রাশিয়া তাদের ৩০টিরও বেশি ‘বন্ধু ও নিরপেক্ষ’ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে তেমন তাৎপর্যপূর্ণ না হলেও এর কূটনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। শনিবার ঢাকায় রাশিয়ার দূতাবাস তাদের ভেরিফাইড ফেসবুকে পেইজ এবং এক্স (সাবেক টুইটার) অ্যাকাউন্ট থেকে বাংলাদেশকে ওই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে একটি পোস্ট দেয়। সেখানে বলা হয়, বাংলাদেশসহ তালিকায় থাকা দেশগুলোকে রাশিয়ান মুদ্রাবাজার এবং ডেরিভেটিভস বাজারে বাণিজ্য করার অনুমতি দেবে মস্কো। অর্থাৎ ওই তালিকাভুক্ত দেশগুলোর ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো রুশ মুদ্রা রুবলে লেনদেন করতে পারবে।
কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, বাংলাদেশে রুবলের রিজার্ভ খুব সীমিত। রুবল, কনভার্টেবল বা বিনিময়যোগ্য মুদ্রা হিসেবে জনপ্রিয় না হওয়ায় বৈদেশিক লেনদেনে এখনও এই মুদ্রা তেমন ব্যাপক হারে ব্যবহার হয় না। বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন করে এমন ব্যাংকগুলোও রুবল রাখে না। ফলে সরাসরি রুবলে লেনদেন তেমন হয় না। তৃতীয় কোনো মুদ্রায় কনভার্ট করে লেনদেন করতে হয়। এ ক্ষেত্রে চীনের ইউয়ান তৃতীয় মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার হলেও তার পরিধি বেশ সীমিত। এমতাবস্থায় রাশিয়ার বন্ধু তালিকায় বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অর্থনৈতিক বা প্রায়োগিক তাৎপর্য বিশেষ নেই বলেই মনে করেন অর্থনীতিবিদ এবং বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির বোর্ড অব ট্রাস্টির সদস্য ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
তার মতে, রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য খুবই সীমিত। কোভিডের পরে বিশেষ করে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর থেকে তা আরো অনেক কমে গেছে। রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের লেনদেনে এ মুহূর্তে যে সমস্যা রয়েছে, তা সমাধানে সর্বোপরি দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্কোন্নয়নে তাদের তালিকাভুক্তি খুব একটা সুবিধা করতে পারবে না বলেই দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের অভিমত। তিনি বলেন, নতুন বাণিজ্য করার ক্ষেত্রে পেমেন্টের জন্য আমাদের হাতে যথেষ্ট পরিমাণের রুবল এবং তাদের হাতে যথেষ্ট পরিমাণ টাকা থাকতে হবে। কিন্তু বাণিজ্যের জন্য যতটা রিজার্ভ থাকা প্রয়োজন, তা নেই। সেই সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেনে তৃতীয় মুদ্রা হিসেবে ইউয়ানের রিজার্ভও যথেষ্ট নেই। হাতে থাকা ইউয়ান দিয়ে কতটা পাওনা পরিশোধ করা যাবে এবং যত ইউয়ান আসবে, তা আন্তর্জাতিক বাজারে কতটা ব্যবহার করা যাবে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তাই ঢাকা- মস্কোর মধ্যে তৃতীয় মুদ্রায় লেনদেন কোনো চটজলদি সমাধান নয় বলে মি. ভট্টাচার্য মনে করেন।
সম্প্রতি রুশ প্রেসিডেন্ট সের্গেই ল্যাভরভের সফরের সময় দুই দেশের নিজেদের মুদ্রায় লেনদেনের বিষয়ে নানা আলোচনা হয়েছে। রাশিয়ার যেসব ব্যাংক ও জাহাজ নিষেধাজ্ঞার আওতায় নেই, সেগুলোর মাধ্যমে লেনদেন করা যায় কি না, সেই সব বিকল্প খোঁজা হয়েছে। মি. ল্যাভরভের সফরের প্রাক্কালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, দেশের একক মুদ্রায় বাণিজ্যিক লেনদেন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বেশ কিছুদিন ধরে আলোচনা চলছে। তিনি বলেন, তাদের কারেন্সিতে (রুবল) লেনদেন নিয়ে ভাসা ভাসা আলোচনা হতে পারে। কেননা, বাংলাদেশের হাতে তো রুবল নেই। তবে এই বাণিজ্য সুবিধা দেয়ার বিষয়টি যতটা না অর্থনৈতিক, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক সামিয়া জামান। তার মতে, এ সুযোগে বাংলাদেশের অনেক লাভ হবে কিনা বা বাণিজ্যের পরিধি বাড়বে কি না, সেটা জরুরি নয়। বরং পশ্চিমাদের চাপের মুখে থাকা বাংলাদেশকে রাশিয়া যে নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেনের সুযোগ খুলে দিয়েছে, সেই বার্তা এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানির লেনদেন মূলত মার্কিন ডলারে হয়ে থাকে। এ ছাড়া ইউরো, পাউন্ড, অস্ট্রেলিয়ান ডলার, চীনা মুদ্রা ইউয়ান ও কানাডিয়ান ডলারে কিছু লেনদেন হয়। এর বাইরে ভারতের সঙ্গে বিশেষ ব্যবস্থায় টাকা-রুপিতে বাণিজ্য শুরু হয়েছে। সে ক্ষেত্রে রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক লেনদেনের পরিমাণ বেশ কম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুই দেশের লেনদেন ডলার কিংবা ইউরোতে হয়েছে। সেই ঋণপত্রও খোলা হয়েছে মার্কিন ডলার এবং ইউরোতে। এর বাইরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য দুই দেশের মধ্যে আর্থিক লেনদেনও রুবলে হয় না। এই প্রকল্পের ঋণ চীনা মুদ্রা ইউয়ানে পরিশোধের ব্যাপারে বাংলাদেশ ও রাশিয়া সম্মত হয়েছে বলে দেশের গণমাধ্যমগুলো বলছে। বর্তমানে রাশিয়ার বাজারে সরাসরি বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির সুযোগ তেমন নেই বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। এর মূল কারণ, রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেন হয় না। এ ছাড়া বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে শুল্ক জটিলতার কারণে রাশিয়ার বাজারে বাণিজ্য আশা অনুযায়ী বাড়ছে না। রাশিয়ার বাজারে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি করতে হয় তৃতীয় দেশের মাধ্যমে এবং মান্ধাতার আমলের টেলিগ্রাফিক লেনদেন (টিটি) পদ্ধতিতে।
এমন অবস্থায় রাশিয়ার বন্ধু তালিকায় অন্তর্ভুক্তি রাতারাতি কোনো পরিবর্তন আনবে, এমন প্রত্যাশা করছেন না বিশ্লেষকরা। ইউক্রেনে হামলা চালানোর পর বেলজিয়াম থেকে পরিচালিত আন্তর্জাতিক লেনদেন ব্যবস্থা সুইফটে (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন) নিষিদ্ধ করা হয় রাশিয়ার ব্যাংকগুলোকে। রাশিয়াও এ পদ্ধতিতে লেনদেন নিষ্পত্তিকে অনিরাপদ মনে করত। এতে সে সময় বাংলাদেশ-রাশিয়ার বাণিজ্য ও বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়েছিল। কেননা, এতে আমদানি-রপ্তানির অর্থ পরিশোধ বিশেষ করে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ রাশিয়ার অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের অর্থছাড় দুরূহ হয়ে পড়েছিল। এমন অবস্থায় দেশটি সুইফটের বিকল্প হিসেবে ‘কারেন্সি সোয়াপ’ পদ্ধতিতে লেনদেন নিষ্পত্তির প্রস্তাব দিয়েছিল বাংলাদেশকে। কিন্তু রুবলের যথেষ্ট রিজার্ভ না থাকায় এ বিষয় আলোচনা আর এগোয়নি। ডলার এড়িয়ে দুটি দেশ নিজ নিজ মুদ্রায় লেনদেন করলে তাকে ‘কারেন্সি সোয়াপ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ ব্যবস্থা চালু হলে এক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অপর দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বিপরীত মুদ্রায় অ্যাকাউন্ট খুলবে। বাংলাদেশ ব্যাংকে থাকবে রাশিয়ান মুদ্রার হিসাব। আর রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে থাকবে টাকার হিসাব। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দুই দেশে ওই মুদ্রার যথেষ্ট রিজার্ভ থাকা প্রয়োজন।
রাশিয়া মূলত তাদের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার অংশ হিসেবে বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর সঙ্গে রুবলে লেনদেনের সুযোগ খুলে দিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। কেননা, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের জেরে পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার ওপর কয়েক দফায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। যুদ্ধ শুরুর পর ১২০০ বহুজাতিক কোম্পানি রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে বা সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা দেয়। এতে আমদানি ক্রমান্বয়ে বাড়লেও সে তুলনায় রপ্তানি আয় কমে যায়। যা দেশটির অর্থনীতিকে কিছুটা কোণঠাসা করে ফেলে। এতে ডলারের তুলনায় সামগ্রিকভাবে প্রায় ২৫ শতাংশ মান হারায় রুবল। রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, মার্কিন ডলারের বিপরীতে রুশ মুদ্রা রুবলের মান কমতে কমতে ১৭ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। এই অর্থনৈতিক চাপ মোকাবিলায় দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রা চাঙা করতে দেশটি সুদের হার ১৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে। অর্থনীতির এমন টালমাটাল অবস্থায় বাণিজ্য সুবিধা দুয়ার খুলে সেই তালিকা প্রকাশ করল রাশিয়া। এই তালিকার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মার্কিন ডলারের আধিপত্য ভেঙে রাশিয়া তাদের মুদ্রার আধিপত্য তৈরির চেষ্টায় আছে বলে ধারণা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক সামিয়া জামান। তার মতে, পরিবর্তিত ভূরাজনীতিতে রাশিয়া তাদের আধিপত্য বিস্তারে এ কৌশলগত ঘোষণা দিয়েছে। তিনি বলেন, ইউক্রেনে হামলার পর থেকে তারা রুবলে লেনদেনের জন্য বিকল্প বাজার খুঁজছে। এখন তারা এই ৩০টি দেশের জন্য রুবলে বাণিজ্যের সুযোগ খুলে দিয়েছে। এতে তাদের মুদ্রার মান, মর্যাদা বাড়বে। রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত বার্তা সংস্থা আরআইএ নভোস্তি-এর খবর অনুসারে, চলতি বছরের জুলাইয়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এ সংক্রান্ত একটি আইনে স্বাক্ষর করেন। ওই আইনি কাঠামোর ভিত্তিতেই বন্ধু ও নিরপেক্ষ হিসেবে ঘোষিত দেশগুলো তাদের রুবলভিত্তিক মুদ্রা ও পণ্যবাজারে অংশগ্রহণ করতে পারবে বলে রুশ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে উঠে এসেছে। রুশ ফেডারেল আইনটিতে বলা হয়েছে, এ আইন মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে প্রত্যক্ষ বাণিজ্যের সক্ষমতা ও রুবলের চাহিদা আরও বাড়াবে, যা রাশিয়ার অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখবে।
তবে পশ্চিমা দেশগুলো নির্বাচনকে ঘিরে বাংলাদেশকে যেভাবে চাপের মুখে রেখেছে, সেখানে রাশিয়ার এই বন্ধুপ্রতিম মনোভাব ইতিবাচক বার্তা দেয় বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক সামিয়া জামান। পশ্চিমা চাপে থাকাবস্থায় রাশিয়ার এই তালিকাভুক্তি সরকারকে কিছু সাহস দিতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এতে বাংলাদেশের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক আরো শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। তবে এর ফলাফল যে শেষ পর্যন্ত ইতিবাচক হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই বলে সতর্ক করেছেন মি. ভট্টাচার্য। তিনি জানান, বাংলাদেশ এই ভূ-রাজনীতিতে রাশিয়ার দিকে ধাবিত হলে, পশ্চিমাদের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য, বৈদেশিক বিনিয়োগ, বৈদেশিক সাহায্য, রেমিট্যান্স ইত্যাদির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এ ব্যাপারে সরকারকে সাবধান থাকার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, আমাদের রাজনীতি যেন অর্থনৈতিক সমস্যাকে আরও জটিল করে না তোলে।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে হামলার পর কোন কোন দেশ রাশিয়ার বন্ধু, আর কোন কোন দেশ তাদের বন্ধু নয়, এমন একটি তালিকা প্রকাশ করেছে পুতিন প্রশাসন। ইউক্রেনে হামলার পর যেসব দেশ মস্কোর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, এমন পাঁচটি দেশ ও অঞ্চলকে রাশিয়া এবার বাদ দিয়েছে। দেশগুলো হলো- আর্জেন্টিনা, হংকং, ইসরায়েল, মেক্সিকো ও মলদোভা। তাদের রাশিয়া ‘অবন্ধু’ হিসেবে মনে করে। বন্ধু নয়, এমন দেশ ও অঞ্চলের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা নাগরিকদের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক পর্যালোচনা করা হবে বলে সে সময় জানায় ক্রেমলিন। এমনকি রাশিয়ায় ওইসব দেশের দূতাবাসে কর্মী নিয়োগেও কড়াকড়ি আরোপ করে দেশটির প্রশাসন।
লেখক : আর্ন্তজাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক ও গবেষক