এক দশকেরও বেশি সময় আগে সিরিয়ায় ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। একনায়ক বাশার আল আসাদ এ যুদ্ধের শুরু থেকে ইসলামপন্থিসহ বিভিন্ন বিদ্রোহী গ্রুপ ও সুশীল সমাজকে ধ্বংস করতে ‘পোড়ামাটি নীতি’ গ্রহণ করেন। তার বিরুদ্ধে এর বিরোধিতায় অন্যান্য আরব দেশগুলো গোপনে সমর্থন জোগায় এবং এক পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট আসাদ আরব বিশ্বের সমাজচ্যুত নেতায় পরিণত হন।
বিরোধীদের ওপর নিষ্ঠুর দমন-পীড়নের দায়ে আরব লীগ থেকে সিরিয়াকে বহিষ্কার করা হয় ২০১১ সালে। কিন্তু এখন এই দৃশ্যপট আমূল বদলে গেছে। প্রেসিডেন্ট আসাদের প্রতিবেশী দেশগুলো তাকে আবার বরণ করে নিচ্ছে। আরব দেশগুলোর জোট আরব লীগে প্রত্যাবর্তন ঘটেছে সিরিয়ার। এ ঘটনাকে দেখা হচ্ছে প্রেসিডেন্ট আসাদের আন্তর্জাতিক পুনর্বাসন হিসেবে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের এ ফিরে আসা কীভাবে সম্ভব হলো এবং তার এ প্রত্যাবর্তন সিরিয়া, দেশের জনগণ, শরণার্থী এবং গোটা ওই অঞ্চলের জন্য কী অর্থ বহন করে? বিবিসির আরবি বিভাগের ফেরাসি কিলানি, যিনি ২০১১ সাল থেকে সিরিয়ার যুদ্ধের ওপর নজর রাখছেন, তিনি এ রকম কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন।
আমার মনে হয়, আমরা এখন এই যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার সূচনা প্রত্যক্ষ করছি। একনায়ক আসাদের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া আন্দোলন একসময় নিষ্ঠুর গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। সিরিয়ার বেশিরভাগ এলাকা চলে যায় প্রেসিডেন্ট আসাদের বিরোধী বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু বিরোধী গ্রুপগুলো বর্তমানে তুরস্কের সঙ্গে সীমান্তে খুবই ছোট্ট একটি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। ২০১৭ সালে ইসলামিক স্টেট বা আইএসের পতনের পর থেকে স্বশাসিত কুর্দি অঞ্চল ছাড়া বাকি সিরিয়া চলে গেছে প্রেসিডেন্ট আসাদের নিয়ন্ত্রণে। বাশার আল আসাদকে আরব লীগে ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়টি দেশটির বাস্তব পরিস্থিতিরই স্বীকৃতি। এর অর্থ এই নয় যে, রাতারাতি অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে। কারণ, এ অঞ্চলে আরও কিছু দেশ- যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং ইরান সক্রিয় রয়েছে; কিন্তু এখন আমরা যা দেখছি, তা হচ্ছে এই যুদ্ধ শেষ হওয়ার সূচনা।
কীভাবে ফিরে এলেন প্রেসিডেন্ট আসাদ?
আরব দেশগুলোর মধ্যে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পরেই প্রেসিডেন্ট আসাদের আরব লীগে ফিরে আসা সম্ভব হয়েছে। এ উদ্যোগে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। যিনি এমবিএস নামে পরিচিত। তার এ প্রত্যাবর্তন ঘটেছে ধাপে ধাপে। জোটের ভেতরে কিছু বিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও বেশিরভাগ আরব দেশ উপলব্ধি করতে পেরেছে যে, তারা যেহেতু আসাদ সরকারের পতন ঘটাতে পারেনি, তাই তাদেরকে এখন প্রেসিডেন্ট আসাদকে নিয়েই থাকতে হবে।
এখানে আরও কতগুলো বিষয় কাজ করেছে। প্রথমত ক্যাপটাগন নামের একটি মাদক। এটি এক ধরনের এমফিটামিন। ধারণা করা হয় যে, প্রেসিডেন্ট আসাদ তার দেশে এ ড্রাগটির ব্যাপক উৎপাদনে অনুমতি দিয়েছেন। ব্রিটিশ সরকারের হিসাবে সারা বিশ্বে যত ক্যাপটাগন সরবরাহ করা হয়, তার ৮০ শতাংশই সিরিয়ায় উৎপাদিত হয়। এর পরে এ ড্রাগটি লেবাননসহ ওই অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। শুধু ২০২১ সালেই মধ্যপ্রাচ্য এবং তার বাইরের বিভিন্ন দেশ থেকে ৪০ কোটিরও বেশি ক্যাপটাগন ট্যাবলেট জব্দ করা হয়েছে, যা মোট উৎপাদনের সামান্য একটি অংশ বলে ধারণা করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোতে এটা আসলেই বড় ধরনের উদ্বেগের কারণ; বিশেষ করে, সৌদি আরবে।
সৌদি আরব মনে করে, সিরিয়াকে আরব লীগে ফিরিয়ে নেয়া হলে এ মাদকের সরবরাহ বন্ধ করা সম্ভব হবে। একইভাবে ইরানকে নিয়েও তাদের উদ্বেগ রয়েছে। শিয়া-প্রধান দেশ হিসেবে ইরান এরই মধ্যে ওই অঞ্চলে শক্তি অর্জন করেছে। চারটি আরব রাজধানীতে তেহরানের বড় ধরনের প্রভাবও রয়েছে। এগুলো হচ্ছে, বাগদাদ, বৈরুত, সানা এবং দামেস্ক। আরব লীগের নেতারা হয়তো হিসাব করে দেখেছেন, প্রেসিডেন্ট আসাদকে তাদের জোটে ফিরিয়ে নিলে সিরিয়ার ওপর ইরানের প্রভাব হ্রাস পাবে এবং মধ্যপ্রাচ্যের ‘শিয়া বলয়ে’ বিঘ্ন সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রেসিডেন্ট আসাদের এ প্রত্যাবর্তনের বিরোধিতা করতে পারে; কিন্তু এ বিষয়ে তাদের তেমন কিছু করার নেই। আরব বিশ্ব মনে করে, প্রেসিডেন্ট আসাদকে ক্ষমতা থেকে সরানো হবে না এবং এ কারণে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বর্তমানে যে পরিস্থিতি, তা চলতে দেয়া যায় না।
সূত্র : বিবিসি