সাহসী ও যোদ্ধা জাতি হিসেবে সেই বাল্যকাল থেকেই কুর্দি জাতিদের বীরত্বগাথা সম্পর্কে কতই না রূপকথার কাহিনি শুনে এসেছি। সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘দেশে বিদেশে’ নামক ভ্রমণ কাহিনি যারা পড়েছেন, তাদের নিশ্চয় মনে থাকার কথা নয়নাভিরাম কুর্দিস্তানের প্রাকৃতিক পরিবেশের বর্ণনার পাশাপাশি অত্যন্ত সুদর্শন কুর্দি পুরুষ আর অনিন্দ্য সুন্দরী ললনাদের জীবন কাহিনি। বাংলায় ডাবিংকৃত একাধিক সিরিয়ালে কুর্দি বংশোদ্ভূত ক্রুসেড জয়ী মহাবীর সুলতান সালাহ উদ্দিন আইয়ুবীর জীবন কাহিনি ও বীরত্বগাথা সম্পর্কে অনেক ধারণা লাভ করি। তা ছাড়া রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে কুর্দি জাতিগোষ্ঠী সম্পর্কে প্রচুর লেখাপড়ারও সুযোগ হয়। সব মিলিয়ে সেই ছাত্রাবস্থা থেকেই কুর্দিস্তান ও কুর্দি জাতি সম্পর্কে বিশেষ কৌতূহলের সৃষ্টি হয়।
মধ্যপ্রাচ্যে আরব, তুর্কি এবং পারসিকদের পরেই কুর্দিরা চতুর্থ বৃহৎ জাতিগোষ্ঠী। কুর্দিরা শত শত বছর ধরেই সিরিয়া এবং মেসোপটেমিয়ার সমতল এবং পাহাড়ি ভূমিতে বসবাস করে আসছে। আধুনিক তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বে, সিরিয়ার উত্তর-পূর্বে, ইরাকের উত্তরে, ইরানের উত্তর-পশ্চিমে এবং আর্মেনিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রায় ৩ লাখ বর্গ কিলোমিটারের বিশাল এলাকাজুড়ে আছে কুর্দিস্তান। কুর্দিস্তান হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রবিহীন জাতির আবাসভূমি। এর অধিবাসীদের বলা হয় কুর্দি। এসব এলাকায় প্রায় তিন কোটি কুর্দি জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। এ ছাড়া কুর্দিস্তানের বাইরেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আরও কয়েক লাখ কুর্দি বসবাস করে। পাশাপাশি পাঁচটি দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকলেও কুর্দিরা মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের আলাদা পরিচয় তৈরি করেছে স্বতন্ত্র ভাষা-সংস্কৃতি দিয়ে। ফলে তাদের খুব সহজেই পার্শ্ববর্তী তুর্কি ও আরবদের থেকে আলাদা করা যায়। তবে ইরানিদের সঙ্গে তাদের সংস্কৃতিগত মিলের কারণে কুর্দিদের ইরানি মহাজাতির অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
তুরস্কের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ ভাগ কুর্দি। ইরাকে ১৫ ভাগ, ইরানে ৭ ভাগ এবং সিরিয়ায় ১০ ভাগ জনসংখ্যা কুর্দি। কুর্দিরা মূলত সুন্নি মুসলিম। সুন্নি মুসলিমরা সংখ্যায় প্রায় ৮০ ভাগ। এ ছাড়া ১৫ ভাগ কুর্দি শিয়া মুসলিম। আর বাদ বাকি ৫ শতাংশ খ্রিস্টিয়ান, ইয়াজিদি, জরথ্রস্ত। কুর্দিরা ধর্ম প্রসঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী এবং পরমতসহিষ্ণু। সুন্নি এবং শিয়া উভয় ভাগের মুসলিমদের মধ্যে সুফিবাদের ব্যাপক প্রভাব লক্ষণীয়। দীর্ঘদিন ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রের অধীনে ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে আন্দোলন করতে গিয়ে প্রতিটি অঞ্চলের কুর্দিদের রাজনৈতিক এবং সামাজিক বৈশিষ্ট্য ভিন্ন ভিন্নভাবে বিকশিত হয়েছে। ফলে তাদের মধ্যে অনেক বিষয়ে ভিন্নতারও সৃষ্টি হয়েছে। অধিকাংশ কুর্দি জাতীয়তাবাদীই বৃহত্তর স্বাধীন কুর্দিস্তানের স্বপ্ন দেখে; কিন্তু তাদের রাজনীতিবিদরা তাদের এসব ভিন্নতা সম্পর্কে অবগত থাকায় স্বাধীনতার পরিবর্তে অধিকতর অধিকার এবং স্বায়ত্তশাসনের পক্ষপাতী।
সমৃদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক-বাহক হয়েও বিরাট কুর্দি জনগোষ্ঠী কেন প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি স্বাধীন-সার্বভৌম কুর্দিস্তান! কেন দশকের পর দশক ধরে তারা নির্যাতিত-নিষ্পেষিত এবং বিভাজিত একাধিক রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতে! এ সবকিছুর উত্তর পেতে হলে ফিরে যেতে হবে একটু অতীত ইতিহাসের পাতায়। আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে কুর্দিরা অন্যতম বঞ্চিত এবং নির্যাতিত জাতিগোষ্ঠী। কুর্দিদের জন্মই হয়েছে যেন প্রতারিত হওয়ার জন্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর স্বাধীন কুর্দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছিল। যুদ্ধে মুসলিম বিশ্বের প্রতিনিধিত্বকারী তুর্কির অটোমান (ওসমানীয় খেলাফত) সাম্রাজ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা মিত্র শক্তির বিরুদ্ধে জার্মানির পক্ষাবলম্বন করে। আজকের মধ্যপ্রাচ্যের সব ক’টি রাষ্ট্র, মধ্য এশিয়া ও ইউরোপের বলকান অঞ্চলের অধিকাংশ রাষ্ট্র ওসমানীয় খেলাফতের অধীনে ছিল। ওসমানীয় খেলাফতের পড়ন্ত বিকেলে যুদ্ধে জড়ানো ছিল মারাত্মক ভুল। আর এ সুযোগটি পুরোপুরি গ্রহণ করেছিল ব্রিটিশরা। ওসমানীয় খেলাফতের অধীন আঞ্চলিক শাসকদের ব্রিটিশরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, মিত্র শক্তিকে সহযোগিতা করলে যুদ্ধের পর সম্ভাব্য সব ছোট-বড় রাষ্ট্রই স্বাধীনতা পাবে। পক্ষান্তরে ব্রটিশ শাসনাধীন ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানরা তুর্কির নেতৃত্বাধীন ওসমানীয় খেলাফত রক্ষাকল্পে মাওলানা মুহাম্মদ আলী ও শওকত আলী ভ্রাতাদ্বয়ের নেতৃত্বে খেলাফত আন্দোলন শুরু করলে সুচতুর ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের আশ্বস্ত করে, যুদ্ধে মুসলমানরা ব্রিটিশদের সহযোগিতা করলে অটোমান সাম্রাজ্যের কোনো ক্ষতি করা হবে না। ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি।
যুদ্ধে জার্মানপক্ষ পরাজিত হলে ব্রিটিশের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা মিত্র শক্তি অটোমান সাম্রাজ্যের অধীন অঞ্চলগুলোকে বিশেষত ব্রিটেন ও ফরাসিরা নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়। কিছুদিন শাসন-শোষণের পর আস্তে আস্তে স্বাধীনতা দিতে থাকে। এভাবেই আজকের মধ্যপ্রাচ্য, মধ্যএশিয়া ও বলকান অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলো স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯২০ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রটিশদের সহযোগিতায় কুর্দিরা কুর্দিস্তান নামে সার্বভৌম রাষ্ট্র গড়ে তুলতে তৎপর হয়ে ওঠে। সিদ্ধান্ত হয়েছিল ‘ট্রিটি অফ সেভরাস’ নামে পরিচিত চুক্তি দ্বারা অপরাপর আরব রাষ্ট্রের ন্যায় কুর্দিস্তানেরও স্বাধীনতা দেয়া হবে; কিন্তু এর তিন বছরের মাথায় কুর্দিদের সেই স্বপ্নে জল ঢেলে দেয়া হয়েছিল। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে ‘লুসান’ চুক্তির দ্বারা যখন তুরস্কের সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছিল, তখন কুর্দি রাষ্ট্রের জন্য কোনো ব্যবস্থা রাখা হলো না। ফলে চাপা পড়ে যায় কুর্দিদের স্বাধীনতা বা স্বায়ত্তশাসনের স্বপ্ন। শুরু হয় এক দীর্ঘস্থায়ী সংকট। ব্রিটিশ এবং ফরাসিরা বৃহৎ কুর্দিস্তান এলাকাকে এর আগে স্বাক্ষরিত ‘সাইকস-পিকো’ চুক্তির মাধ্যমে সৃষ্ট একাধিক রাষ্ট্রের মধ্যে ভাগাভাগি করে তাদের মধ্যে কৃত্রিম সীমারেখা টেনে দেয়। তখন থেকেই শুরু হয় কুর্দি জাতির ট্র্যাজেডি। সমগ্র কুর্দি জাতি বিভাজিত অবস্থায় বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী হিসেবে রয়ে গেল। তারপর ৯০ বছর ধরে তারা কোনো ধরনের স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের পাঁয়তারা করলে তা নির্মমভাবে দমিয়ে দেয়া হয়েছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ জয়ী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি মধ্যপ্রাচ্যের অপরাপর জাতিগোষ্ঠীকে দেয়া প্রতিশ্রুতি মোটামুটি রক্ষা করলেও কুর্দিদের দেয়া প্রতিশ্রুতি থেকে সরে এসে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা মোতাবেক কুর্দি জাতিকে চিরতরে পঙ্গু করে রাখার মানসে কুর্দিস্তানকে পাশাপাশি পাঁচটি রাষ্ট্রের মাঝে ভাগাভাগি করে দেয়। যাকে ক্রুসেডের যুদ্ধে কুর্দি বীর গাজী সুলতান সালাহ উদ্দিন আইয়ুবীর কাছে ইউরোপীয়দের লজ্জাজনক পরাজয়ের মধুর প্রতিশোধ বলে মনে করেন অনেক ঐতিহাসিক। উল্লেখ্য, মুসলমানদের প্রথম কেবলা (ইহুদি-খ্রিস্টানদের কাছেও সমান পবিত্র) জেরুজালেমের বায়তুল মোকাদ্দাস দখলে নিতে ইউরোপের সম্মিলিত খ্রিষ্টান শক্তি ১০৯৫-১২৯১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় দুইশ’ বছর ধরে তাদের ভাষায় যে পবিত্র যুদ্ধ ‘ক্রুসেড’-এ অবতীর্ণ হয়েছিল, সে যুদ্ধে জেরুজালেমের সন্নিকটে হাত্তিনের যুদ্ধে মুসলিম সেনাপতি মহাবীর সুলতান সালাহ উদ্দিন আইয়ুবীর কাছে তারা চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়েছিল। আজকের ইরাকের তিরকিত-মসুলের মাঝামাঝি বারিন কেল্লায় ১১৩৭ খ্রিষ্টাব্দে এক কুর্দি পরিবারে মহাবীর সুলতান সালাহ উদ্দিন আইয়ুবীর জন্ম। তিনি এখনও ইউরোপিয়ানদের কাছে মূর্তিমান এক আতঙ্ক। ইউরোপীয় লেখকরা তাকে ‘সালাদিন’ হিসেবে সম্বোধন করে থাকেন। ভারতীয় উপমহাদেশের লোকদের কাছে মঙ্গোলীয় বীর চেঙ্গিস খান যেমন মূর্তিমান আতঙ্কের নাম, ইউরোপীয়দের কাছে মহাবীর সুলতান সালাহ উদ্দিন আইয়ুবীর নামও ঠিক তেমনিই। ফলে স্বাভাবিক কারণে ইউরোপীয়দের কাছে কুর্দি জাতিগোষ্ঠী সম্পর্কে চরম বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব ক্রিয়াশীল ছিল যুগ যুগ ধরে, যার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ৬০০ বছর ধরে মুসলিম জাহানের প্রতিনিধিত্বকারী অটোমান সাম্রাজ্য ধ্বংসের পাশাপাশি কুর্দিস্তানকে খণ্ড-বিখণ্ড করে এর অধিবাসীদের একাধিক রাষ্ট্রের হাতে সঁপে দিয়ে গোলামির জিঞ্জিরে আবদ্ধ থাকার ব্যবস্থা করে দেয়ার মধ্যে।
কুর্দিদের জন্মই হয়েছে যেন প্রতারিত হওয়ার জন্য। বিশ্বে কুর্দিরাই সম্ভবত সবচেয়ে বড় জাতি, যারা নিজেদের বিশাল জনগোষ্ঠী ও ভূমি নিয়েও পরাধীন হয়ে আছে যুগের পর যুগ। ক্রুসেডের বদলা নিতে মূলত ব্রিটিশ সাম্র্রাজ্যবাদী শক্তি কুর্দি জাতিগোষ্ঠীকে পরিকল্পিতভাবে বিভক্ত করে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। অনুরূপভাবে ভারত উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় প্রদেশ বাংলাকে খণ্ড-বিখণ্ড করে বাঙালি জাতি যাতে আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে, তার চূড়ান্ত ব্যবস্থা করে গিয়েছিল এ ব্রিটিশ বেনিয়ারা। সিপাহী আন্দোলনসহ প্রতিটি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন ছিল বাঙালি জাতির অপরাধ। ইতিহাস সাক্ষী, ব্রিটিশরা এমন এক ভয়ানক জাতি, তারা যেখানেই সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠা করেছে, সেখানে দীর্ঘ শাসন-শোষণ শেষে স্থানীয় জাতিগোষ্ঠীর আন্দোলন সংগ্রামের মুখে লেজ গুটিয়ে চলে আসার সময় রোপণ করে গেছে ষড়যন্ত্রের বিষবৃক্ষ। ব্রিটিশরা ইচ্ছাকৃতভাবেই কাশ্মীর সমস্যার কোনো সুরাহা না করে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে চির বৈরিতা সৃষ্টি করে রেখেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘ দখলদারিত্বকালে ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদিদের ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে এনে ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোড়া খ্যাত ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিল মূলত ব্রিটিশরা। যা-ই হোক, কুর্দিরা একত্র হয়ে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে না পারলেও বিচ্ছিন্নভাবেই তারা তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে যুগের পর যুগ। কুর্দিরা প্রধানত চারটি দেশে ভাগ হয়ে যাওয়ার পর থেকে তারা আর একক কুর্দি জাতিসত্তার পরিচয় বহন করতে পারছে না। তাদের আজ আলাদা আলাদা পরিচয়ে পরিচিত হতে হচ্ছে। যারা তুরস্কে আছে, তাদের তুর্কি কুর্দি; যারা ইরাকে আছে, তাদের ইরাকি কুর্দি; যারা ইরানে আছে, তাদেরকে ইরানি কুর্দি ও যারা সিরিয়ায় আছে, তাদের সিরীয় কুর্দি পরিচয় নিয়ে ঘুরতে হয়।
লেখক : কলামিস্ট ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক