এরদোয়ানের ভবিষ্যৎ পথচলা

অধ্যাপক শাব্বির আহমদ

প্রকাশ : ০৬ জুন ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আগামী পাঁচ বছরের জন্য আবারও তুরস্কের মসনদ সামলানোর দায়িত্ব পেয়েছেন প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোয়ান। ২০২৩-এর ১৪ মে প্রথম রাউন্ডে, ২৮ মে দ্বিতীয় রাউন্ডে অনুষ্ঠিত আধুনিক তুরস্কের বিগত ১০০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত নির্বাচনটি ছিল ২০ বছর ধরে তুরস্কের ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের জন্য চরম অগ্নিপরীক্ষা। দেশের ভেতরে-বাইরে বহুমুখী ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি এরদোয়ান যেন হারতে হারতে জিতে গেলেন। তুরস্কের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশিদিন শাসনকারীর তকমা তারই ঝুলিতে। দৈবিক কিছু না ঘটলে আরও পাঁচ বছর তিনি তুরস্ক শাসন করবেন। বামণ্ডডান-সেক্যুলাররা একজোট হয়েছিল কামাল আতাতুর্কপন্থি কট্টর সেক্যুলারিস্ট কামাল কিলিচারওগ্লোর নেতৃত্বে। এ জোটকে প্রকাশ্য সমর্থন দিয়েছিল আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। পশ্চিমাদের প্রোপাগান্ডা, তথাকথিত জনমত জরিপকে অসার প্রমাণ করে দিয়েছে এরদোয়ানের এ বিজয়। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, এরদোয়ানকে এক দিনের জন্যও ক্ষমতার মসনদে দেখতে না চাওয়া মার্কিন প্রেসিজেন্ট জো বাইডেন ফলাফল ঘোষণার পরপরই সবার আগেই অভিনন্দন জানিয়েছেন।

কামাল আতাতুর্ক তুরস্কের জাতীয় শিক্ষা কারিকুলাম থেকে ধর্মীয় শিক্ষাকে পুরোপুরি তুলে দিয়েছিলেন। ইস্তান্বুুলে মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া এরদোয়ানকে তার ধার্মিক পিতা প্রাথমিক শিক্ষা শেষে মাদ্রাসার বিকল্প ‘ইমাম হাতিপ’ নামক প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করান। ওই প্রতিষ্ঠানে স্নাতক পর্যন্ত অধ্যয়ন করে কোরআন-হাদিস ও আরবি ভাষা শিক্ষা লাভ করেন। ইসলামের প্রতি তার প্রগাঢ় ভালোবাসা ও অনুরাগের জন্ম ইমাম হাতিপ থেকেই। ছাত্রজীবনে ফুটবলার হিসেবেও খ্যাতি লাভ করেন। এক সময় তার মনে হলো, ইসলামকে শুধু হৃদয়ে ধারণ করলেই হবে না, ছড়িয়ে দিতে হবে তুর্কি সমাজেও। ১৯৭৬ সালে যোগ দিলেন কমিউনিস্ট বিরোধী অ্যাকশন পার্টিতে। সামরিক অভ্যুত্থানের পর অন্যান্য দলের মতো তার দলও নিষিদ্ধ হলো। এবার তার মধ্যে ধারণা জন্মাল, কামাল পাশার ইসলামবিরোধী কট্টর সেক্যুলার সংবিধান ইসলামি দল ও মতকে কখনও গ্রহণ করবেন না। তিনি উদার পন্থার দিকে পা বাড়ালেন। নীতি গ্রহণ করলেন মুখে জাতীয়তাবাদ, হৃদয়ে ইসলাম। এখনও সে পথেই আছেন। ১৯৮৩ সালে যোগ দেন নাজমুদ্দিন এরবাকানের ইসলামিস্ট ওয়েলফেয়ার পার্টিতে। এরদোয়ান ১৯৯১ সালে পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হয়েও বসতে পারেননি পার্লামেন্টে। ১৯৯৪ সালে ইস্তান্বুলের মেয়র নির্বাচিত হয়ে পাল্টে দেন এর চেহারা। পুরো তুরস্কব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এরদোয়ানের সুনাম সুখ্যাতি। ‘নতুন তুরস্ক’ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে ২০০১ সালে একে পার্টি গঠন করে ২০০২ সালে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন। ২০০৩ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালে তুরস্কে নির্বাচনের পদ্ধতি পরিবর্তন করে প্রেসিডেন্টশিয়াল পদ্ধতি চালু করেন। এরদোয়ান শুধু নিজ দেশের মানুষের মন জয় করেননি, তুরস্কের সীমানা ছাড়িয়ে দুনিয়াব্যাপী তার তুমুল জনপ্রিয়তা রয়েছে। তার বিজয়ে আনন্দণ্ডউল্লাস করতে স্বতঃস্ফূর্ত জনতা নেমে এসেছে তুরস্কের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজপথেও। এরদোয়ানের দীর্ঘ সফলতার পথচলা মোটেই সহজ ছিল না। অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে তাকে এখানে এসে পৌঁছতে হয়েছে। গ্রহণ করতে হয়েছে বিশাল চ্যালেঞ্জ, মোকাবিলা করতে হয়েছে বড় বড় বাধা। কিন্তু তিনি থেমে যাননি, শুধু সামনেই এগিয়েছেন। যত শত্রু তত মর্যাদা- পুরোনো এ জার্মান প্রবাদকে কাজেকর্মে ফলিয়ে ফুলিয়ে তুলছেন এরদোয়ান। ইরান ও আজারবাইজান ছাড়া আর সব প্রতিবেশীর সঙ্গে শত্রুতা তার। ভূমধ্যসাগর ও কৃষ্ণসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকে কেন্দ্র করে গ্রিসের সঙ্গে বিবাদ প্রায় সামরিক সংঘর্ষের পর্যায়ে গিয়ে থামলেও বন্দুকের বারুদ এখনও উত্তপ্ত। সিরিয়া ও ইরাকে কখনও আসাদ বাহিনী, কখনও কুর্দি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছে তুরস্ক। এরদোয়ান লিবিয়ায় থামিয়ে দিয়েছেন ফ্রান্স ও রাশিয়া-সমর্থিত বিদ্রোহী জেনারেল হাফতারের বাহিনীর অগ্রযাত্রা। আজারবাইজান-আর্মেনিয়ার যুদ্ধে আর্মেনিয়ার প্রতিবেশী রাশিয়ার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অর্থোডক্স খ্রিষ্টান দেশ আর্মেনিয়ার কবল থেকে উদ্ধার করে দিয়েছেন আজারবাইজানের নাগরনো-কারাবখ অঞ্চল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম কোনো খ্রিষ্টান রাষ্ট্রের ওপর মুসলিম রাষ্ট্রের আক্রমণ এবং জবরদখলকৃত ভূমি পুনরুদ্ধার। এর আগে কোনো অমুসলিম রাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধে হয় আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে, নয়তো পরাশক্তিগুলোর দয়া-দাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়েছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনের নেতৃত্বে মিত্রশক্তির যুদ্ধজয়ের ফলে চরম দুর্যোগ নেমে আসে প্রায় সাড়ে ৬০০ বছর মধ্যপ্রাচ্যসহ এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার বর্তমান ৩৫টি দেশ শাসনকারী অটোমানদের ওপর। লুজান চুক্তি দ্বারা ১৯২২ সালে উত্তর আনাতোলিয়াকে স্বাধীন তুর্কি রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করে নিয়ে আরব, পারস্য, গ্রিক ও বলকান অঞ্চল থেকে সরে আসতে হয় কামাল আতাতুর্ককে। বাকি অংশ ভাগবাটোয়া করে নেয় ফ্রান্স, ব্রিটেন, ইতালি, স্পেন, গ্রিস, রোমানিয়া। লুজান চুক্তির মাধ্যমে তুরস্কের মালিকানাধীন সাইপ্রাসসহ ভূমধ্যসাগর ও এজিয়ান সাগরের দ্বীপপুঞ্জগুলো গ্রিসের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হয় এবং ভূমধ্যসাগর, কৃঞ্চসাগর ও এজিয়ান সাগরে তেল-গ্যাস উত্তোলন থেকে বিরত রাখা হয়। বসফরাস প্রণালিকে যে কোনো দেশের জাহাজ চলাচলের জন্য উন্মুক্ত ঘোষণা দেয়া হয়। লুজান চুক্তির অনেক সীমাবদ্ধতার পরও এটিকে একটি কূটনৈতিক বিজয় হিসেবে দেখেছিলেন কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বাধীন তুর্কি সেক্যুলাররা। শুরু থেকেই সেক্যুলারিস্টরা পররাষ্ট্রনীতিতে ইউরোপ এবং আমেরিকাকে প্রাধান্য দেন। কিন্তু লুজান চুক্তি দ্বারা শৃঙ্খলিত তুরস্কের অর্থনীতিকে দুর্বল করে রাখার ফলে ইউরোপের রুগ্ণ দেশের তকমা লেগে যায় তুরস্কের গায়ে। বছরের পর বছর দেন-দরবার করেও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য লাভ সম্ভব হয়নি। ১৯৫২ সালে দেশটি ন্যাটোতে অংশগ্রহণ করেও আক্ষরিক অর্থে তুরস্ক আমেরিকার অনুগত রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি পায়। অপমানজনক লুজান চুক্তির বিরুদ্ধে প্রকাশ্য মুখ খোলেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। তিনি প্রকাশ্যে এ চুক্তির গুরুত্বকে প্রত্যাখ্যান করে বক্তৃতাণ্ডবিবৃতি দিতে শুরু করেন। ২০১৬ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতো একে পরাজয় বলে অভিহিত করেন। তিনি বারবার বলে আসছেন, লুজান চুক্তি ভূমধ্যসাগর ও কৃষ্ণসাগরে তুর্কি উপকূলের কাছাকাছি অবস্থিত দ্বীপপুঞ্জের নিয়ন্ত্রণ ও স্বার্থ সুরক্ষিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ২০১৮ সালে জাতিসংঘে ভাষণদানকালে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা দেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তুরস্কের ন্যায্য অধিকারের প্রতি সম্মান না দেখালে ১৯২৩ সালে লুজান চুক্তির মাধ্যমে যে মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে, আঙ্কারা প্রয়োজনে তা ছিড়ে ফেলে দেবে। এরদোয়ানের এ ঘোষণায় ক্ষুব্ধ হয় আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্ব।

২০০৩ সাল থেকে দেশটির নেতৃত্বদানকারী এরদোগানকে আতাতুর্কের পর সবচেয়ে ক্যারিশম্যাটিক নেতা বলে গণ্য করা হয়। তিনি তুরস্ককে সামরিক ও শিল্পোন্নত দেশে পরিণত করে বিশ্বের মানচিত্রে একটি নেতৃস্থানীয় ও মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে এনে দাঁড় করিয়েছেন। তার ইস্পাত-দৃঢ় নেতৃত্বে তুরস্ক বর্তমানে বিশ্বে শীর্ষস্থানীয় ১০টি সমরাস্ত্র বিক্রেতা দেশের অন্যতম। তুরস্কের সমরাস্ত্র ভান্ডারে তৈরি হচ্ছে অত্যাধুনিক যতসব অস্ত্র। এসব অস্ত্রের সফল প্রয়োগ ও অপারেশন কৌশল দেখে তাবৎ বিশ্ব আজ বিস্ময়ান্বিত। এরদোয়ান শুধু তুরস্ক সংক্রান্ত বিষয়েই নন, মুসলিম বিশ্বের একজন প্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে বারবার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে গেছেন। সমকালীন মুসলিম বিশ্বে এরদোয়ানকে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা হিসেবে মনে করা হয়। ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, রোহিঙ্গা ইস্যুসহ মুসলিম বিশ্বের যে কোনো সমস্যার ব্যাপারে সোচ্চার এরদোয়ান। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে একটি সন্ত্রাসী দেশের নেতা এবং গাজা অঞ্চলকে উন্মুক্ত কারাগার হিসেবে উল্লেখ করে বিবৃতি দিয়েছিলেন। সুতরাং আজ ককেশাসের পাহাড়ে, সাহারার মরুভূমিতে, আফ্রিকার জঙ্গলে, উপসাগরীয় অট্টালিকায়, দক্ষিণ এশিয়ার মাটির ঘরে, প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলোতে যদি এরদোয়ানের জন্য মানুষের মন কাঁদে; তাহলে ধরে নিতে হবে এরদোয়ান ওই অঞ্চলের মানুষের মন জয় করে নিয়েছেন।

* লেখক : শিক্ষক, কলামিস্ট ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক