এক মাস আগে গাজার বাসিন্দা জুমানা এমাদ গর্ভাবস্থার শেষ পর্যায়ে ছিলেন। আনন্দের সঙ্গে সন্তান জন্মের অপেক্ষায় থাকা এই মা তার গর্ভাবস্থার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও শেয়ার করেছিলেন। তিনি জানতেন, তার একটি মেয়ে হবে। তার স্বামী অনাগত সন্তানের জন্য অধীর অপেক্ষায় ছিলেন। হাসপাতালের ব্যাগ তৈরি ছিল। আর তাদের ৪ বছরের মেয়ে তুলিনের তার বোনের সঙ্গে দেখা করার তর সইছিল না। কিন্তু তারপরই সব বদলে গেল। ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের হামলায় বহু মানুষের মৃত্যু হয়। এর পাল্টা জবাবে গাজায় ইসরাইলের পাল্টা বিমান হামলায় এখন পর্যন্ত ৮ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
জুমানা বলেন, টানা গোলাগুলির মধ্যেই আমার প্রসব যন্ত্রণা ওঠে। গাজার উত্তরাঞ্চল ছেড়ে যাওয়ার ইসরাইলি নির্দেশনা মেনে বাড়ি ছাড়েন ২৫ বছর বয়সি এই ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। ইসরাইলের হামলা শুরুর দুদিন পর তিনি গাজা শহর ছেড়ে দক্ষিণ দিকে চলে যান। ভীত ও ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা জুমানা তার মেয়েকে এক আত্মীয়ের বাড়ি নিয়ে যান। সঙ্গে নেন মেয়ের জন্য শুধু একটা কাপড়, এক প্যাকেট দুধ আর একটা ছোট ব্যাগ। জুমানা জানান, আমরা রাতে ঘুমাইনি। সেখানে প্রচুর গোলাবর্ষণ হওয়ায় আমাদের অন্য জায়গায় যেতে হয়েছিল। আমার মতো গর্ভবতী নারীদের হাঁটতে বের হওয়া উচিত। কিন্তু যুদ্ধের কারণে আমরা খাবার কিনতেও বাইরে যেতে পারছি না। এ কঠিন পরিস্থিতিতে সন্তান জন্ম দেওয়া নিয়ে ভয় আর উদ্বেগের পাশাপাশি বার বার বিদ্যুৎ চলে যাওয়া, ইন্টারনেট বিঘ্নিত হওয়া ও পানি স্বল্পতার কথা বলেছিলেন জুমানা।
১৩ অক্টোবর শুক্রবার জুমানার প্রসব বেদনা শুরু হয়। তার পরিকল্পনা ছিল, গাজা শহরের একটি বড় হাসপাতাল আশ শিফায় যাওয়া; কিন্তু তাকে জানানো হয়, হাসপাতালের অবস্থা খুবই কঠিন। তার পরিবর্তে গাজা উপত্যকার মাঝখানে নুসেইরাতের একটি ছোট হাসপাতাল আল আওদায় যান জুমানা। কিন্তু সেখানে পৌঁছানোও কঠিন ছিল। প্রসব যন্ত্রণার মধ্যে তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাউকে খুঁজে পেতেও হিমশিম খাচ্ছিলেন জুমানা। ট্যাক্সি চালকরা ভীত ছিল। মা হতে যাওয়া একজন নারীর জন্য অ্যাম্বুলেন্সও ছিল না। প্রসব বেদনার সময়টিকে কঠোর ও ভয়ঙ্কর হিসেবে বর্ণনা করেন জুমানা, হাসপাতালের পাশের একটি বাড়ি তীব্র গোলাবর্ষণ হচ্ছিল। সেই শব্দ এতটাই জোরে ছিল যে, ভেবেছিলাম গোলাগুলি হাসপাতালেই হচ্ছিল। অনবরত আহত মানুষ আসছিল। চারদিক থেকে চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। আমার বড় মেয়ের কথাও ভাবছিলাম। সে আমার থেকে দূরে থাকায় তাকে নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। আমি শুধু ভেবেছিলাম, যাই হোক না কেন, আমি আমার সন্তানকে জন্ম দিতে চাই।
সেদিনই সন্ধ্যার কয়েক ঘণ্টা পর একটি কন্যাসন্তান জন্ম দেন জুমানা। তিনি তার নাম রাখেন তালিয়া। সেই সময়ের অনুভূতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, তার কান্না শুনে মনে হচ্ছিল, তখনও আমরা সবাই বেঁচে আছি। প্রসবের পরপরই জুমানার জন্য কোনো বিছানা পাওয়া যায়নি। ব্যথা ও রক্তপাতের মধ্যেই তাকে একটি বিছানা পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছিল। অন্য নারীরা সন্তান জন্ম দেওয়ার পর হাসপাতালের করিডোরের সোফা আর মেঝেতে শুয়েছিল। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) অনুমানমতে, গাজায় প্রায় ৫০ হাজার গর্ভবতী নারী রয়েছে; যাদের মধ্যে সাড়ে পাঁচ হাজার নারী আগামী ৩০ দিনের মধ্যে সন্তান প্রসব করবে। সংস্থাটি বলেছে, হাসপাতালগুলোতে প্রচুর ভিড় আর ওষুধ ও মৌলিক সরবরাহও শেষ হয়ে যাচ্ছে।
সন্তান জন্ম দেওয়ার পরদিন জুমানা একটি ভিডিও পাঠান, যেখানে দেখা যায়, ট্যাক্সির ভেতরে সাদা কম্বলে মোড়ানো শিশুকন্যাকে নিয়ে তিনি বসে আছেন। হাসপাতাল ছেড়ে পরিবারের কাছে যাওয়ার সময়ও খুব কঠিন ছিল। বিদ্যুৎ না থাকায় লিফটটি কাজ করছিল না। ফলে বের হবার জন্য প্রসবের পরে ব্যথা নিয়েই সন্তানকে কোলে করে হাসপাতালের চারতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসতে হয়। হাসপাতাল থেকে বের হবার পর বাড়ি ফিরতে গাড়ি পেতেও তাকে বেগ পেতে হয়। কোনো ড্রাইভারই তাদের নিতে রাজি হয়নি। সকালে কাছাকাছি জায়গাতেই গোলাগুলি হওয়ায় তারা ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত একজনকে পেয়েছেন, কিন্তু সে ভাড়া বেশি চেয়েছিল। তাও আবার বাড়ির সামনেও নামায়নি।