তুরস্কের উন্নয়নে সুপার পাওয়ার

অধ্যাপক শাব্বির আহমদ

প্রকাশ : ০৩ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

দীর্ঘ দুই দশকের শাসনামলে দেশের অভ্যন্তরে সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি কমানোর পাশাপাশি হার্ড ও সফ্ট ধরনের পাওয়ারের সমন্বয় ঘটিয়ে তুরস্ককে আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন এরদোয়ান। কূটনীতি ও সামরিক শক্তির সমন্বয়ে পরাশক্তিগুলোকে কখনও পক্ষে, কখনও বিপক্ষে রাখার চেষ্টা করছেন। তবে কোনো বলয়ে ঢুকে পড়েননি। সমকালীন আন্তর্জাতিক রাজনীতির ঝানু খেলোয়াড় এরদোয়ান গত দুই দশকে রুশ-মার্কিন উভয় শক্তির সঙ্গেই খেলেছেন চতুর এক খেলা। রাশিয়ার যুদ্ধবিমান তুর্কি আকাশে ঢুকে পড়লে সেটা ভূপাতিত করে রাশিয়ার সঙ্গে যখন দূরত্ব তৈরি হয়, সেই অবস্থায় পক্ষে টানেন ন্যাটোভুক্ত দেশ হিসেবে ইউরোপ ও মার্কিন সমর্থন। আবার সিরিয়া ও ইরাকে কুর্দি দমনে নেন রাশিয়ার সমর্থন। খেয়াল করলে দেখা যাবে, এরদোয়ানের উচ্চাভিলাষের সঙ্গে আসল সংঘাত রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের। সিরিয়া, লিবিয়া এবং আজারবাইজানের নাগরনো কারাবাখ- সবখানেই এরদোয়ান ঠেকিয়ে দিয়েছেন রুশ প্রভাব। তবে আমেরিকার সঙ্গেও কম যাননি। ২০১৭ সালের দিকে আমেরিকার তত্ত্বাবধানে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে স্বাধীন কুর্দি রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। এ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হলে তুরস্কের কুর্দি জনগণের মাঝে স্বাধীনতার স্পৃহা আবার দেখা দেয়ার আশঙ্কা তৈরি হলো। কালবিলম্ব না করে এরদোয়ান মার্কিন হুমকি-ধমকির তোয়াক্কা না করে ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে সিরিয়ার অভ্যন্তরে সামরিক অভিযান চালান। সীমান্ত এলাকা থেকে কুর্দি বিদ্রোহীদের সিরিয়ার অনেক ভেতরে ঠেলে নিজ দেশে আশ্রিত ৩৬ লাখ সিরিয়ান শরণার্থীদের পুনর্বাসন করার লক্ষ্যে ৪৮০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য বাপার জোন গঠন করেন। ফলে আমেরিকার পরিকল্পনা বানচাল হয়। ২০২০ সালে কৃঞ্চসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকে করে গ্রিসের সঙ্গে চরম উত্তেজনাকে মুহূর্তে গ্রিস আমেরিকা ও ফ্রান্সের সঙ্গে নৌ মহড়ার আয়োজন করলে এরদোয়ান রাশিয়াকে সঙ্গে নিয়ে পাল্টা নৌ মহড়ার ঘোষণা দিলে নড়েচড়ে বসে আমেরিকা।

রাশিয়া থেকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা কেনার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়নের পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকার কিছু পদক্ষেপের বিপরীতে রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন এরদোয়ান। আবার যুক্তরাষ্ট্র থেকে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান কেনার জন্য রাশিয়ার এস-৪০০ ব্যবহার সীমিত করারও ইঙ্গিত দেন। যে চীনকে কোণঠাসা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে, সেই চীনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হস্তগত করতে পাকিস্তানের সঙ্গে যৌথভাবে ক্ষেপণাস্ত্র ও পঞ্চম প্রজন্মের জেএফ-১৭ থান্ডার যুদ্ধবিমান তৈরির জন্য পাকিস্তানের সঙ্গে চুক্তি করেন। সিরিয়ায় সেনাঘাঁটির পর লিবিয়ায়ও সামরিক ঘাঁটি বানানোর পথে তুরস্ক। আজারবাইজানেও তুর্কি ঘাঁটি হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। তুরস্কের জ্বালানি চাহিদা মেটাতে তার দরকার লিবিয়ার তেল; সম্ভব হলে কয়েকটি তেলখনির দখল। আজারবাইজানের তেল-গ্যাস পাইপলাইন দিয়ে তুরস্ক আসে। কৃষ্ণসাগরের বিপুল তেলভান্ডার আবিষ্কার এবং লিবিয়া-সিরিয়া-ইরান-ইরাক ও আজারবাইজান থেকে আমদানি করা তেল-গ্যাসের নিশ্চয়তা তুরস্ককে জ্বালানির জন্য অতিমাত্রায় রুশনির্ভরতা থেকে বের করে আনবে নিঃসন্দেহে। রুশ বংশোদ্ভূত মার্কিন অধ্যাপক দিমিতার বেশেভের ভাষায়, তুরস্কের দুই পাশে তেল ও গ্যাস উৎপাদক মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণে ককেশীয় অঞ্চল এবং জ্বালানির ক্রেতা ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো। এ অবস্থানগত সুবিধাই হলো তুরস্কের হাতের ট্রাম্প কার্ড। তুরস্কের কৃষ্ণসাগরে বিরাট গ্যাস মজুত আবিষ্কার আসলেই খেলার নিয়ম বদলে দেবে। কৃষ্ণসাগরে জ্বালানি গ্যাসের মজুত আবিষ্কার তুরস্কের দর-কষাকষির ক্ষমতাকে আরো বাড়িয়ে তুলবে। মূলত তুরস্কের ভূকৌশলগত অবস্থান দেশটির জন্য সব দিক দিয়ে আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে।

প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান দেশের স্বার্থে কাউকে চুল পরিমাণ ছাড় দিতে রাজি নন। ধারণা করা হচ্ছে, তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতার মসনদে বসে এরদোয়ান অতীতের মতো আরো কিছু দুঃসাহসী পদক্ষেপ নিতে পারেন। আন্তর্জাতিক নিয়মানুযায়ী যে কোনো চুক্তির মেয়াদ ১০০ বছর। সে অনুযায়ী চলতি বছর লুজান চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। এরদোয়ান যে কোনো সময় বসফরাস প্রণালী দিয়ে জাহাজ চলাচলের ওপর তুরস্কের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও করারোপের ঘোষণা দিতে পারেন। এতে করে তুরস্কের অর্থনৈতিক চিত্র দ্রুত পাল্টে যাবে নিঃসন্দেহে। রাশিয়াসহ পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর ভূমধ্যসাগরে প্রবেশের একমাত্র পথ বসফরাস প্রণালী। অন্যদিকে আমেরিকার কৃঞ্চসাগরে প্রবেশের একমাত্র পথ এ প্রণালী। পূর্ব ভূমধ্যসাগর ও এজিয়ান সাগর এলাকায় গ্রিসের এমন বহু দ্বীপ আছে, যা তুরস্কের খুব কাছে এবং উপকূল থেকে দেখা যায়। লুজান চুক্তি দ্বারা এগুলো গ্রিসের হাতে তুলে দেয়া হয়। ফলে এখানে কার সমুদ্রসীমা কোথায়, তা নির্ধারণ করা একটি জটিল ব্যাপার। গ্রিস যদি তার সমুদ্রসীমা ৬ মাইল থেকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ১২ মাইল পর্যন্ত সম্প্রসারিত করে, তাহলে তুরস্কের যুক্তি অনুযায়ী তার নিজের সমুদ্রসীমা গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গ্রিসের কাস্টেলোরিজো দ্বীপের অবস্থান হচ্ছে তুরস্কের মূল ভূখণ্ড থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে। পক্ষান্তরে গ্রিস থেকে প্রায় পাঁচশত কিলোমিটার দূরে। তুরস্ক এরইমধ্যে শান্তিপূর্ণ উপায়ে এসব দ্বীপ ফেরত দিতে বলেছে গ্রিসকে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বারবার বলে আসছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তুরস্কের ন্যায্য অধিকারের প্রতি সম্মান না দেখালে তুরস্কের মানুষকে তাদের মূল ভূখণ্ডে আটকে রাখতে ১৯২৩ সালে লুজান চুক্তির মাধ্যমে যে মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে, আঙ্কারা প্রয়োজনে তা ছিঁড়ে ফেলে দেবে। এমতাবস্থায়, গ্রিসের দখলে থাকা তুরস্কের আশপাশের দ্বীপগুলো দখলে নিতে যে কোনো সময় ঝটিকা অভিযান চালাতে পারে তুরস্ক।

বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ক্ষমতা প্রদর্শনের অন্যতম উপাদান হলো সামরিক সক্ষমতা। অর্থনীতি, মিলিটারী ও প্রযুক্তির হার্ড পাওয়ার, সফট পাওয়ারের সম্মিলনের মাধ্যমেই সুপার পাওয়ার হওয়া সম্ভব। এ তিনটির সমন্বয়ে এরদোয়ান তুরস্ককে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গেছেন। দেশটি ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্র। সেনা সংখ্যায় ন্যাটো জোচে দেশটির অবস্থান দ্বিতীয়। আর বিশ্বের শক্তিশালী মিলিটারীর দেশগুলোর মধ্যে তুরস্কের অবস্থান দশম স্থানে। মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সেনা সংখ্যায় তুরস্কের অবস্থান প্রথম স্থানে। পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির ইঙ্গিতও অনেক আগেই দিয়ে রেখেছেন এরদোয়ান। অধিকন্তু তুরস্কে আমেরিকার মোতায়েনকৃত ৪০ শতাংশ পারমাণবিক বোমার নিয়ন্ত্রণ তুরস্কের হাতে। সুতরাং তুরস্কের হাতে পারমাণবিক বোমা নেই, এ কথা বলা যাবে না। এমতাবস্থায়, তৃতীয়বারের মতো তুরস্কের প্রেসিডেন্টের পদে বসে তুরস্কের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে কোনো পরাশক্তির বলয়ে না ঢুকে, দেশি ও বিদেশি ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে তুরস্ককে দুর্দমনীয় সামরিক শক্তি হিসেবে কতটুকু সামনে এগিয়ে নিতে পারবেন এরদোয়ান, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

লেখক : শিক্ষক, কলামিস্ট ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক