প্রতি বছর ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালিত হয়। ১৯৪৭ সালের এ দিনে ভারত ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করেছিল। দিবসটি প্রতিটি ভারতীয়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক রক্তক্ষরণের পর ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট জওহরলাল নেহরু ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ গ্রহণ করার পরে দিল্লির লালকেল্লার লাহোরি গেটের ওপর ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার আনন্দে সেখান থেকে প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রীরা পরম্পরায় লালকেল্লায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে আসছেন এবং জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। জওহরলাল নেহরু ভারতের প্রথম স্বাধীনতা দিবসে যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন, তাকে ‘ভারতের গৌরব পুনরুদ্ধার তথা ট্রাইস্ট উইথ ডেসটিনি’ বলা হয়। উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালের ৪ জুলাই ব্রিটিশ হাউস অফ কমন্সে ভারতীয় স্বাধীনতা বিল পেশ করা হয়। এই বিলে ভারত ভাগ ও পাকিস্তান গঠনের প্রস্তাব ছিল। বিলটি ১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই গৃহীত হয় এবং ১৪ আগস্ট দেশভাগের পর ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল। মাহাত্মা গান্ধী ভারতের স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে অংশ নিতে পারেননি। ভারত যখন স্বাধীনতা পায়, তখন তিনি পূর্ব বাংলার নোয়াখালীতে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক সহিংসতা রোধে উপবাস করছিলেন।
ব্রিটিশরা ১৫ আগস্ট তারিখটিকেই কেন ভারতের স্বাধীনতার জন্য বেছে নিয়েছিল? এ সম্পর্কে বিভিন্ন ঐতিহাসিকের আলাদা বিশ্বাস রয়েছে। অনেকে মনে করেন, স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্নর সি রাজাগোপালচারীর পরামর্শে মাউন্টব্যাটেন ভারতের স্বাধীনতার জন্য ১৫ আগস্ট দিনটিকে বেছে নিয়েছিলেন। রাজগোপালাচারী লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে বলেছিলেন, ১৯৪৮ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত যদি অপেক্ষা করেন, তাহলে তখন তার কাছে স্থানান্তর করার কোনো আইনগত বৈধতা থাকবে না। এমন পরিস্থিতিতেই মাউন্টব্যাটেন ১৫ আগস্ট দিনটিকে ভারতের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে বেছে নেয়ার পক্ষে ছিলেন। একই সঙ্গে অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, মাউন্টব্যাটেন ১৫ আগস্ট তারিখটিকে শুভ বলে বিবেচনা করেছিলেন। এ জন্যই তিনি ভারতের স্বাধীনতার জন্য ওই তারিখটি বেছে নিয়েছিলেন। মাউন্টব্যাটেনের কাছে ১৫ আগস্ট দিনটি মঙ্গলজনক ছিল। কারণ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট জাপানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল এবং মাউন্টব্যাটেন সে সময় মিত্রবাহিনীর সেনাপতি ছিলেন। লর্ড মাউন্টব্যাটেন সীমান্ত বিভাজন কমিটির প্রধান রেড ক্লিফকে দিয়ে ভারত ভাগ করেছিলেন মূলত মুসলিমণ্ডঅমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে। বিভাজনের সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, সিভিল সার্ভিস, রেল ও কোষাগার বিভক্ত হয়ে যায়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট এবং ১৫ আগস্ট দুটি স্বশাসিত দেশ-ভারত ও পাকিস্তান অস্তিত্ব লাভ করে। এই বণ্টনের ফলে ৫ কোটির বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিল। দেশ বিভক্তির আগে ও পরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রাণহানি ঘটে পাঁচ লাখেরও বেশি মুসলমান, হিন্দু ও শিখ জনগোষ্ঠীর; যার দগদগে ক্ষত এখনও শুকায়নি।
শারীরিক চেকআপ সংক্রান্ত কাজে রাহ্বারে বায়তুশ শরফ আল্লামা শায়খ মুহাম্মদ আবদুল হাই নদভীর সঙ্গে ভারতে অবস্থান করেছিলাম। ১৫ আগস্ট দিবসটি যখন ঘনিয়ে আসছিল, তখন আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করছিলাম, ভারতবাসী কীভাবে তাদের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করে, তা দেখতে। ব্যাঙ্গালুর শহরের অভিজাত অলসুর লেক এলাকায় যে হোটেলে আমরা ছিলাম, তার দুই পাশে ব্যাঙ্গালুর ক্যান্টনমেন্ট। একে তো সেনসেটিভ এরিয়া, তার ওপর একজন বিদেশি হওয়ায় ভয় আর কৌতূহলে পাসপোর্ট পকেটে ভরে সকাল আটটায় হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়ি ভারতের ৭৭তম স্বাধীনতা দিবসের আয়োজন দেখতে। হোটেল থেকে বের হওয়ার আগেই হোটেল কর্তৃপক্ষ প্রতিটি কক্ষের মতো আমাদের কক্ষেও প্লেটে করে মিষ্টি এবং ভারতের জাতীয় পতাকার আদলে মিনি কেক পাঠায়। রাস্তায় বেরিয়ে দেখি, সর্বত্রই ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা। ক্যান্টনমেন্টে সেনাবাহিনীর স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখার জন্য বিশাল শামিয়ানা টাঙানো হয়। অনুষ্ঠানটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত দেখে সাহস করে আমরাও দর্শক গ্যালারিতে প্রবেশ করলাম। বিশাল ব্যানারে ‘77th Independence Day at Field Marshal Manekshaw Parade’ দেখে একটু রোমাঞ্চিত হই। ‘ফিল্ড মার্শাল মানেকশ’ নামটি বাংলাদেশি জনগণের কাছে অত্যন্ত পরিচিত। পারস্য বংশোদ্ভূত এ ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তা পারস্যের অগ্নি উপাসক জরথুস্ত্রীয় ধর্মের অনুসারী। তার পুরো নাম ‘শ্যাম হরমুসজি ফ্রামজি জামশেদজি মানেকশ’। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর স্বামী ফিরোজ গান্ধী ছিলেন মানেকশ’দের পারিবারিক বন্ধু ও একই সম্প্রদায়ভুক্ত। ভারতের শিল্পজগতের পথিকৃৎ জামসেদজী টাটাও এই সম্প্রদায়ের লোক। ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সামরিক বিজয় অর্জিত হয় তার সুদক্ষ নেতৃত্বে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন ভারতের তদানীন্তন সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশ। লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরা ছিলেন ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান। ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশ অত্যন্ত সূক্ষ্ম কৌশলী ভূমিকা পালন করে মাত্র ১৩ দিনের যুদ্ধে অল্প প্রয়াসে, স্বল্প জনবল ও অস্ত্রসম্ভার ব্যবহার করে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে আশাতীত বিজয় অর্জন করতে সক্ষম হন। জাতির প্রতি এ অসামান্য অবদানের জন্য তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭৩ সালে তাকে ভারতের ইতিহাসে প্রথম ‘ফিল্ড মার্শাল’ অর্থাৎ পাঁচ তারকা জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে ‘জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ’ হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। কুচকাওয়াজের মাঝে চলে বিউগলের করুণ সুরে আল্লামা ইকবালের তারানা-ই-মিল্লি বা দেশাত্মবোধক গান ‘সারে জাহাঁ সে আচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হামারা’। তথ্য অনুসন্ধানে জানতে পারি, ভারতের স্বাধীনতা দিবসে জাতীয়সংগীত হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বন্দেমাতরম’ অথবা ‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে’ গাওয়া হলেও আল্লামা ইকবালের তারানা-ই-মিল্লি বা দেশাত্মবোধক সংগীতটি ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর মার্চিং গান হিসেবে বাজানো হয়। আল্লামা ইকবাল বর্তমানে পাকিস্তানের জাতীয় কবি। তিনি অবিভক্ত ভারতের স্বপ্ন দেখতেন বলেই গানটি লিখেছিলেন। পরবর্তী সময়ে মুসলিম জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি হিন্দুস্তান-এর স্থলে ‘সারা দুনিয়া’ করে দেন। এ সত্ত্বেও ভারতীয়রা এ গানকে আন-অফিসিয়ালি জাতীয় সংগীতের মর্যাদা দিয়েছে। ইন্ডিয়ান সেনাবাহিনী এটি মার্চপাস্ট সংগীত হিসেবে বেছে নিয়েছে।
আধঘণ্টা সেনাবাহিনীর মার্চপাস্ট দেখার পর বেরুলাম শহরের অন্যান্য এলাকায় স্বাধীনতা দিবস পালনের দৃশ্য দেখতে। রাস্তায় চলাচলকারী অনেক গাড়িতে ভারতীয় জাতীয় পতাকা ‘তেরঙ্গা’ পতপত করে উড়ছিল। জওহরলাল নেহরু তত্ত্বাবধানে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়ার ‘স্বরাজ’ পতাকার আদলে নির্মিত হয় জাতীয় পতাকা। জাতীয় পতাকা তৈরি হয় খাদি কাপড়ে। এখনও ভারতের একমাত্র ‘কর্ণাটক খাদি গ্রামোদ্যোগ সংযুক্ত সংঘ’ জাতীয় পতাকা উৎপাদনকারী সংস্থা। সারাদেশের মতো ব্যাঙ্গালুর শহরেও স্বাধীনতা দিবস পালন করা হয় খুবই আনুষ্ঠানিকভাবে। এ দিন জাতীয় ছুটি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য অফিস-আদালত সবখানেই কাজ বন্ধ থাকে। সমস্ত জায়গায় মিষ্টি বিতরণ করা হয়। সবাই গেরুয়া, সাদা-সবুজ রঙের উৎসবে মেতে ওঠে। কর্ণাটক রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় থাকাকালীন দলের সমর্থকরা সাম্প্রদায়িক ও উচ্ছৃঙ্খল স্লোগান দিয়ে রাস্তায় নৃত্য করলেও গত ১০ মে ২০২৩-এর নির্বাচনে কর্ণাটকের মান্দিয়া জেলার হিজাবী মুসলিম কলেজ ছাত্রী ‘মুসকান’ ঢেউতে ভেসে যাওয়ার পর কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে বিজেপির উৎপাত অনেকটা কমে গেছে বলে জানান ব্যাঙ্গালুরের ‘ভেঙ্কর নাইডো’ নামের এক অধিবাসী। কর্ণাটক বিধানসভার উক্ত নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বিজেপিকে বড় ব্যবধানে হারিয়েছে কংগ্রেস। ২২৪ আসনের বিধানসভায় কংগ্রেস জিতেছে ১৩৬টি আসনে, বিজেপি জয়ী হয়েছে ৬৫টিতে। উক্ত নির্বাচনে কংগ্রেসকে ফের ক্ষমতায় আনতে রাজ্যের ১৫ শতাংশ (সরকারি হিসেব) মুসলিম ভোটারদের বেশ ভূমিকা ছিল বলে ধারণা করা হয়।
শিবাজি নগরে ফিরে বিছানায় হেলান দিয়ে টিভির স্ক্রীনে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের খবর দেখতে থাকি। চ্যানেল জি নিউজের সংবাদে দেশব্যাপী স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বাধীনতা দিবস উদযাপনকালে ভারতের জাতীয় পতাকা ‘তেরঙ্গা’ ওড়ার দৃশ্য দেখালেও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য নাগাল্যান্ডে দেখা গেল ভিন্ন দৃশ্য। যে পতাকা উড়ছিল, সেই পতাকা স্বাধীন ভারতের তেরঙ্গা নয়, স্বাধীন ‘নাগালিম’র যে দাবি নব্বইয়ের দশক থেকে ভারতীয় রাজনীতিতে গুরুত্ব পেয়ে আসছে, সেই নাগালিমের পতাকাই উড়তে দেখা গেল ১৫ আগস্টের দিনে। যারা ভারতের এ অঞ্চলের রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন নাগাল্যান্ড, মনিপুর, অরুনাচল প্রদেশ, মিজোরাম, আসাম ও মিয়ানমারের কিছু অঞ্চল নিয়ে ‘নাগা স্বাধীন ভূমি’ বা ‘নাগালিম’ গড়ার ডাক বহুদিনের পুরোনো। এ দাবিতে তারা সশস্ত্র আন্দোলন চালিয়ে আসছে অনেকদিন ধরে। একদিকে ভারত রাষ্ট্রের একতার বিপরীতে পরিহাসের মতো উড়তে থাকা নাগা পতাকা, অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী মোদির ভাষণে স্বাধীন ভারতের সাফল্যের উদাহরণ। অনুরূপভাবে কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী জনগণকে রাজপথে স্লোগান দিতে দেখা যায়, ‘হাম কিয়া চাহতে হে? আজাদি, আজাদি! জো তুম না দোগে আজাদি, ওহ ছিনকে লেঙ্গে আজাদি’ স্লোগান দিতে। সব মিলিয়ে মনে হলো, ভারতের ৭৭তম স্বাধীনতা দিবস ভারতের জনজীবনে কিছুটা হলেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ৭৭টি বসন্ত কাটানোর পরও যখন দেশের ভেতর এসব প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে, স্বাধীনতার সংজ্ঞায় আসলেই কোথাও গলদ রয়ে গেছে।
লেখক : কলামিস্ট ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক