ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

হেজবুল্লাহর আঞ্চলিক যুদ্ধের হুঁশিয়ারি

হেজবুল্লাহর আঞ্চলিক যুদ্ধের হুঁশিয়ারি

গাজায় ইসরাইলের আক্রমণে বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা বন্ধ না হলে মধ্যপ্রাচ্যে বৃহত্তর যুদ্ধের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হেজবুল্লাহর সেকেন্ড ইন কমান্ড শেখ নাঈম কাসেম। তিনি বলেন, ‘এ অঞ্চলে অত্যন্ত গুরুতর ও ভীষণ বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এর পরিণতি কেউ আটকাতে পারবে না।’ গাজায় হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তরফে সম্প্রতি জানানো হয়, সেখানে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এ রকম একটা সময়েই বৈরুতে একটি সাক্ষাৎকারে হেজবুল্লাহর উপপ্রধান ওই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় ১ হাজার ৪০০ মানুষের মৃত্যু হয়। যাদের মধ্যে ১ হাজার বেসামরিক নাগরিক ছিলেন। হামাসের ওই হামলার জবাবেই ইসরাইলও পাল্টা হামলা চালায়।

হেজবুল্লাহর ওই নেতা বলেন, ‘বিপদটা সত্যিই আসতে চলেছে। কারণ, ইসরাইল বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে আগ্রাসন বাড়াচ্ছে। বেশি সংখ্যায় নারী ও শিশুদের হত্যা করছে।’ তার কথায়, ‘এ অঞ্চলে আরো বিপদ ডেকে না এনে কি এ পরিস্থিতি চলতে পারে? আমার মনে হয় না।’ তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘ইসরাইলের হামলা বাড়লে এ অঞ্চলের যুদ্ধের ঝুঁকিও বাড়বে। প্রতি ক্ষেত্রেই একটি করে প্রতিক্রিয়া হবে।’ আল্লাহর দল হেজবুল্লাহর হাতে অনেক বিকল্প আছে বলে তিনি জানান।

যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও আরব লীগ কর্তৃক সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত শিয়া ইসলামি গোষ্ঠীটি লেবাননের বৃহত্তম রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি। গাজায় যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে এখনো পর্যন্ত তারা শুধু হুঁশিয়ারির মাত্রাই বাড়িয়েছে; আর সতর্কভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে। গত রোববার লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে ইসরাইলি হামলায় এক নারী ও তিন শিশুর মৃত্যুর পর হেজবুল্লাহ প্রথমবার গ্রাড রকেট ব্যবহার করে। যাতে এক ইসরাইলি বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু হয়। হেজবুল্লাহর নেতা হাসান নাসরাল্লাহ হুমকি দিয়ে বলেছেন, লেবাননে প্রত্যেক বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যুর জবাব সীমান্তের ওপারেও দেওয়া হবে। তবে এখনও তিনি ইসরাইলকে সর্বাত্মক যুদ্ধের হুমকি দেননি।

সব বিকল্প পথই খোলা রয়েছে, এ কথায় জোর দিয়ে জঙ্গি গোষ্ঠীটি মূলত সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করে আন্তঃসীমান্ত আক্রমণের মধ্যেই নিজেদের প্রতিক্রিয়া সীমাবদ্ধ রেখেছে। তাদের ৬০ জনেরও বেশি যোদ্ধা নিহত হয়েছেন, কিন্তু তাদের জায়গা নেওয়ার মতো যুদ্ধের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হেজবুল্লাহর আরও বহু সমর্থক আছে। বৈরুতে এমন এক যোদ্ধাকে এ সপ্তাহে কবর দেওয়া হয়েছে, যার পরিবারের সদস্যরা কয়েক প্রজন্ম ধরে হেজবুল্লাহর হয়ে লড়াই করে এসেছে। শুধু তা-ই নয়, তিনি তার পরিবারের পঞ্চম সদস্য; যিনি ওই গোষ্ঠীর হয়ে প্রাণ দিয়েছেন।

সাক্ষাৎকারের সময় সংগঠনের উপপ্রধান হেজবুল্লাহকে একটি প্রতিরক্ষামূলক সংগঠন হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। যদিও তারা ইসরাইলের ধ্বংসের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ২০০৬ সালে আন্তঃসীমান্ত অভিযান চালিয়ে দুজন ইসরাইলি সৈন্যকে অপহরণ করে ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধের সূত্রপাত করেছিল। হেজবুল্লাহর ওই নেতা দাবি করেছেন, ইসরাইল গাজার বিরুদ্ধে জঘন্য আগ্রাসনের খেলায় মেতেছে। ফিলিস্তিনি জমির অধিগ্রহণ রুখতে ওই আক্রমণ অনিবার্য ছিল। হেজবুল্লাহর ওই নেতা দাবি করেন, হামাস নয়, ইসরাইলি সেনাবাহিনীই ইসরাইলের অনেক বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে।

হামাসের সশস্ত্র বাহিনীর হেলমেট-ক্যামেরায় ধরা পড়া হত্যালীলার ছবির কথা জিজ্ঞেস করা হলে, তিনি প্রশ্নটি এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, ‘গাজার অভ্যন্তরে ইসরাইল কী করেছে, সেটা আমরা কেন দেখছি না! তারা বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করে বাড়িঘর ধ্বংস করছে।’ তিনি হামাসের হামলাকে ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ বলে চিহ্নিত করেছেন। অস্বীকার করেছেন যে, তাদের পরিকল্পনার ফলাফল ঠিক উল্টো হয়েছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত যে ১০ হাজার গাজাবাসী নিহত হয়েছেন, তাদের বিষয়টা? জবাবে তিনি বলেন, ‘ইসরাইলের গণহত্যা ফিলিস্তিনিদের আরও বেশি করে মাটি আঁকড়ে থাকতে উদ্বুদ্ধ করছে।’

তিনি স্বীকার করেছেন, ইরান হেজবুল্লাহকে সমর্থন করে এবং অর্থের জোগান দেয়। তবে এটাও দাবি করেন, তারা আদেশ দেয় না। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তেহরানই সব সিদ্ধান্ত নেবে। ঠিক করবে যে, সর্বাত্মক যুদ্ধে আদৌ অংশ নেবে কিনা। ইসরাইলি বাহিনীকে যদি দ্বিতীয় একটা যুদ্ধক্ষেত্রে হেজবুল্লাহর সঙ্গে লড়াই করতে হয়, তাহলে তাদের এমন এক শত্রুর মুখোমুখি হতে হবে, যাদের কাছে অন্য বহু দেশের থেকেও বেশি অস্ত্র মজুত রয়েছে। এ দিক থেকে হামাসকেও পেছনে ফেলে দিতে পারে ওই জঙ্গি গোষ্ঠীটি। যাদের কাছে আনুমানিক দেড় লাখ রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র মজুত রয়েছে। বৈরুতভিত্তিক প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা পরামর্শদাতা নিকোলাস ব্লানফোর্ডের মতে, বিশেষ বাহিনী, যোদ্ধা এবং রিজার্ভসহ ৬০ হাজার যোদ্ধা রয়েছে তাদের। মি ব্লানফোর্ড বিগত কয়েক দশক ধরে হেজবুল্লাহর কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করে আসছেন।

এ গোষ্ঠীটি ২০০৬ সালে ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে দেশটিকে এক রকম অচল করে দেওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে গেছে। যদিও এতে লেবাননের মানুষই বেশি প্রাণ হারিয়েছিলেন। হেজবুল্লাহর এক হাজারেরও বেশি সদস্য নিহত হয়। যাদের অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক। শুধু তা-ই নয়, হেজবুল্লাহর শক্ত ঘাঁটিগুলোও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে ইসরাইলের ১২১ জন সৈন্য ও ৪৪ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়। এরপর থেকেই লেবানন একের পর এক সমস্যার মধ্য দিয়ে গেছে। যেমন- ২০২০ সালে বৈরুত বন্দরে বিধ্বংসী বিস্ফোরণ, অর্থনীতির পতন এবং রাজনৈতিক ডামাডোল। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে, খুব কম লোকেরই এখনও যুদ্ধ করার জন্য আগ্রহ রয়েছে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, হেজবুল্লাহর আন্তঃসীমান্ত হামলা এ দেশকে এমন একটি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে, যা তারা বহন করতে পারবে না।

শেখ কাসেম অবশ্য তা নিয়ে ভাবিত নন। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধকে ভয় পাওয়াটা যে কোনো লেবাননবাসীর অধিকার। এটাই স্বাভাবিক। যুদ্ধ কেউ পছন্দ করে না। ইসরাইলকে আগ্রাসন বন্ধ করতে বলুন, যাতে যুদ্ধ আর না ছড়ায়।’ হেজবুল্লাহ ও ইসরাইলের মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু না হলেও উত্তেজনা বৃদ্ধি হলে, তার বিভিন্ন সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। আর যদি যুদ্ধ শুরু হয়, তা শুধুই ধ্বংস ডেকে আনবে বলে মনে করেন মি. ব্লানফোর্ড। তিনি বলেন, ‘সেই পরিস্থিতি তৈরি হলে গাজায় এখন যা চলছে, সেটাকে একটা খুবই সামান্য ঘটনা বলে মনে হবে। সংঘাতের সময় পুরো ইসরাইলে লকডাউন থাকবে। সেখানকার বেশিরভাগ মানুষকে বোমা-প্রতিরোধী কেন্দ্রে থাকতে হবে। বেসামরিক বিমান চলাচল আর জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকবে। হেজবুল্লাহর বড় বড় গাইডেড মিসাইলগুলো দেশের সীমাতিক্রম করে সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে।’

লেবাননের বিষয়ে তিনি বলেন, ইসরাইল সেটাকে একটা গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গার মতো বানিয়ে দেবে। বর্তমানে হেজবুল্লাহ, ইসরাইল ও ইরান পরিস্থিতি খতিয়ে দেখছে। হিসাব কষছে সবাই। পুরনো শত্রুরা নতুন পরিস্থিতি মাপছে। এর অর্থ এটা নয় যে, সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘটবে না। হতে পারে, সেটা হিসাবের ভুলে অথবা হিসাব কষেই। এ রক্তে ভেজা অঞ্চলে এ যেন একটি বিপজ্জনক নতুন অধ্যায়। হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলার পর বেদনা, মৃত্যু এবং ধ্বংসই শুধু সত্য বলে মনে হয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত