ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধ এখনো চলছে। এ যুদ্ধে অসংখ্য মানুষ নিহত হয়েছেন। অনেকে নানা দেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। কথা ছিল, তবু যুদ্ধের কারণে অনেকের বিয়ে করা হয়নি। কবে হবে, জানা নেই তাদের। আবার অনেকে যুদ্ধে সঙ্গী হারিয়ে একা হয়ে পড়েছেন। সংঘাতে কারো আলাদা হয়েছে পরিবার; কারো ভেঙেছে সংসার। এ যুদ্ধ পরিস্থিতিতে গর্ভধারণ করবেন কি না, সন্তান জন্ম দেবেন কি না, এ সিদ্ধান্ত নিতে হিমশিম খাচ্ছেন দেশটির নারীরা। এতে করে দেশটিতে সন্তান জন্মহারও বেশ কমে গেছে।
ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের বাইরে ছোট্ট শহর বুচা। এ শহরের একটি মেডিকেল সেন্টারে সদ্যোজাত শিশুকন্যাকে কোলে নিয়ে আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন মা ইউলিয়া বালাহুরা। তার মেয়ের নাম মিয়া। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন রাত দুটোয় ঘুম থেকে উঠে মিয়াকে বুকের দুধ খাওয়াতে হয়। এরপর বিমান হামলার সাইরেন বেজে ওঠে। এটা আমার রোজকার রুটিন হয়ে গেছে।’ ৩৮ বছর বয়সি ইউলিয়া হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরে গেছেন। বুচায় কোনো প্রসূতি হাসপাতাল নেই। এ কারণে গ্রীষ্মের শুরুতে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে কিয়েভের একটি হাসপাতালে মিয়ার জন্ম দিতে যেতে হয়েছিল তাকে। তার যেদিন প্রসব ব্যথা শুরু হয়, সেদিনও প্রতিদিনের মতো কিয়েভে রাশিয়া ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন দিয়ে বোমা হামলা করেছিল। এ কারণে ছোট্ট মিয়া পৃথিবীতে তার প্রথম রাতটি হাসপাতালের বেজমেন্টে বোমা আশ্রয়কেন্দ্রে কাটিয়েছে।
সন্তান জন্মের সময়ের কথা উল্লেখ করে ইউলিয়া বলেন, কানে তালি লাগানো সাইরেনের শব্দ ও বিস্ফোরণ চারিদিক অন্ধকার করে ফেলেছিল। তবে নার্সরা নারীদের শান্ত থাকতে উৎসাহিত করেছিলেন। তারা তাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন। রাশিয়ার হামলার কারণে প্রায় সারা দেশে বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটে। পানি ও পানি গরম করার সরঞ্জাম সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এতে প্রসূতিদের পর্যাপ্ত যত্ন দেয়াটা কঠিন হয়ে পড়ে। মিয়া ছাড়াও ইউলিয়ার আরো দুটি কন্যাসন্তান আছে। তিনি বলেন, তিনি জানতেন এ যুদ্ধের সময় আরেকটি গর্ভাবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অনেক ঝুঁকির। গত আগস্টে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি নিশ্চিত করেছেন, ইউক্রেনে আগামী মাসগুলোয় আরো সৈন্য মোতায়েন করা হবে। ইউলিয়ার ধারণা, তার স্বামী ভ্লাদিস্নাভকে এ কাজে হয়তো শিগগিরই ডাকা হবে।
সন্তান জন্মের হার কমেছে
ধারণা করা হয়, ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরু হওয়ার পর থেকে দেশটির জন্মহার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমে গেছে। ইউক্রেনের বিশ্লেষণী সংস্থা ওপেনডেটাবটের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের একই সময়ের তুলনায় চলতি বছরের প্রথমার্ধে দেশটিতে ৩৮ হাজার কম শিশুর জন্ম হয়েছিল। ইউক্রেনের বিচার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নিবন্ধিত জন্মসংখ্যার ওপর ভিত্তি করে এ পরিসংখ্যান দেয়া হয়েছে। তবে রাশিয়ার সঙ্গে সংঘাত শুরুর আগেও ইউক্রেনের জন্মহার কম ছিল। সংঘাত পরিবারগুলোকে আলাদা করেছে। এতে পরিবারগুলো সন্তান নেয়ার পরিকল্পনা স্থগিত করতে বাধ্য হচ্ছে। ইউক্রেনে যুদ্ধে অংশ নিতে লাখো পুরুষকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এরই মধ্যে যুদ্ধে অসংখ্য পুরুষ নিহত হয়েছেন। ৩০ থেকে ৪০ লাখ তরুণ-তরুণী পোল্যান্ড, জার্মানি ও এবং যুক্তরাজ্যের মতো দেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হলেও এখনও কিছু তরুণীও স্বেচ্ছায় যুদ্ধে কাজ করছেন।
কিয়েভের পতুখা ইনস্টিটিউটের ডেমোগ্রাফি অ্যান্ড সোশ্যাল স্টাডিজের উপপরিচালক ওলেকসান্দর হ্লাদুন বলেন, ‘এই নারীদের মধ্যে কেউ কেউ এ বছর সন্তান জন্ম দিতে পারতেন, কিন্তু তা আর হবে না। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে তারা ইউক্রেনে ফিরে যেতেও পারেন, নাও পারেন। হয়তো তাদের স্বামী বিদেশে তাদের কাছে চলে যাবেন। কিছু পরিবার ভেঙেও যেতে পারে।’
ইউলিয়া বালাহুরার মেয়ে মিয়ার চিকিৎসক নাতালিয়া স্টোলিনেটস বলেন, সংঘাত শুরুর আগে আগে তিনি কিয়েভের স্যাটেলাইট শহর বুচায় প্রতি মাসে গড়ে ১০টি নবজাতকের নিবন্ধন করতেন। সেখানে রাশিয়ার দখলদারিত্বের পাঁচ সপ্তাহ পর শত শত বেসামরিক নাগরিকের লাশের সন্ধান পাওয়া যায়। এখন যদি তিনি মাসে একটি বা দুটি নবজাতক পান, সেটিকেই তিনি আশার আলো হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, ‘জীবন থামিয়ে দেয়া উচিত নয়। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।’ নাতালিয়া বলেন, তরুণ ইউক্রেনীয় মায়েরা বুঝতে পারেন, যুদ্ধের সময় সন্তান জন্ম দেয়ার অর্থ বোমা আশ্রয়কেন্দ্রে রাত কাটানো। তবে কেউ কেউ এরপরও মাতৃত্বের স্বাদ নিতে চান।
জন্মের আদর্শ সময় নেই
হাল্যা রুডিক ও তার স্বামী কস্তিয়া নেচিপোরেঙ্কো দুজনেই ইউক্রেনে সাংবাদিকতার কাজ করছেন। সম্প্রতি তারা মা-বাবা হয়েছেন। হাল্যা রুডিক বলেন, ‘সন্তান এখন না হলে কবে হবে? ভালো সময়ের জন্য অপেক্ষা করার কোনো অর্থ নেই। এর প্রভাব বছরের পর বছর স্থায়ী হবে; কারণ, যুদ্ধ শেষে দেশটি ধীরে ধীরে পুনর্গঠিত হবে।’ হাল্যা রুডিক আরো বলেন, ‘আমরা জানি না, আমাদের চাকরি হবে কি না। ভবিষ্যতে কী হবে, জানি না। রাশিয়া আমাদের জীবনের সেরা সময় নষ্ট করে দিয়েছে, এ কারণে খুব রাগ হয়।’ এ দম্পতির কন্যাসন্তানের নাম মারিয়া। মারিয়া ইউলিয়া বালাহুরার মেয়ে মিয়ার থেকে মাত্র তিন দিনের বড়। বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মধ্যেও কিয়েভে এ দুই শিশুর জন্ম হয়।
কস্তিয়া বলেন, তাকে যে কোনো সময় ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী থেকে ডাকা হতে পারে। এখন শুধু কাগজপত্রের অপেক্ষায় আছেন। এ কারণে অপেক্ষা না করে এখনই পারিবারিক জীবন শুরু করেছেন। তিনি আরো বলেন, ‘আমি বুঝতে পেরেছিলাম, আমি সব সময় তরুণ থাকব না। আগামী পাঁচ বা ছয় বছরে ইউক্রেনীয় দম্পতি হিসেবে সন্তান লালন-পালনের জন্য কোনো আদর্শ সময় হবে না।’
তবে হাল্যা রুডিক ও কস্তিয়া নেচিপোরেঙ্কো দম্পতির মতো ভাবনা সবার নয়। ৩৫ বছর বয়সি লেখক ইরিনা মেলনিচেঙ্কো কিয়েভে থাকেন। তিনি বলেছেন, তার স্বামীকে যুদ্ধে অংশ নিতে হয়েছিল। এ কারণে কমপক্ষে এক বছরের জন্য তাদের সন্তান নেয়ার সিদ্ধান্ত স্থগিত করতে হয়েছে। ইরিনা বলেন, যুদ্ধ শুরু হওয়ার মাত্র তিন সপ্তাহ আগে তারা বিয়ে করেছিলেন। তাদের স্বপ্ন ছিল নিজস্ব বাড়ির পাশাপাশি তারা সন্তান নিয়ে দ্রুত একটি পূর্ণ পরিবার গঠন করবেন। তিনি বলেন, ‘যখন আমার স্বামী যুদ্ধের সম্মুখ সারিতে গিয়েছিলেন, তখন আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। যেহেতু আমি অন্তঃসত্ত্বা ছিলাম না, সেহেতু তিনি যদি আর ফিরে না আসেন, তাহলে হয়তো আর তার সন্তানের মা হতে পারব না। তার সন্তানের যত্ন নিতে ও ভালোবাসতে পারব না।’
এদিকে ইউলিয়া বুচায় ফিরে সন্তানদের নিয়ে প্রতিদিন বাড়ির পাশে হেঁটে বেড়ান। স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, মূলত এ পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক জীবন চালিয়ে যাওয়া যুদ্ধকে অস্বীকার করার একটি উপায়। ইউলিয়ার আশা, শিগগির এ যুদ্ধ তার কন্যাদের জন্য একটি দূরবর্তী স্মৃতি হয়ে থাকবে। ইউক্রেনে আবার পরিবার গঠনের জন্য একটি নিরাপদ জায়গা করে তোলা প্রাপ্তবয়স্কদের ওপর নির্ভর করছে।