিনি তুরস্ককে বিশ্বের মানচিত্রে একটি নেতৃস্থানীয় ও মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে এনে দাঁড় করিয়েছেন। তুরস্ক মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়েও মার্কিন প্রভাবলয় থেকে বের করে এনে কামাল আতাতুর্কের ইসলামবিদ্বেষী আধুনিক ও ধর্মনিরপেক্ষ জাতিরাষ্ট্রের নীতি থেকে তুরস্ককে ইসলামি ভাবধারার একটি রাষ্ট্রে পরিণত করেন এরদোয়ান। এরদোয়ান শুধু তুরস্কে নয়, বরং মুসলিম বিশ্বের একজন প্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে বারবার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে গেছেন। সমকালীন মুসলিম বিশ্বে এরদোয়ানকে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা হিসেবে মনে করা হয়। কাশ্মীর ইস্যু, ফিলিস্তিন ইস্যু এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে তিনি অন্য যে কোনো মুসলিম নেতার চেয়ে বেশি সোচ্চার। আমেরিকা, রাশিয়া, ফ্রান্সের মতো দেশের নাকের ডগায় তিনি সিরিয়া, লিবিয়া এবং আজারবাইজানে যে দুঃসাহসিকতা দেখিয়েছেন, ওসমানীয় খেলাফতের পতনের পর মুসলিম বিশ্ব আর দেখেনি। বিভিন্ন সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের প্রতি সরাসরি করা বিরোধিতা এরদোয়ানকে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কর্তৃক জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতির পর এরদোয়ান বলেছিলেন, এখন যদি আল-আকসা মসজিদ রক্ষা করা না যায়, তাহলে ভবিষ্যতে তারা পবিত্র কাবাকেও লক্ষ্যবস্তু বানাবে। জেরুজালেম আমাদের জন্য সতর্কবার্তা। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুকে একটি সন্ত্রাসী দেশের নেতা এবং গাজা অঞ্চলকে উন্মুক্ত কারাগার হিসেবে উল্লেখ করে বিবৃতি দিয়েছিলেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে অনেক আগ থেকেই তুরস্কের রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করতে বদ্ধপরিকর হয়ে মাঠে নামে আমেরিকাণ্ডইসরায়েলসহ পশ্চিমা বিশ্ব। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বরাজনীতিতে তারা এরদোয়ানকে শুধু তাদের প্রতিপক্ষই মনে করে না; তাদের অভিযোগ, এরদোয়ান যুক্তরাষ্ট্রের একাধিপত্য, ইউরোপের নিরাপত্তা ও বাজারব্যবস্থা বিপর্যস্ত করার মূল কারিগর। পশ্চিমাদের অভিযোগ, এরদোয়ান তুরস্ক থেকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নস্যাৎ করে ইসলামি ভাবধারার এক শ্রেণির স্বৈরাচারী, একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছেন। এরদোয়ানকে ক্ষমতাচ্যুত ও হত্যা করতে ২০১৬ সালের ১৫ জুলাইয়ে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে আমেরিকা ও পশ্চিমা মিত্রদের ইন্ধন ছিল ওপেন সিক্রেট। এরদোয়ানকে কোনোভাবে বাগে আনতে না পেরে মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেয় ১৪ মে ২০২৩ অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট ও সংসদ নির্বাচনকে। বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টিকারী এ নির্বাচনে শুধু এরদোয়ানকে ক্ষমতা থেকে সরাতেই তৎপর হয়ে ওঠেনি; একই সঙ্গে তুরস্ককে পশ্চিমাদের তাঁবেদারে পরিণত করার নতুন ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেব এরদোয়ানের ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি)-এর নেতৃত্বাধীন পিপলস অ্যালায়েন্সের বিরুদ্ধে কামাল আতাতুর্কপন্থি কামাল কিলিকদারোগ্লুর রিপাবলিকান পিপলস পার্টি (সিএইচপি)-এর নেতৃত্বাধীন জোট নেশন অ্যালায়েন্সেকে মাঠে নামিয়ে দেয়। এরদোয়ানের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক তথ্য সন্ত্রাসের পাশাপাশি প্রকাশ করতে থাকে একের পর এক জনমত জরিপ। তাদের সব জনমত জরিপে কামাল কিলিকদারোগ্লুকে এগিয়ে রেখে এরদোয়ান সমর্থকদের ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। কিন্তু সব জনমত জরিপ ও প্রোপাগান্ডাকে অসার প্রমাণিত করে ১৪ মে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে এরদোয়ান সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে এবং পার্লামেন্টে তার জোট সর্বোচ্চ সংখ্যক আসন লাভ করে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এরদোয়ান পেয়েছেন ৪৯.৫০ শতাংশ, কামাল কিলিচদারোগ্লু পেয়েছেন ৪৪.৮৯ শতাংশ, সিনান ওগান ৫.১৭ শতাংশ এবং মুহাররেম ইনজে পেয়েছেন ০.৪৪ শতাংশ ভোট। এ নির্বাচনে মোট ভোট পড়েছে ৮৮.৯২ শতাংশ। নির্বাচনের এ ফলাফলে দেখা যায়, এরদোয়ান তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে ২৫ লাখ ভোট বেশি পেয়েছেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার জন্য যে ৫০ শতাংশ ভোট পাওয়া দরকার, সেটি পাননি। অন্য কোনো প্রার্থীও এই ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পাওয়ার কারণে সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া দুই প্রার্থীর মধ্যে আবার নির্বাচন হবে। সেখানে প্রার্থী থাকবেন এরদোয়ান এবং কামাল কিলিচদারোগ্লু। আগামী ২৮ মে অনুষ্ঠিত হবে সেই নির্বাচন। ওই নির্বাচনে এরদোয়ানের বিজয়ের সম্ভাবনা খুবই বেশি। তুরস্কের পার্লামেন্টের ৬০০ এমপি পদের নির্বাচনে ৩২৩টি আসন পেয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে এরদোয়ানের দল একে পার্টির নেতৃত্বাধীন পিপলস অ্যালায়েন্স।

লেখক : শিক্ষক, কলামিস্ট ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক